নেতৃত্বের শ্রেণিবিভাগ
মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব। স্বভাবতই মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করে। আদিমকাল থেকে শুরু করে বর্তমান সমাজ পরিচালনায় নেতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। নেতার ভূমিকাকেই নেতৃত্ব বলে। সমাজ, দল ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নেতা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। অবস্থাভেদে নেতৃত্বের কার্যাবলি ভিন্ন প্রকৃতির। যেকোনো সমাজব্যবস্থায় নেতৃত্ব হচ্ছে আদর্শ স্বরূপ। নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে একটি দল লক্ষ্য অর্জনের পথে অগ্রসর হয়। নেতৃত্ব: নেতৃত্বের ইংরেজি প্রতিশব্দ 'Leadership'। ইংরেজি 'Lead' থেকে নেতৃত্ব শব্দটি উৎপত্তি লাভ করেছে। নেতার ভূমিকাকেই নেতৃত্ব বলা হয়। তাই নেতৃত্ব বলতে কোনো দলীয় পরিস্থিতিতে দলের লক্ষ্য অর্জন এবং দলের সদস্যদের কার্যকলাপ পরিচালনার জন্য ব্যক্তি বিশেষের আচরণকে নির্দেশ করে।
নেতৃত্বের সংজ্ঞা
নেতৃত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে নেতৃত্বের কতিপয় প্রামাণ্য সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো-
মনোবিজ্ঞানী ক্রাইডার এবং তাঁর সহযোগীদের মতে,
'আমরা নেতাকে দলের এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি, যিনি অন্যদের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য বিস্তার করে থাকেন।'
কিথ ডেভিস এর অভিমত অনুসারে,
'নেতৃত্ব হলো উদ্দেশ্য অর্জনের নিমিত্তে অন্যান্য লোককে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসাহিত ও সাহায্য করার একটি প্রক্রিয়া।'
সি. আই. বার্নার্ড বলেছেন,
'নেতৃত্ব বলতে কতিপয় আচরণিক গুণকে বোঝায় যা তাদের সংঘবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য চালিত করে।'
এইচ. সি. স্মিথ এর মতে,
'নেতৃত্ব হলো সংগঠনের লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে প্রভাব বিস্তার প্রচেষ্টা।'
মনোবিজ্ঞানী কিম্বল ইয়ং বলেন,
'নেতৃত্ব হলো এক ধরনের প্রভাব বিস্তার যেখানে অনুসারীরা কম বা বেশি ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যজনের নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ মেনে চলে।'
অধ্যাপক ডেন্টন ই, ম্যাকফার ল্যাডের মতে,
'নেতৃত্ব হচ্ছে আন্তঃব্যক্তিক প্রভাবের প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে নেতা উদ্দেশ্য নির্ধারণে অন্যান্যদের কার্যাবলিকে প্রভাবিত করে।'
Kontz and O'Donnel-বলেছেন,
'নেতৃত্ব হলো এমন একটি কলা বা প্রক্রিয়া যা লোকজনদের প্রভাবিত করে এবং দলীয় লক্ষ্য অর্জনে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত করে।'
উপর্যুক্ত সংজ্ঞার আলোকে বলা যায়,
নেতৃত্ব এমন একটি প্রক্রিয়া যা অধীনস্থ লোকদের দলীয় সিদ্ধান্ত অর্জনে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত করে ও উদ্দেশ্য নির্ধারণে অন্যান্যদের কার্যাবলিকে প্রভাবিত করে থাকে।
নেতৃত্বের শ্রেণিবিভাগ
নিম্নে নেতৃত্বের শ্রেণিবিভাগ বা প্রকারভেদসমূহ আলোচনা করা হলো-
১. আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্ব:
যে নেতৃত্ব-ব্যবস্থায় সর্বময় ক্ষমতা নেতার হাতে থাকে তাকে 'আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্ব' বলা হয়। ম্যাক্স ওয়েবারের মতে, কোনো সংগঠনে প্রশাসনিক উচ্চক্রমের কোনো এক বিশেষ অবস্থানে থেকে যিনি প্রশাসনিক কর্মধারার এক অংশের পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করেন তিনিই আমলা। এই ধরনের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলি নেতার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, কোনো দেশের সরকারি প্রশাসনে সচিব, যুগ্মসচিব ইত্যাদি পদে নিয়োজিত ব্যক্তিই হলেন আমলাতান্ত্রিক নেতা।
২. গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব:
যে নেতৃত্ব-ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে অধীনস্থদের অংশগ্রহণ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকে তাকে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব বলে। এই ধরনের নেতৃত্ব-ব্যবস্থায় জনগণ সর্বাধিক স্বাধীনতা ভোগ করে। যেকোনো সিদ্ধান্তে নেতা অধীনস্থদের মতামত গ্রহণ করে থাকে। Dauglas Mc Gregor গণতান্ত্রিক নেতৃত্বকে Theory 'x' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশ ও ভারতের শাসনব্যবস্থা গণতান্ত্রিক নেতৃত্বে পরিচালিত।
৩. পিতৃসুলভ নেতৃত্ব:
সমাজতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থায় সামন্ত প্রভুদের মনোভাবের উন্নততার বহিঃপ্রকাশকেই পিতৃসুলভ নেতৃত্ব বলে। তারা অধীনস্থদের দ্বারা কাজ সম্পাদন করতে চায়। এই ধরনের নেতা কর্মীদের সমস্যা সমাধানে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। কর্মীদের পারিবারিক সদস্যদের মতো স্নেহ-ভালোবাসা প্রদান করে থাকে। এ কারণে কর্মীরাও নেতার প্রতি সন্তুষ্ট থাকে। বর্তমানে নানা রকম সমস্যার কারণে এই ধরনের নেতৃত্ব দেখা যায় না।
৪. মুক্ত নেতৃত্ব:
যে নেতৃত্ব-ব্যবস্থায় নেতা কাগজী কাজে ব্যস্ত থাকে এবং অধীনস্থ কর্মীরা তাদের ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কার্য-সম্পাদন করে থাকে তাকে মুক্ত নেতৃত্ব বলা হয়। এই ধরনের নেতারা কর্মীর কাজকর্মে উদাসীনতা প্রদর্শন করে এবং নেতৃত্বসুলভ আচার-আচরণ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করে। এর ফলে সামাজিক প্রতিষ্ঠানে অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। নেতারা কর্মীদের কার্য-নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে না। একই সাথে তারা নিজেকে উত্তম ব্যক্তি হিসেবে প্রচারে সচেষ্ট থাকে।
৫. রাজনৈতিক নেতৃত্ব:
যে নেতৃত্ব-ব্যবস্থায় নেতা দেশ পরিচালনার জন্য জনগণের নিকট বিভিন্ন কর্ম তুলে ধরেন ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে জনগণের মতামত অর্জনে সচেষ্ট হন তাকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বলে। রাষ্ট্র পরিচালনার বিশেষ মতাদর্শ তুলে ধরা, নীতি প্রণয়ন করা এবং জনগণের মনে নিজ মতামতের অনুকূল প্রভাব সৃষ্টি করা এই ধরনের নেতার প্রধান কাজ। দলের আদর্শ সামনে রেখে রাজনৈতিক নেতারা অধীনস্থদের দ্বারা বিভিন্ন কার্যাবলি সম্পাদন করেন। উদাহরণস্বরূপ- আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া হলো রাজনৈতিক নেতা।
৬. আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব:
যে নেতৃত্ব-ব্যবস্থায় কার্যসম্পাদনে কর্মিগণ সংগঠনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নির্দেশ এবং নিয়মকানুন মেনে চলে তাকে আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব বলা হয়। এই ধরনের নেতৃত্ব-ব্যবস্থায় কর্মিগণ নেতার আদেশ-নির্দেশ মেনে চলে এবং একই সাথে নেতার দিকনির্দেশনা অনুসরণ করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, সরকারি অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এই ধরনের নেতৃত্ব প্রদান করে থাকে।
৭. বিপ্লবী নেতৃত্ব:
যে নেতৃত্ব-ব্যবস্থায় নেতা সামাজিক অবস্থার কোনো বিশেষ দিক পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ করে তাকে বিপ্লবী নেতৃত্ব বলা হয়। এই ধরনের নেতৃত্বের মাধ্যমে সমাজের একটি নির্দিষ্ট দিকে পরিবর্তন সাধন হয়। বেগম রোকেয়া, লেনিন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী প্রভৃতি ব্যক্তিত্ব হলেন বিপ্লবী নেতা। আর তাদের সম্পাদিত কর্মের কারণে তাদেরকে বিপ্লবী নেতৃত্ব বলা হয়।
৮. প্রতীকধর্মী নেতৃত্ব:
যে নেতৃত্ব-ব্যবস্থায় নেতারা দলের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয় তাকে প্রতীকধর্মী নেতৃত্ব বলা হয়। এই ধরনের নেতাদের দলের প্রতীক হিসেবে মেনে নিয়ে বিভিন্ন কার্যসম্পাদন করে থাকে। এই ধরনের নেতারা সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী হয়ে থাকে; যেমন- ইংল্যান্ডের রানি, থাইল্যান্ডের রাজা, নেপালের রাজা প্রমুখ হলো প্রতীকধর্মী নেতা।
৯. বিশেষজ্ঞ সাধারণ:
কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ বা জ্ঞানী ব্যক্তিকে বিশেষজ্ঞ বলা হয়। তিনি সংগঠনের কাজে যেকোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে পারেন। এই ধরনের নেতার বিজ্ঞ মতামত প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনে ভূমিকা পালন করে থাকে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানে শিল্প মনোবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গকে বিশেষজ্ঞরূপে অভিহিত করা যায়। এই ধরনের নেতারা প্রাতিষ্ঠানিক পরিকল্পনা ও নীতিমালা প্রণয়নে সহায়তা করে থাকে।
১০. প্রেষণামূলক নেতৃত্ব:
যে নেতৃত্ব-ব্যবস্থায় নেতা প্রেষণা প্রদানের মাধ্যমে কর্মীদের দ্বারা বিভিন্ন কার্য-সম্পাদন করেন তাকে প্রেষণামূলক নেতৃত্ব বলে। প্রেষণামূলক নেতৃত্ব দুই প্রকার যথা- ইতিবাচক নেতৃত্ব ও নেতিবাচক নেতৃত্ব। নেতা কর্মীদের পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে আবার ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে বিভিন্ন কার্য-সম্পাদন করিয়ে থাকে।
১১. স্বৈরাচারী নেতৃত্ব:
যে নেতৃত্ব-ব্যবস্থার নেতা সচেতন বা অসচেতনভাবে খুবই গোঁড়া এবং চরমপন্থি হয় তাকে স্বৈরাচারী নেতৃত্ব বলে। এই পদ্ধতির নেতৃত্বে নেতা নিজে যা বোঝে তাই করতে চায়। এতে সমাজের সার্বিক ক্ষতি হয়। স্বৈরাচারী নেতার কারণে বিভিন্ন সমাজ ধ্বংস হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হিটলার স্বৈরাচারী নেতৃত্ব হিসেবে বিবেচিত। এছাড়া বাংলাদেশের হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ স্বৈরাচারী নেতা হিসেবে পরিচিত।
উপসংহার
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, যেকোনো দল ও সমাজ পরিচালনায় নেতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। নেতৃত্ব শৃঙ্খলা-প্রতিষ্ঠা করে কাজে সফলতা আনয়নে ভূমিকা পালন করে। নেতৃত্ব হলো অধীনস্থ কর্মীদের প্রভাবিত করে তাদের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জনের একটি প্রক্রিয়া। নেতার কাজ হচ্ছে যেকোনো পরিস্থিতিতে সদস্যদের দিকনির্দেশনা প্রদান করা। নেতাকে যোগ্য নেতা হিসেবে গড়ে উঠতে হলে শিক্ষিত, দক্ষ ও মেধাসম্পন্ন হতে হবে। নেতা সমাজ বা দলের লক্ষ্য অর্জনের জন্য শুধু দলকে পরিচালনা করেন না; একই সাথে উপযোগী হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দক্ষ নেতৃত্বই তার অনুসারীদের সঠিক পথে পরিচালিত করে থাকে।