কীরূপে গুজবের উৎপত্তি হয় এবং ছাড়ায়
গুজব হচ্ছে একটা অনির্ভরযোগ্য ও বিকৃত তথ্য যা অদ্ভুত রকম দ্রুত গতিতে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। গুজবে কোনো বিষয় মানুষের মুখে মুখে প্রচার হতে গিয়ে ঐ বিষয়-সংক্রান্ত তথ্যের বিকৃতি-সাধন হয়। কোনো কোনো গুজব মানুষকে আনন্দ দেয়; আবার কিছু গুজব মানুষের মধ্যে সৃষ্ট আতঙ্ক বা ভয়-ভীতিকে যথার্থ করে তোলে। গুজব মানুষেরই সৃষ্টি এবং সেখানে ব্যক্তি-বিশেষের অবদান অপরিসীম।
Kimball Young (১৯৪৮) গুজব প্রসঙ্গে বলেন,
গুজব হলো একটা বিশেষ ধরনের অভিভাবন, কোনো ব্যক্তি বা ঘটনা সম্পর্কে কোনো বাস্তব বা কাল্পনিক গল্প, যেটা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তেই থাকে।
Allport & Postman (1947) গুজবের সংজ্ঞা দেন এভাবে,
'গুজব হচ্ছে, নির্ভরযোগ্য তথ্যবিহীন মুখে মুখে প্রচারিত একটি বক্তব্য বিষয়'
'The Psychology of Rumour' গুজব প্রচারের শর্ত হিসেবে Allport & Postman (1947) বিষয়ের 'গুরুত্ব' ও 'দুর্বোধ্যতা'র উপর আলোকপাত করেন।
তাদের মতে, গুজব কী পরিমাণ হবে তা নির্ভর করে গুজব-সম্পর্কিত বিষয়ের 'গুরুত্ব' ও 'দুর্বোধ্যতা'র উপর। এ দুয়ের মধ্যে যে সম্পর্ক তা যৌগিক (additive) নয় বরং গুণিতক।
ফলে 'দুর্বোধ্যতা' বা 'গুরুত্ব' এর কোনো একটি শূন্য হলে সেখানে কোনো গুজব থাকবে না।
এই শর্তানুযায়ী গুজবের সূত্র হলো-
R ∞ i * a
এখানে, R = গুজব (Rumour)
i = গুরুত্ব (importance)
a = দুর্বোধ্যতা (ambiguity)
তাদের মতানুসারে,
'গুজবে কোনো একটি বিষয় বিশ্বাসযোগ্য বিবৃতি হিসেবে সাধারণত মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে এবং এর কোনো প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য খুঁজে পাওয়া যায় না।'
গুজবের বৈশিষ্ট্য
১. গুজবের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি সাধারণত কোনো উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি বা ঘটনা সম্পর্কে জনগণ আগ্রহী হয়; অর্থাৎ, সাধারণ ব্যক্তির চেয়ে একজন অসাধারণ ব্যক্তির ক্ষেত্রে মুখরোচক, আনন্দদায়ক, হাস্যকর ঘটনা শীঘ্রই জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
২. গুজবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, গুজবের বিষয়বস্তু গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও তা অস্পষ্ট হয়। এ কারণে গুজবের গল্পটি ছড়াবার সম্ভাবনা অধিক থাকে।
৩. সংকটময় পরিস্থিতিতে গুজব কার্যকরী। অনেক গুজব অতি অল্প সময়ে ছড়াতে দেখা গেছে। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রধান টিক্কা খান ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। ফলে বাঙালিরা টিক্কা খানের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল। এক সময় টিক্কা খান মারা গেছে বলে সংবাদ ছাপা হয়। এ সংবাদ সারা বিশ্বের বাঙালি জাতির মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
৪. জনগণের মধ্যে প্রেষণার তীব্রতা গুজব ছড়াতে উল্লেখযোগ্য উপাদান হিসেবে কাজ করে। তাই সংকটময় পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও প্রবল থাকে বলে মানুষের চাহিদার সামান্যতম অনুকূল ঘটনাও মানুষের মুখে মুখে আকাঙ্ক্ষার পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। তাই বলা যায় গুজব একটি নির্ভরযোগ্য, অস্পষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, তথ্যহীন মুখে মুখে প্রচারিত একটি বক্তব্য।
গুজব ছড়ানোর মাধ্যম
গুজব সাধারণত মানুষের মুখে মুখে ছড়ায়। এছাড়া টেলিফোন, চিঠিপত্র, প্রচারপুস্তিকা, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, বেতার, গ্রন্থ, ইন্টারনেট প্রভৃতির মাধ্যমেও গুজব ছড়ায়। গুজব প্রচারণার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি-বিশেষের বিশেষ উদ্দেশ্যসাধন হয়। অস্পষ্ট ও জটিল পরিস্থিতি গুজবের জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি হয়।
গুজবের শ্রেণিবিভাগ
Allport & Postman (1947) আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত ১০০০টি গুজবকে বিশ্লেষণ করার পর তাদের নিম্নোক্ত শ্রেণিভুক্ত করেন:
- ঈর্যাজনিত গুজব (Hostility Rumour) 66%
- ভীতিজনিত গুজব (Fear Rumour) 25%
- ইচ্ছাজনিত গুজব (Wish Rumour) 2%
- অশ্রেণিভুক্ত (Unclassified) 7%
তাঁরা গুজবের উৎপত্তিগত দিকের প্রতি লক্ষ্য রেখেই এর নামকরণ ও শ্রেণিভুক্তকরণ করেন।
গুজব ছড়ানোর প্রক্রিয়া ও তার মনোবৈজ্ঞানিক উপাদান
কোনো বিষয়ে যখন গুজব ছড়িয়ে পড়তে থাকে তখন কতকগুলো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গুজবের বিষয়বস্তু ও বর্ণনা নানাভাবে বিকৃত হয়।
Allport and Postman-এর মতে তখন তিনটি প্রক্রিয়া লক্ষ করা যায়, যথা:
ক. মসৃণীকরণ (Leveling):
মসৃণীকরণ বলতে মূল বিষয়বস্তু অনেক খুঁটিনাটি বিষয়ের বিবরণের অবলুপ্তি বোঝায়; অর্থাৎ, ক্রমান্বয়ে বর্ণনাটি যখন মুখে মুখে চলতে থাকে তখন বিস্তারিত বিবরণের অনেক তথ্য হারিয়ে যায় এবং কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয় জুড়ে দিয়ে ঘটনাটিকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়।
খ. তীক্ষ্ণকরণ (Sharpening):
তীক্ষ্ণকরণে বিশেষ কয়েকটি বিষয় এই পর্যায়ক্রমিক বর্ণনায় সবিশেষ গুরুত্ব পায় বলে সেগুলো লোকের মুখে মুখে ছড়ানোর সময় বিভিন্ন যুক্তি সংযুক্ত হয়ে অনেক বেশি জোরালো বা তীক্ষ্ণ হয়ে পড়ে; যেমন- সামান্য চুরির ঘটনা অনেক সময় লোমহর্ষক ডাকাতির ঘটনায় রূপান্তরিত হতে পারে।
গ. সুসামঞ্জস্যকরণ (Assimilation):
সুসামঞ্জস্যকরণে ব্যক্তি নিজ প্রেষণা, অভ্যাস, আগ্রহ, ইচ্ছা প্রভৃতির সাথে সংগতিপূর্ণভাবে নতুন শোনা ঘটনাটি বিন্যস্ত করে। এ কারণে প্রকৃত তথ্য অনেকখানি বিকৃত হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে আলপোর্ট এবং পোস্টম্যানের একটি পরীক্ষণ উল্লেখযোগ্য। তাদের পরীক্ষণে ছয়জন পারীক্ষ ছিল। প্রথমে একজন পারীক্ষ ঘরের ভেতর থাকে এবং বাকিরা ঘরের বাইরে অপেক্ষা করতে থাকে। প্রক্ষেপক যন্ত্রের সাহায্যে একটি ছবি পর্দায় প্রক্ষেপ করে ঘরে অবস্থানকারী পারীক্ষকে দেখানো হয়। পারীক্ষকে ঐ ছবি খুব খুঁটিয়ে দেখতে বলা হয় এবং পরে ছবিটি সরিয়ে নেয়া হয়। তখন দ্বিতীয় পারীক্ষকে ঘরে আনা হয় এবং প্রথম পারীক্ষকে তার কাছে প্রদর্শিত ছবির বর্ণনা করতে বলা হয়। তারপর দ্বিতীয় পারীক্ষ, তৃতীয় পারীক্ষের কাছে ঐ শ্রুত ঘটনা বলে। এভাবে ছবিটির বর্ণনা ষষ্ঠ পারীক্ষের কাছে পৌঁছায়। ছবিটিতে দেখানো হয়, বেশ কয়েকজন যাত্রী একটি ট্রলি গাড়িতে বসে; সেখানে কয়েকজন মহিলা ও শিশুও আছে। একজন নিগ্রো ও একজন শ্বেতাঙ্গের মধ্যে কোনো বিষয় নিয়ে তর্ক হচ্ছে বলে মনে হয় এবং শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তির হাতে একটি ক্ষুর জাতীয় জিনিস দেখা যায়। ছবিটির বর্ণনা এক পারীক্ষ থেকে অন্য পারীক্ষে চলতে থাকলে এক পর্যায়ে দেখা যয় ক্ষুর জাতীয় জিনিসটি একটি ধারাল চাকুতে পরিণত হয়েছে এবং তা নিগ্রোর হাতে চলে গেছে এবং ঐ নিগ্রোটি ধারাল চাকু দিয়ে একজন শ্বেতাঙ্গকে আক্রমণ করতে উদ্যত।
প্রকৃতপক্ষে পারীক্ষদের সবাই শ্বেতাঙ্গ ছিল। তাই তাদের বর্ণনায় নিগ্রো সম্বন্ধে তাদের বিশ্বাস ও প্রত্যাশা প্রতিফলিত হয়েছে। নিগ্রোরা উদ্ধত, আগ্রাসী ও দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়, এ বিশ্বাস থেকে তারা বিষয়টি বিকৃতভাবে প্রত্যক্ষ করেছে। এটা হচ্ছে প্রত্যক্ষণের ক্ষেত্রে সুসামঞ্জস্যকরণ (assimilation)-এর ফলশ্রুতি।
আলপোর্ট ও পোস্টম্যান উপযুক্ত তিনটি প্রক্রিয়াকে, একত্রে সরলীকরণ-প্রক্রিয়া (embedding process) বলে অভিহিত করেছে: অর্থাৎ, কোনো উদ্দীপক বা ঘটনাকে সহজবোধ্য ও অর্থপূর্ণভাবে নিজ অভিজ্ঞতা ও আগ্রহের সাথে সুসামঞ্জস্যপূর্ণরূপে একীভূত করার নামই সরলীকরণ-প্রক্রিয়া।
গুজব ছড়ানোর মূলে মনোবৈজ্ঞানিক উপাদানসমূহ
১. প্রেষণা ও প্রক্ষোভ (Motive and Emotion):
গুজব ছড়ানোর পেছনে মানুষের প্রেষণার সংযোগ রয়েছে। অবশ্য গুজব রটনাকারী নিজে মোটেও জানে না কেন বিশেষ ধরনের গুজব তার কাছে এত আকর্ষণীয় এবং কেন সে তা রটানোর জন্য এত উৎসুক হয়ে পড়ে। গুজব রটনাকারী জানে না, সে তার বর্ণিত 'গল্পে' নিজের চিন্তাধারাকে কতটুকু প্রতিফলিত করছে। মনের অবচেতন অংশ থেকে বিশেষ ধরনের প্রেষণা গুজব ছড়ানোর ব্যাপারে কাজ করে থাকে। অনেক সময় দেখা যায় কারো সম্বন্ধে বাজে কথা বা কলঙ্ক ছড়াবার পেছনে রয়েছে যৌনাগ্রহ। ভীতিপ্রদ কাহিনির পেছনে রয়েছে দুশ্চিন্তা ও আতঙ্ক। আশা-ভরসাজনিত আনন্দদায়ক গল্পের পেছনে রয়েছে ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা পূরণের তীব্র বাসনা। গুজব রটনাকারী এমন একটি গল্প গ্রহণ করে যা তাকে তার ভেতরের প্রক্ষোভজনিত চাপ থেকে মুক্তি দিতে পারে এবং যা তার কাছে তার চিন্তা ও কাজের যথার্থতা ও যুক্তিযুক্ততা প্রতিপন্ন করে। এভাবে গুজব রটনাকারী গুজবের মাধ্যমে বিশেষ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে। প্রক্ষোভজনিত চাপ ছাড়াও ব্যক্তি তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার অর্থ খুঁজতে গিয়ে অনেক সময় গুজব ছড়ায়। দুর্বোধ্য পরিস্থিতির অর্থ খুঁজে পাওয়াই একটা শক্তিশালী প্রেষণা হিসেবে কাজ করে থাকে। আবার অনেক সময় শুধু মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্যও অনেকে গুজব ছড়িয়ে থাকে। এ সমস্ত লোক মনে করে একটা নতুন তথ্য পরিবেশন করাটাই কৃতিত্বপূর্ণ এবং তারা প্রমাণ করতে চায় যে, তারা অনেক কিছুই জানে যা অনেকে জানে না। গল্প বলার সময় তারা অন্যের উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে পারছে এটাই তাদের কাছে আনন্দায়ক।
কোন পরিস্থিতিতে গুজব ছড়ায় তা জানার জন্য Schachter and Burdick (1951) একটি সমীক্ষা চালান।
২. গুজব ও অস্পষ্টতা:
নির্দেশ অনুযায়ী একটি শ্রেণিকক্ষে ঢুকে এক ছাত্রীকে নির্দেশ করে বলেন, 'মিস, তুমি তোমার হ্যাট, কোট, বই, তোমার সমস্ত জিনিস নিয়ে এক্ষুনি আমার সাথে এসো; তোমাকে আর ক্লাশ করতে হবে না।' অতঃপর প্রিন্সিপ্যাল আর কোনো কথা না-বলে ছাত্রীটিকে নিয়ে শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন। প্রিন্সিপাল বেরিয়ে যাবার সাথে সাথে দুজন ছাত্রী তাদের সহপাঠিনীদের মধ্যে প্রশ্ন উত্থাপন করল, প্রিন্সিপাল কেন এভাবে ছাত্রীটিকে ডেকে নিয়ে গেলেন। আস্তে আস্তে ক্লাসে একটা গুঞ্জনের সৃষ্টি হয় এবং গুজব ছড়াতে থাকে। যে সমস্ত ছাত্রী ঐ ছাত্রীটির প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন নয় তাদের মতে, মেয়েটি কোনো অন্যায় কাজ করায় প্রিন্সিপাল তাকে শাস্তি প্রদান করবে। অপরটিকে যারা তার প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিল তাদের মতে, প্রিন্সিপাল মেয়েটির কোনো কাজে খুশি হয়ে তাকে পুরস্কৃত করবেন।
৩. গুজব ও পূর্বসংস্কার:
অন্যান্য গণাচরণের মতো গুজব মানুষের সুপ্ত আশঙ্কা ও পূর্বসংস্কার (Prejudice) প্রকাশের সুযোগ ঘটায়। উদাহরণস্বরূপ উইনিক (১৯৬১)-এর উন্মাদ বোমা নিক্ষেপকারী (Mad bomber) সংক্রান্ত গুজবের উদাহরণটি উল্লেখ করা যেতে পারে। নিউইয়র্ক শহরে ১৯৫৬-৫৭ সালের শীতকালে 'Mad bomber' নামে কথিত একজন বোমা নিক্ষ্ণেপকারী সংক্রান্ত গুজব পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, শহরের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জনগণ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বোমা নিক্ষেপকারীকে বর্ণনা করেছে; যেমন-ক্যাথলিক ও ইহুদি সম্প্রদায় বোমা নিক্ষেপকারীকে প্রটেস্ট্যান্ট হিসেবে উল্লেখ করেছে। অবশ্য বেশিরভাগ লোক তাকে বিধর্মী বলে আখ্যায়িত করে; অর্থাৎ, গুজবটিতে বিভিন্ন সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠীর নিজ নিজ পূর্বসংস্কারের প্রতিফলন ঘটেছে।
৪. গুজব ও দুশ্চিন্তা:
গুজব ব্যক্তির মধ্যে দুশ্চিন্তার উদ্রেক করে। এ কারণেই ব্যক্তি তার দুশ্চিন্তা কমানোর জন্য তথ্যটি অন্য ব্যক্তির নিকট সরবরাহ করে; যেমন-যুদ্ধকালীন অবস্থায় যারা যুদ্ধের পক্ষে তারা এক ধরনের গুজব ছড়ায় বা ছড়াতে থাকে। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার সময় দেখা গেছে, যারা স্বাধীনতার পক্ষে ছিল তারা যখন শুনত। মুক্তিযোদ্ধারা শতশত হানাদার ফৌজ খতম করেছে; এ কথা তারা সহজে বিশ্বাস করত এবং যদিও প্রথম দিকে এরূপ সংবাদ ছিল গুজব, তবুও এটি অল্প সময়ের মধ্যে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ত। এটা থেকে বলা যায়, গুজব ব্যক্তির আবেগীয় দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হবার কারণে ছড়ায় এবং এ কারণে গুজব সাধারণত সংকটপূর্ণ ও যুদ্ধকালে বেশি ছড়ায়।
৫. গুজব ও ঈর্ষা:
গুজব ছড়ানোর অন্যতম একটি কারণ হলো ঈর্ষা। ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তি সম্পর্কে অনেক কথা ছড়াতে থাকে। একজন শিক্ষার্থী যদি কঠোর পরিশ্রম করে ভালো ফলাফল করে, তাহলে পরীক্ষায় অকৃতকার্য বন্ধুটি ঈর্ষান্বিত হয়ে তার বন্ধুর ভালো ফলাফলের জন্য শিক্ষকদের স্বজনপ্রীতি বলে ছড়াতে থাকে।
৬. গুজব এবং পূর্বধারণকৃত ধারণা:
গুজব ছড়ানোর আরো একটি মনোবৈজ্ঞানিক উপাদান হচ্ছে পূর্বে ধারণকৃত ধারণা এবং মনোভাব। ব্যক্তি সে ধরনের ঘটনা পছন্দ করে, যে ঘটনা সম্পর্কে পূর্ব থেকে একটি ধারণা এবং মনোভাব তৈরি করে রাখে। Smith (১৯৪৭) একটি অনুধ্যানে কীভাবে কোনো বাক্য গৃহীত হয় তা দেখেন। তিনি রাশিয়ার পক্ষে এবং রাশিয়ার বিপক্ষে একগুচ্ছ বাক্য তার পারীক্ষদের দেন এবং দেখেন যে, পারীক্ষদের যারা রুশপন্থি তারা রাশিয়ার পক্ষের এবং যারা রুশবিরোধী তারা বিপক্ষীয় যুক্তির বাক্যগুলো বিশ্বাস করেছে।
৭. গুজব এবং বেতার মাধ্যম:
Howley (1941) ১,০০০ জন আমেরিকানের উপর অনুধ্যান পরিচালনা করেন, যারা বেতারে প্রচারের মাধ্যমে জানতে পারেন যে, মঙ্গলগ্রহের অধিবাসীদের দ্বারা পৃথিবী আক্রান্ত হবে। এ খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। খবর শোনার পর অনেক ব্যক্তি প্রার্থনা আরম্ভ করেন, কেউ কেউ রক্ষা পাওয়ার জন্য পলায়ন শুরু করেছিল। প্রায় ৬০ লক্ষ ব্যক্তি ভীত হয়েছিল বলে তথ্য পাওয়া যায়। ১৩৫৯ জন ব্যক্তির কাছ থেকে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে জানা হয়, কেন তারা আকস্মিক ভীতির শিকার হয়েছিল। বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ঘটনাটি ছিল বাস্তব ও নাটকীয়। অনেক ব্যক্তি বেতারের এ খবরে বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু গবেষকগণ দেখেন যে, কিছু ব্যক্তি বুঝতে পেরেছিল এবং তারা বেতার প্রচারের আভ্যন্তরীণ যোগাযোগের মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন যে, এটি একটি খেলা ছিল। এভাবে বেতার গণমাধ্যমটি গুজব ছড়াতে সক্ষম হয়েছিল।
উপসংহার
অতএব বলা যায়, গুজবে মানুষ খুব সহজে অন্যের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে পড়ে। তাই শরীফ (১৯৬১)-এর গবেষণা অনুসরণ করে বলা যায়, অস্পষ্ট ও শঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে একটি দলীয় আদর্শমানের সৃষ্টি হয় এবং সেই আদর্শমানে মতানুবর্তিতার (Conformity) মাধ্যমে গুজব সঞ্চালিত হয়।