নিউরনের গঠন ও কার্যাবলী

শরীরের যে অংশ আচরণের ওপর প্রত্যক্ষ প্রভাব বিস্তার করে তা হলো স্নায়ুতন্ত্র। স্নায়ুতন্ত্রের কিছু কোষ পরিবেশ থেকে উদ্দীপনা গ্রহণ করে দেহের বিভিন্ন অংশে সঞ্চালিত করে। এসব কোষই স্নায়ুকোষে পরিণত হয়ে স্নায়ুতন্ত্র গঠন করে। এ স্নায়ুকোষগুলোই নিউরন নামে পরিচিত। এর কার্যাবলি মানব আচরণের ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলে।

নিউরন/স্নায়ুকোষ 

স্নায়ুকোষ নিউরন সমন্বিত যে তন্ত্রের সাহায্যে দেহ বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উদ্দীপকে সাড়া দিতে পারে এবং যার দ্বারা বিভিন্ন দৈহিক ও শারীরবৃত্তীক কার্য একযোগে সামঞ্জ্যপূর্ণভাবে সুনিয়ন্ত্রিত ও সুপরিচালিত হয় তাকে স্নায়ুতন্ত্র বলে।

স্নায়ুতন্ত্রের মৌলিক একক হলো নিউরন। নিউরন স্নায়ুতন্ত্রের নূন্যতম বিভাজ্য অংশ। স্নায়ুতন্ত্রের মধ্যে নিউরনের সংখ্যা অত্যন্ত বেশি। প্রতিটি নিউরনই স্নায়ু প্রবাহ উৎপন্ন ও পরিবহনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। নিউরন হলো একটি আনুষঙ্গিক শাখাবিশিষ্ট কোষ দেহ। 

একটি মস্তিষ্কে কতগুলো স্নায়ুকোষ আছে, সে সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিমাপ না থাকলেও গবেষকগণ মনে করেন যে, মস্তিষ্কের মধ্যে ১০ থেকে ১০০ বিলিয়ন নিউরন থাকতে পারে। এসব নিউরনকে মাইক্রোনিউরন বলা হয়। এক গ্রাম মস্তিষ্কের টিস্যুর মধ্যে গড়ে প্রায় ২০০ মিলিয়ন নিউরন থাকে এবং এগুলোর প্রত্যেকটি আবার সহস্রাধিক অন্যান্য নিউরনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে।

নিউরনের গঠন 

সব নিউরনের গঠন' ও আকৃতি এক রকম নয়। কতকগুলোর দৈর্ঘ্য ও ঘনত্ব এতই ছোট যে, দেখার জন্যে শক্তিশালী অনুবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়োজন হয়, আবার কতকগুলো তিন ফুট পর্যন্ত লম্বা হয় কিন্তু ঘনত্ব পর্যাপ্ত নয় বলে খালি চোখে দেখা যায় না। প্রত্যেকটি নিউরন একটি বহিরাবরণযুক্ত তারের মতো এবং প্রতিটি কোষেরই রাসায়নিক স্নায়ুপ্রবাহ উৎপন্ন ও পরিবহন করার ক্ষমতা আছে।

সাধারণত নিউরনের তিনটি অংশ থাকে: 

১. কোষদেহ, ২. এক্সন, ৩. ডেনড্রাইটস।

নিম্নে নিউরনের তিনটি অংশের আলোচনা করা হলো:

চিত্রঃ নিউরন বা স্নায়ুকোষ

১. কোষদেহ (Cell body): 

এটি নিউরনের প্রধান অংশ। নিউরনের যে অংশে তার নিউক্লিয়াস অবস্থান করে তাকে কোষদেহ বলে। সাধারণত নিউরনে একটি মাত্র নিউক্লিয়াস দেখা পেলেও একাধিক নিউক্লিয়াসযুক্ত নিউরনের উপস্থিতিও দেখা যায়। কোষদেহ নিউরনের প্রোটোপ্লাজম সমন্বিত গোলাকার, তারকাকার, ডিম্বাকার, বহুভুজাকার ইত্যাদি নানা আকারের হয়ে থাকে। কোষদেহের ব্যাস ৫ হতে ১২০ মাইক্রন পর্যন্ত হয়। 

কোষদেহ তিনটি অংশ নিয়ে গঠিতঃ 

কোষঝিল্লী, সাইটোপ্লাজম ও নিউক্লিয়াস।

ক. কোষঝিল্লী: এটি সুস্পষ্ট ও কোষদেহকে আবৃত করে রাখে। এটি লাইপোপ্রোটিন দ্বারা গঠিত। একটি কোষঝিল্লীর ওপরই স্নায়ুপ্রবাহ নির্ভর করে।

খ. সাইটোপ্লাজম: নিউক্লিয়াসের চারপাশে অপেক্ষাকৃত তরল পদার্থকে বলা হয় সাইটোপ্লাজম। এর তন্ত্রময় ও দানাদার সাইটোপ্লাজমে নিম্নলিখিত উপাদানগুলো বিদ্যমান:

  1. মাইটোকনড্রিয়া (Mitochondria): কোষদেহে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দণ্ডাকার বা দানাদার মাইটোকনড্রিয়া বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকে। এটি সমগ্র স্তন অক্ষে বিস্তৃত থাকে।
  2. গলগি বডি (Golgibody): এরা জটিল এবং নিউরনে অধিকতর বিকাশ লাভ করে।
  3. সেন্ট্রোসোম (Centrosome): পরিণত নিউরনে সেন্ট্রোসোম থাকে না। ফলে স্নায়ুকোষের বিভাজনও হয় না।
  4. রাইবোসোম (Ribosome): কোষদেহের অক্ষস্তূপ অংশ ছাড়া এটি সাইটোপ্লাজমের অন্যত্র অসংখ্য বিদ্যমান। 
  5. নিসল দানা (Nissl grumbles): সাইটোপ্লাজমে অসংখ্য ক্ষারাসক্ত দানার উপস্থিতি দেখা যায়। এটিই নিসল দানা।

গ. নিউক্লিয়াস: কোষদেহের মধ্যে অবস্থিত অপেক্ষাকৃত ঘন গোলাকার বা ডিম্বাকার পিণ্ডকে বলা হয় নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসের মধ্যে কতকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাসমান পদার্থকে নিউক্লিওলাই বলা হয়।

২. এক্সন (Axon): 

স্নায়ুকোষের সাথে সংলগ্ন লম্বা তন্ত্রটিকে বলা হয় এক্সন। এক্সন কোষপ্রাচীর থেকে বেরিয়েছে। এটি একটি লম্বা সরু তন্ত্র বিশেষ। এক্সন সাধারণত পেশী বা গ্রন্থি অথবা অন্য কোনো বার্তা গ্রহণকারী নিউরনের সাথে যুক্ত। নিউরন একটি বিশেষ ধরনের শাখা-প্রশাখা যুক্ত কোষ। সাধারণত একটি নিউরনের একটাই এক্সন থাকে। এক্সনের দৈর্ঘ্য বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। কোনো কোনো এক্সন এক ইঞ্চির এর চেয়েও ছোট আবার কোনো কোনো এক মিটার অপেক্ষা দীর্ঘও হতে পারে। 

এক্সেনের গায়ে দুটি বিশেষ আবরণ থাকে-

ক. মায়েলিন আবরণ, খ. নিউরিলেমা আবরণ।

ক. মায়েলিন আবরণ (Myellin sheath): কোষদেহ হতে বের হওয়ার কিচু পরে স্নায়ুতন্ত্র একটি স্নেহ পদার্থের আবরণে আবৃত হয়। এটিই মায়েলিন সিথ। মায়েলিন সিথ একটি নিরবচ্ছিন্ন আবরণ নয়। স্থানে স্থানে সঙ্কুচিত ও রেনভিয়ারের (Nodes of Ranvier) গ্রন্থি দ্বারা বিচ্ছিন্ন। অবশ্য সব স্নায়ুতন্ত্রতেই এই বহিরাবণ নেই। যেসব স্নায়ুতে বহিরাবহরণ নেই সেগুলো ধূসর বর্ণের দেখায়।

খ. নিউরিলেমা (Neurilemma): স্নায়ুতন্ত্রের মায়েলিন সিথের উপর দিয়ে আর একটি পাতলা পর্দার আবরণ থাকে যাকে বলা হয় নিউরিলেমা। নিউরিলেমা নিউরন এর পুনর্গঠনে সাহায্য করে। যেসব স্নায়ুতস্তুতে এ আবরণ নেই সেসব স্নায়ু একবার ক্ষতিগ্রস্থ বা নষ্ট হয়ে গেলে আর নতুন করে গঠিত হয় না। এক্সনের শেষ প্রান্তটি কয়েকটি ছোট মাথায় বিভক্ত। এগুলোকে যুক্তভাবে বলা হয় প্রান্তগুচ্ছ। এসব প্রান্ত গুচ্ছ একটি নিউরনের সাথে অন্য নিউরনের সংযোগ স্থাপন করে।

৩. ডেনড্রাইটস (Dendrites): 

ডেনট্রাইট হলো কোষপাত্রের সাথে সংলগ্ন সরু কতকগুলো চুল বা আঁশ। এগুলো সংখ্যায় বহু এবং কোষদেহের সন্নিকটেই বহু শাখা-প্রশাখাসহ একটি গুল্ম তৈরি করে শেষ হয়। সাধারণত ডেনড্রাইটগুলো উদ্দীপনা গ্রহণ করে এবং কোষদেহে তা প্রেরণ করে। ডেনড্রাইটগুলোর কোনো আবরণ নেই। ডেনড্রাইট হলো নিউরনের গ্রহণকারী প্রান্ত।

নিউরন বা স্নায়ুকোষের কার্যাবলি 

কার্যানুসারে স্নায়ুকোষকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়:

১. সংবেদী বা অন্তর্মুখী স্নায়ুকোষ: এই স্নায়ুকোষগুলোর কাজ হলো শরীরের বিভিন্ন ইন্দ্রিয় থেকে সংবেদন বা উদ্দীপনা বহন করে মস্তিষ্কে নিয়ে আসা। 

২. গতিবাহী বা বহির্মুখী স্নায়ুকোষ: গতিবাহী স্নায়ুকোষের কাজ হলো মস্তিষ্কে উৎপন্ন স্নায়ুপ্রবাহ বহন করে মাংসপেশি বা গ্রন্থিসমূহে নিয়ে যাওয়া। গতিবাহী বা বহির্মুখী স্নায়ুকোষকে কার্যকারিতার দিক থেকে নিম্নলিখিত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়:

  1. গতিবাহী স্নায়ুকোষ: এ ধরনের স্নায়ুকোষ মাংশপেশির সাথে যুক্ত থেকে পেশির সংকোচন নিয়ন্ত্রণ করে।
  2. ক্ষরণশীল স্নায়ুকোষ: ক্ষরণশীল স্নায়ুকোষ গ্রন্থির সাথে সংযুক্ত থেকে গ্রন্থিকে রাসায়নিক পদার্থ ক্ষরণে উত্তেজিত করে।
  3. কার্যবর্ধক স্নায়ুকোষ: এ সকল স্নায়ুকোষ অভ্যন্তরীণ যন্ত্রমণ্ডলীর সাথে সংযুক্ত থেকে ইন্দ্রিয়সমূহের কাজ ত্বরান্বিত করে। 
  4. অবদমনকারী স্নায়ুকোষ: এ ধরনের স্নায়ুকোষ মাংসপেশি বা গ্রন্থির কাজকে অবদমন করে।

সংযোজক স্নায়ুকোষ

এই স্নায়ুকোষগুলো কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ভেতরে অবস্থান করে এবং অন্তর্মুখী স্নায়ুকোষের সাথে বহির্মুখী স্নায়ুকোষের সমন্বয় ও সংযোগ স্থাপন করে।

উপসংহার

উদ্দীপনা গ্রহণ ও প্রেরণ করা এবং দেহের একাংশ থেকে অপরাংশে উদ্দীপনাকে পরিবাহিত করার ব্যাপারে নিউরনগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো পরিবহন ক্ষমতা। এসব নিউরন ব্যক্তির কাজকর্ম ও চিন্তন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের দেহের সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় অংশ স্নায়ুতন্ত্রকে বুঝতে হলে এর ক্ষুদ্রতম অংশ নিউরনকে প্রথমে জানতে হবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url