সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়াসমূহ
মানুষ সামাজিক জীব। মানুষের চাল-চলন অন্যান্য প্রাণী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এ জন্যই মানুষ অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের গুণে মানবজাতি হিসেবে বিবেচিত। অন্যান্য প্রাণী যেখানে জন্মের পরই স্বীয় কর্মের অনুশীল করে, মানুষ তা পারে না। একটি মানবশিশু জন্মের পর থেকে ধাপে ধাপে চলাফেরা, আচার-আচরণ, রীতিনীতি, কৃষ্টি ইত্যাদি আয়ত্ত করতে শেখে। একেই সমাজবিজ্ঞানে সামাজিকীকরণ বলে।
সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া
সামাজিকীকরণ মূলত এক ধরনের শিক্ষণ-প্রক্রিয়া যা কোনো ব্যক্তিকে সমাজে বসবাস করার উপযোগী করে গড়ে তোলে। সামাজিকীকরণ-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষ প্রাণী সামাজিক জীবে এ পরিণত হয়। সামাজিকীকরণ হলো অনেকগুলো শিক্ষণ-প্রক্রিয়ার সমন্বিত রূপ যা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চলতে থাকে। নিম্নে সেগুলো বর্ণনা করা হলো:
১. করণশিক্ষণ:
করণ-শিক্ষণের মূলনীতি হলো, যখন একটি স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক বা পুরস্কারসূচক বলবর্ধকের দ্বারা সমর্থিত হয় তখন শিক্ষণের বৃদ্ধি ঘটে। এই বলবর্ধন দুধরনের হতে পারে- স্বেচ্ছাকৃত প্রতিক্রিয়া পুরস্কার উদ্দীপকের দিকে ধাবিত হতে পারে অথবা এটি শাস্তিমূলক উদ্দীপকের প্রতি প্রতিরোধ তৈরি করতে পারে। কোনো প্রতিক্রিয়া যখন পুরস্কৃত হয় এবং তার ফলে সামাজিক আচরণে ঐ প্রতিক্রিয়াটির পুনঃরুদ্রেকের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায় তখন একে ইতিবাচক বলবর্ধক বলা হয়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, একটি পরিবারে একটি শিশু পিতার মতো ব্যক্তিকে ভক্তি করে এবং চাচা বলে সম্বোধন করে সালাম করে এবং মাতার মতো ব্যক্তিকে ভক্তি করে খালা বলে সম্বোধন করে সালাম জ্ঞাপন করে। তার এই আচরণে পিতামাতার সন্তুষ্টি হয়ে যখন শিশুকে আদর করেন, তখন শিশুর এই আচরণটি পুরস্কৃত হওয়ার ফলে পরবর্তীকালে এই ধরনের আচরণ করার স্পৃহা বৃদ্ধি পায়।
অন্যদিকে তার সমবয়স্ক প্রতিবেশীর শিশুর সাথে যখন শিশুটি খারাপ আচরণ করে, সে সময় তার পিতামাতা বিরক্তি প্রকাশ করেন। পিতামাতার এই বিরক্তি প্রকাশ শিশুর নিকট শাস্তিমূলক হওয়ার কারণে ভবিষ্যতে সে ঐ ধরনের আচরণ করা থেকে বিরত থাকবে এবং ঐ আচরণটি করবার সম্ভাবনা কমে যাবে।
এভাবেই সহায়ক শিক্ষণ একটি শিশুর সামাজিক আচরণে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক বলবর্ধনের মাধ্যমে সামাজিকীকরণে সহায়তা প্রধান করে।
এভাবে শিশু সামাজিক আন্তঃক্রিয়া থেকে অভিপ্রেত কাজ করার অনুপ্রেরণা পায় এবং অনঅভিপ্রেত কাজ করা থেকে বিরত থাকে।
বি. এফ. স্কিনার এই প্রক্রিয়াকে 'Shaping বা 'ক্রম রূপায়ণ' বলে আখ্যায়িত করেছেন।
২. প্রেষণালব্ধ ও প্রাসঙ্গিক শিক্ষণ:
একজন শিশু বা ব্যক্তি যখন কোনো কিছু ইচ্ছাকৃতভাবে শেখে এবং এ শিক্ষণের ফলে তার আচরণে পরিবর্তন ঘটে, এধরনের শিক্ষণকে প্রেষণালব্ধ শিক্ষণ বলা হয়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, পিতামাতা তার শিশুকে প্রাত্যহিক জীবনে অনেক কিছু শিক্ষা দান করেন। যেমন- প্রত্যুষে বিছানা থেকে উঠে হাত-মুখ ধোয়ার অভ্যাস, পোশাকআশাক পরিবর্তন, ফজরের নামাজ আদায়, সংগীত শিক্ষার ক্ষেত্রে সুর সাধন ইত্যাদি। এগুলো সবই প্রেষণালব্ধ শিক্ষণ।
অন্যদিকে একজন শিশুকে তার পিতামাতা ইচ্ছাকৃতভাবে শেখান না অথচ তা শিশু শিখে ফেলতে পারে; যেমন- কোনো অতিথি বাসায় এলে বাবা-মা তার আদর-যত্ন করেন। ঐ গৃহে অবস্থানরত শিশু বাবা-মায়ের আদর আপ্যায়ন করার পদ্ধতি অনিচ্ছাকৃতভাবেই শিখে ফেলে। দৈনন্দিন জীবনে এ ধরনের শিক্ষণকে প্রাসঙ্গিক শিক্ষণ বলে। এই প্রাসঙ্গিক শিক্ষণের কারণে, শিশুর সামাজিক শিক্ষণে অনেরক পরিবর্তন বা পরিবর্ধন হতে পারে।
এমন অনেক কিছু আমরা সামাজিক পরিবেশ থেকে শিখে থাকি যা আমাদের মা, বাবা বা অন্য কেউ (যাঁরা সামাজিকীকরণ মাধ্যম হিসেবে রয়েছে) অনুমোদন করেন না। উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক একটি শিশু তার আধো আধো বুলিতে একটি নিষিদ্ধ শব্দ উচ্চারণ করল। তার এই আদো বুলিতে এমন কিছু ছিল যাতে আশপাশের বড়োরা সবাই হেসে উঠল। এখানে যদিও আচরণটিকে ইচ্ছাকৃতভাবে পুরস্কৃত করা হয়নি কিন্তু এই হাসি শিশুর ঐ আচরণটিকে পুরস্কৃত করল। এর ফলে শিশুটি পরবর্তীকালে বড়োদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে ঐ শব্দটি পুনরায় উচ্ছারণ করতে পারে যাতে করে সে পুরস্কৃত হতে পারে। এভাবে বাবা-মা শিশুকে শেখাতে চান না এমন করে সে কিছু শিশু প্রাসঙ্গিকভাবে শিখে ফেলতে পারে। সামাজিকীকরণে প্রাসঙ্গিক শিক্ষণের গুরুত্ব অন্য যে কোনো শিক্ষণ-প্রক্রিয়ার তুলনায় কোনো অংশে কম নয়।
৩. সরাসরি শিক্ষাদান:
শিশুর সামাজিকীকরণে সরাসরি শিক্ষাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সরাসরি শিক্ষাদানে ব্যক্তির করণীয় কাজ সম্বন্ধে মৌখিক নির্দেশ দেয়া হয়। এ মৌখিক নির্দেশ মোতাবেক কাজ করার পর ব্যক্তিকে পুরস্কৃত করা হয় এবং মৌখিক নির্দেশ অনুযায়ী কাজ না-করলে শাস্তি দেওয়া হয়। এরূপ সরাসরি শিক্ষাদান সামাজিক আচরণ শিক্ষণে যথেষ্ট সহায়ক।
৪. আদর্শ মডেলের মাধ্যমে শিক্ষণ:
সামাজিক শিক্ষণ-প্রক্রিয়ায় শিশু তার সামাজিক পরিবেশে অবস্থিত ব্যক্তিদের আচরণকে মডেল হিসেবে গ্রহণ এবং সে সব আচরণকে অনুকরণ ও অনুসরণ করে থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুরা তাদের মা-বাবা, ভাই-বোনকে মডেল হিসেবে গ্রহণ করে থাকে এবং তাদের আচরণ অনুসরণ করে। পরবর্তীকালে স্কুলের শিক্ষক, চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকা, বিখ্যাত গায়ক-গায়িকা অথবা নামকরা খেলোয়াড়দের মডেল হিসেবে গ্রহণ করে এবং তাদের আচার-আচরণ, পোশাক, চুলের স্টাইল ইত্যাদি অনুকরণ করে। মনোবিজ্ঞানীরা অনুকরণের ব্যাখ্যা হিসেবে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষণ-প্রক্রিয়ার বর্ণনা উপস্থাপন করেছেন। এগুলোর মধ্যে পর্যবেক্ষণ-শিক্ষণ, একাত্মীভবন এবং ভূমিকা-শিক্ষণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায় যে, ব্যক্তির সামাজিকীকরণ উপর্যুক্ত কতগুলো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয় এবং এর মাধ্যমে ব্যক্তি একটি গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।