দলের সংজ্ঞা এবং প্রকারভেদ
মানুষ সামাজিক জীব। দল ব্যতীত ব্যক্তির অবস্থা কল্পনা করা কঠিন। একই সাথে ব্যক্তি একাধিক দলের সদস্য হতে পারে। আয়তনের দিক থেকে সবচেয়ে ছোট দল হল 'Dyad' (দু'জন ব্যক্তির সমন্বয়)।
দলের সংজ্ঞা
সমাজ মনোবিজ্ঞানী সমাজে বসবাসকারী লোকদের পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করে থাকেন। দুই বা ততোধিক লোকের সমন্বয়ে এরূপ পারস্পরিক আচরণের উদ্ভব হয়। যখন দুই বা ততোধিক ব্যক্তি পারস্পরের সম্পর্কে স্পষ্টভাবে সচেতন হয় এবং তার ফলে তাদের মধ্যে কোনো সম্বন্ধের আবির্ভাব ঘটে, তখন সেই ব্যক্তিদের সমষ্টিকে দল হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। দল হলো কিছু ব্যক্তির সমষ্টি যারা অখণ্ডভাবে বা একটি সমষ্টিগত এককরূপে কাজ করে; যেমন-পরিবার, ছাত্র সংগঠন, জনতা প্রভৃতি।
সমাজ মনোবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানিগণ দলের বিভিন্ন ধরনের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন-
মোজাফফর শরীফ এর মতে,
'দল হলো একটি সামাজিক একক যা দুই বা ততোধিক লোকের সমন্বয়ে গঠিত। দলে যারা থাকেন তাঁদের সামাজিক পদমর্যাদা এবং ভূমিকার মধ্যে একটি সুষ্ঠু সম্পর্ক রয়েছে। কতকগুলি মূল্যবোধ ও আদর্শমান (norms) দ্বারা দলের সদস্যদের আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয়।'
নিউকম্ব (Newcomb) বলেন,
'দল হলো দুই বা ততোধিক ব্যক্তির সমষ্টি। দলে অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিরা কতকগুলো বস্তু বা ঘটনা সম্বন্ধে একই সামাজিক আদর্শে বিশ্বাস করেন এবং তাদের সামাজিক ভূমিকা পারস্পরিক সম্পর্কে সম্পর্কিত।'
সমাজ বিজ্ঞানী হোমেন্স (Homans)-এর মতে,
'কোনো একটি সময়ের মধ্যে পরস্পর যোগাযোগ স্থাপনকারী কতিপয় ব্যক্তির সমন্বয়কে দল বলে।'
ক্রেচ, ক্রাচফিল্ড ও ব্যালাচি 'দল' শব্দের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দুই ধরনের দলের কথা বলেছেন,
ক. মানসিক দল: পরস্পর নির্ভরশীল এবং একই মতাদর্শ, মূল্যবোধ ও আদর্শমান দ্বারা পরিচালিত দুই বা ততোধিক সদস্যবিশিষ্ট দলকে মানসিক দল হিসেবে অভিহিত করা যায়; যেমন-পরিবার, বন্ধুদল, কর্মীদল প্রভৃতি।
খ. সামাজিক সংগঠন: কোনো বিশেষ লক্ষ্য অর্জনের জন্য গঠিত পরস্পর সম্পর্কযুক্ত দুই বা ততোধিক মানসিক দল হলো সামাজিক সংগঠন; যেমন-রাজনৈতিক দল, শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রভৃতি।
ক্রেচ এবং ক্রাচফিল্ড (Kreech & Crutchfield) দল সম্বন্ধে আরো বলেন,
একই ধরনের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী কিছু ব্যক্তিকে দল হিসেবে অভিহিত করা যায় না; যেমন-কিছু কৃষক বা অন্ধ ব্যক্তির সমষ্টি দল নয়। তাদের সমষ্টিকে 'জনশ্রেণি' বলা যেতে পারে।
কিমবল ইয়ং (Kimball Young) বলেন,
'সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ারত দুই বা ততোধিক ব্যক্তিই হলো দল।'
মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কিছু ব্যক্তির নিছক সমষ্টিকেই দল বলা যায় না। এই জাতীয় ব্যক্তির সমষ্টির সঙ্গে কোনো জড় দ্রব্যের সমষ্টির পার্থক্য নেই। একাধিক ব্যক্তির সমাবেশকে তখনই দল বলা যেতে পারে যখন সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক আদান-প্রদান হবে।
এছাড়া একাধিক ব্যক্তির সমষ্টিকে তখনই দল হিসেবে গণ্য করা হবে যখন-
- সদস্যরা একই লক্ষ্য ও প্রেষণার অংশীদার হবে যার দ্বারা দল পরিচালিত হবে।
- সদস্যদের দ্বারা কতকগুলো দলীয় আদর্শমানের উদ্ভব হবে যার সাহায্যে দলীয় কার্যক্রম এবং পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণীত হবে।
- প্রবহমান পারস্পরিক ক্রিয়া থেকে বিভিন্ন সদস্যের নিজ নিজ ভূমিকা নির্ধারিত বা প্রতিষ্ঠিত হবে।
- সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক পছন্দ-অপছন্দের একটি সম্পর্ক গড়ে উঠবে।
সর্বোপরি বলা যায়, দল হলো একটা মানসিক-সামাজিক ঐক্য যা যান্ত্রিক জনসমষ্টি থেকে সব সময়ই পৃথক।
দলের প্রকারভেদ
যখন দুই বা ততোধিক ব্যক্তি পরস্পরের সম্পর্কে স্পষ্টভাবে সচেতন হয় এবং তার ফলে তাদের মধ্যে কোনো বন্ধন বা সম্বন্ধের সূত্রপাত ঘটে, তখন সেই ব্যক্তি সমষ্টিকে দল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। দলের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তির উদ্দেশ্যে ব্যক্তিবর্গের পারস্পরিক সম্পর্ক, দলের স্থায়িত্ব এবং আরো নানান ধরনের মানদণ্ডের ভিত্তিতে দলসমূহকে বিভিন্ন প্রকারে ভাগ করা যায়। নিম্নে দলের প্রকারভেদ সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
১. প্রাথমিক দল এবং মাধ্যমিক দল:
প্রাথমিক দল: প্রাথমিক দলের ব্যক্তিদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ এবং প্রত্যক্ষ সম্পর্ক বর্তমান। মুখোমুখি পরিচয় এই দলের প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রাথমিক দল সুসংগঠিত হলে দলভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা দেয় নিবিড় আন্তরিকতা, পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও সহানুভূতি এবং পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করার আগ্রহ ও উৎসাহ। এই দলের সদস্যদের মধ্যে 'আমরা' (we self) ভাবটা প্রবল হয়। পরিবার, শিশুদের খেলার দল ইত্যাদি প্রাথমিক দলের উদাহরণ।
মাধ্যমিক দল: মাধ্যমিক দলের ব্যক্তিদের মধ্যে একটা সাধারণ গোষ্ঠীচেতনা আছে এবং সেই চেতনায় উদ্ভুত একটা ঐক্যবোধ আছে। তবে ব্যক্তিদের পারস্পরিক সম্পর্ক ততটা প্রত্যক্ষ ও ঘনিষ্ঠ নয়। এদের সম্পর্ক অনেকটা নৈর্ব্যক্তিক, পরোক্ষ এবং বাহ্যিক। রাজনৈতিক দল, ছাত্রসংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, শিক্ষক সমিতি প্রভৃতি মাধ্যমিক দলের উদাহরণ।
২. অন্তর্দল ও বহির্দল অন্তর্দল:
অন্তর্দল: এই দলের সদস্যদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক খুবই মধুর এবং দলের প্রতি তাদের আনুগত্য, সহযোগিতার ভাব, ঐক্যের অনুভূতি খুবই প্রবল। এদের মধ্যে দলের সংহতির চেতনা অত্যন্ত প্রবল। পাড়া-প্রতিবেশী, পরিবার ইত্যাদি অন্তর্দলের উদাহরণ।
বহির্দল: দুটি দলের তুলনামূলক বিচারে সংখ্যালঘু দলটিকে হিসেবে গণ্য করা হয়। আবার একই দলে যেসব সদস্য দলের প্রতিষ্ঠিত আদর্শমান থেকে বিচ্যুত হয় তারা বহির্দল হিসেবে বিবেচিত হয়। বহির্দলের সদস্যদের প্রতি অন্তর্দলের সদস্যরা কোনো আনুগত্য, সহযোগিতা বা সহানুভূতি প্রদর্শন করে না। শ্রমিকদের কাছে শ্রমিকদল অন্তর্দল কিন্তু মালিকদের দল হচ্ছে বহির্দল।
৩. আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক দল:
আনুষ্ঠানিক দল: আনুষ্ঠানিক দল হলো সেসব দল, যেসব দলে আচার-আচরণের জন্য নিয়ম-কানুন এবং সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা নির্ধারিত থাকে। ব্যক্তি-পদমর্যাদা মাফিক নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে। শ্রেণিকক্ষ আনুষ্ঠানিক দলের উদাহরণ। এখানে শিক্ষার্থীদের আচার-আচরণে শোভনতা এবং নিয়ম মেনে চলতে হয়।
অনানুষ্ঠানিক দল: এ ক্ষেত্রে দলের সদস্যদের কড়াকড়ি নিয়মের মধ্যে চলতে হয় না, সদস্যরা নিজস্ব চিন্তা এবং কাজের স্বাধীনতা ভোগ করে। অনানুষ্ঠানিক দলে যেসব নিয়মকানুন বা সামাজিক প্রত্যাশা বর্তমান সেগুলো কোনো অনানুষ্ঠানিক রীতি- নীতি দ্বারা আবদ্ধ নয়। পরিবেশ-পরিস্থিতির আলোকে সদস্যরা বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে; যেমন- সেনাবাহিনীর সদস্যরা যখন প্রশিক্ষণরত থাকে তখন তারা রীতি-নীতি মাফিক আচরণ করে। কিন্তু এই সদস্যরা যখন কোনো পার্টিতে মিলিত হয় তখন তাকে আর আনুষ্ঠানিক বলা যায় না।
৪. বর্তমান দল ও নির্দেশক দল:
বর্তমান দল: ব্যক্তি প্রত্যক্ষভাবে যে দলের সাথে জড়িত সেটাই তার বর্তমান দল। একজন ব্যক্তি একই সাথে নানা রকম দলের সদস্য হতে পারে; অর্থাৎ, তার বিভিন্ন বর্তমান দল থাকতে পারে; যেমন-পরিবার, বিদ্যালয়ের বন্ধু-বান্ধবের দল, মহল্লার কোনো সংঘ প্রভৃতি একটি ছেলের বর্তমান দল হতে পারে। কারণ, সে ঐ দলের প্রত্যক্ষ সদস্য।
নির্দেশক দল: কোনো দলের সদস্য হয়ে যদি ব্যক্তি অন্য দলের সদস্য হিসেবে কল্পনা করতে পছন্দ করে; অর্থাৎ, যে দলের সদস্য হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তার প্রবল সেই দল ব্যক্তিনির্দেশক দল হিসেবে বিবেচিত হবে। নির্দেশক দলের স্বীকৃতি লাভের জন্য ব্যক্তি সেই দলীয় আদর্শের মতানুবর্তী হয় যা তার ব্যক্তিত্ব বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে; যেমন-পরিবার একজন ব্যক্তির বর্তমান দল হওয়ার পরও কোনো ধর্মীয় সংগঠন বা কোনো নাট্যগোষ্ঠী তার নির্দেশক দল হতে পারে।
৫. মুক্ত দল ও রুদ্ধ দল:
মুক্ত দল: যেসব দলে নতুন সদস্যদের সহজে প্রবেশাধিকার থাকে, সেগুলো হচ্ছে মুক্ত দল; যেমন-শিক্ষক সমিতি, সামাজিক সংগঠন ইত্যাদি।
রুদ্ধ দল: এসব দলে নতুন সদস্যদের প্রবেশের সুযোগ তেমন সহজ নয়; যেমন-কোনো গোপন সমিতি, ক্যাডার-ভিত্তিক সংগঠন ইত্যাদি।
৬. গণতান্ত্রিক দল এবং অগণতান্ত্রিক দল:
গণতান্ত্রিক দল: এ ধরনের দলে কর্মপন্থা এবং নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে সদস্যদের অংশগ্রহণ বজায় থাকে। দলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের অভিমতকে গ্রহণ করা হয়; যেমন-জাতীয় সংসদ।
অগণতান্ত্রিক দল: এ ক্ষেত্রে দলের নেতা তার ইচ্ছা এবং অভিমত অন্যান্য সদস্যের উপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয় এবং সদস্যরা তাঁর নির্দেশিত কর্মপন্থা অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য হয়; যেমন-কোনো গোপন সমিতি, যার সদস্যরা সম্পূর্ণরূপে নেতার কর্তৃত্বের অধীন।
৭. অস্থায়ী দল এবং স্বল্পকাল স্থায়ী দল:
অস্থায়ী দল: এ দলের ব্যক্তিরা সংগঠনের কথা চিন্তা না-করেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিলিত হয়; যেমন-কোনো অঘটন দেখে রাস্তায় সমবেত কৌতূহলী জনতার দল।
স্বল্পস্থায়ী দল: এ দলের ব্যক্তিরা পূর্ব থেকে সংগঠনের কথা চিন্তাভাবনা করে সংগঠিত হয়। দলের সদস্যরা যখন স্বেচ্ছায় দল ত্যাগ করে তখন দল ভেঙে যায়; যেমন-কোনো বিশেষ দলের সভা-সমাবেশ।
৮. দীর্ঘস্থায়ী দল এবং চিরস্থায়ী দল:
দীর্ঘস্থায়ী দল: এ ধরনের দলের সংগঠন দলের ব্যক্তিদের ইচ্ছা অপেক্ষা তাদের স্থায়ী সম্পর্কের উপর নির্ভর করে। তাই দল গঠন স্থায়ী হয়। একটা বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ব্যক্তিবর্গ সংঘবদ্ধ হয়; যেমন-শ্রমিক সংগঠন; পেশাজীবী সংগঠন।
চিরস্থায়ী দল: এ ধরনের দলের সংগঠনের একটা অবিচ্ছিন্ন স্থায়িত্ব থাকে। দলে ব্যক্তির আগমন এবং প্রত্যাগমনে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয় না এবং ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর দল নির্ভরশীল নয়; যেমন-গ্রাম্য সমাজ, নগর সমাজ ইত্যাদি।
উপসংহার
দলের উপর্যুক্ত শ্রেণিবিভাগগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়-এই সকল শ্রেণিবিভাগ দল শব্দটির বিভিন্নমুখী ব্যবহারকে তুলে ধরেছে। তাই দেখা যায় একই দল একাধিক শ্রেণিবিভাগে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সমাজস্থ সকল মানুষই কোনো না কোনোভাবে দলের আওতাভুক্ত হয়ে থাকে।