সামাজিকীকরণ সংজ্ঞা ও প্রক্রিয়া

সামাজিকীকরণ হলো ব্যক্তির সমাজের প্রত্যাশিত আচরণ শিক্ষা-প্রক্রিয়া। ব্যক্তির সামাজিকীকরণ মূলত কয়েকটি মৌলিক শিক্ষণের মাধ্যমে, অর্থাৎ, কয়েকটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। যেসব শিক্ষণ-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তির সামাজিকীকরণ সম্পন্ন হয় তাকে সামাজিকীকরণ-প্রক্রিয়া বলে।

সামাজিকীকরণ 

বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানিগণ সামাজিকীকরণ শব্দটিকে বিভিন্ন অর্থে ব্যহার করেছেন। সামাজিকীকরণ পদটি ব্যক্তিকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জগতে পরিচিত হওয়ার প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

সাধারণত অর্থে সামাজিকীকরণ বলতে ব্যক্তি কর্তৃক সমাজের কতগুলো প্রচলিত রীতি-নীতি, সামাজিক আদর্শ, মূল্যবোধ, মনোভাব, বিশ্বাস ইত্যাদি নিজের মধ্যে আত্মস্থ করার প্রক্রিয়াকে বোঝায়। সামাজিকীকরণ মানুষের একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। জন্মের পর থেকে মানুষের সামাজিকীকরণ শুরু হয়, যা মৃত্যুর মাধ্যমে শেষ হয়।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা 

সামাজিকীকরণ সম্পর্কে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। তার মধ্যে কয়েকটি সংজ্ঞা নিচে তুলে ধরা হলো-

ম্যাকাইভার (Maclver)-এর মতে, 

'সামাজিকীকরণ এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে অন্যান্যের সাথে বৃহত্তর ও গভীরতর সম্পর্ক গড়ে তোলে যেখানে তারা নিজের এবং অন্য ব্যক্তির সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। আর এভাবেই নিকটবর্তী ও বৃহত্তর সংঘের জটিল কাঠামোর বিকাশ ঘটে।'

বোগারডাস (Bogardus)-এর মতে, 

'সামাজিকীকরণ হচ্ছে একত্রে কাজ করার এটি প্রক্রিয়া, বিশেষত যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তার গোষ্ঠীগত দায়িত্বের প্রকাশ ঘটায় এবং এর মাধ্যমে সে সমাজের মঙ্গলচিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়।'

গিলিন এবং গিলনি (Gillin and Gillin) বলেছেন,

'সামাজিকীকরণ বলতে আমরা এমন একটি প্রক্রিয়াকে বুঝি, যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি একটি গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে তার মূল্যবোধ, মানদণ্ড ও ঐতিহ্য অনুসারে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। আর এভাবে সে নিজেকে সামাজিক অবস্থানের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়।'

কিম্বল ইয়ং (Kimball Young)-এর মতে, 

'সামাজিকীকরণ বলতে একজন ব্যক্তিকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জগতে অধিষ্ঠিত করাকে বোঝায়। এর মাধ্যমে সে সমাজ ও অন্যান্য গোষ্ঠীর সদস্য পদ অর্জন করে এবং সে যে সমাজে জন্মগ্রহণ করে সে সমাজের মূল্যবোধ ও আদর্শ আয়ত্ত করে।'

সামাজিকীকরণ-প্রক্রিয়া 

যেসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একজন ব্যক্তির সামাজিকীকরণ সম্পূর্ণ হয় তা হলো-

১. সহায়ক শিক্ষণ: 

শিশুর আচরণ পরিবর্তনের জন্য বলবর্ধক প্রদান করাই সামাজিক শিক্ষণের মূল উদ্দেশ্য। কারণ বলবর্ধক দিলে মানুষের আচরণ দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। এটি দুধরনের হতে পারে-ইতিবাচক ও নেতিবাচক। শিশু তার কাজের জন্য যখন পুরস্কৃত হয় তখন সে তার কাজের জন্য উৎসাহ পায়, একে ইতিবাচক বলবর্ধক বলা হয়। আবার যখন সে বাধাপ্রাপ্ত হয় তখন সে কাজের জন্য নিরুৎসাহিত হয়। এর মাধ্যমে শিশুর সহায়ক শিক্ষণ-প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

২. অনুকরণ: 

মানবশিশু জন্মের পর অনুকরণের মাধ্যমে অনেক কিছু শিক্ষালাভ করে। মানবশিশু তার আশপাশে যা কিছু দেখে তা অনুকরণের মাধ্যমে শেখে। যেমন একটি শিশু তখন বলে লাথি দেয় যখন সে কাউকে তা করতে দেখে। আর পরিবার থেকেই এ ধরনের সামাজিকীকরণ শুরু হয়।

৩. ভূমিকা-শিক্ষণ: 

ব্যক্তি সমাজের বিভিন্ন অবস্থানে অন্যান্য ব্যক্তির আচরণ, অনুভূতি, মেজাজ প্রভৃতি আচরণ শেখে এবং সেই ভূমিকাই অন্যান্যরা যেভাবে পরিবেশকে উপলব্ধি করে ঠিক একইভাবে শিশু তার পরিবেশকে পর্যবেক্ষণ করে। সমাজে কাজ করতে গিয়ে মানুষকে বিভিন্ন ভূমিকাতে আবর্তিত হতে হয়। আর বিভিন্ন ভূমিকাতে কাজ করতে গিয়ে আমরা সহজেই বিভিন্ন ধরনের আচরণ শিখি।

৪. পর্যবেক্ষণ-শিক্ষণ: 

সাধারণ শিশুরা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অন্যের আচার-ব্যবহারকে অনুসরণ করে; যেমন- শ্রেণিকক্ষে একটা ছাত্র নিয়মিত ভালো কাজ করলে তাকে দেখে অন্যান্যরাও অনুপ্রাণিত হয়, যা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে।

৫. একাত্মীভাবন: 

একাত্মীভাবন এমন একটি শিক্ষণ-প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলিকে নিজের বৈশিষ্ট্য বলে মনে করে। তবে অনুসরণ ও একাত্মীভাবন এক বিষয় নয়। অনুসরণ হলো অন্যকে অনুকরণ করে। কিন্তু একাত্মীভাবনের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজেকে তার মতো মনে করে।

৬. সরাসরি শিক্ষাদান: 

সরাসরি শিক্ষাদান শিশুর সামাজিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সরাসরি শিক্ষাদান ব্যক্তির করণীয় সম্বন্ধে মৌলিক নির্দেশনা প্রদান করে। এ মৌলিক নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করার পর ব্যক্তিকে পুরস্কৃত করা হয়। এরূপ সরাসরি শিক্ষাদান সামাজিকীরকণে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে।

৭. কারণ-শিক্ষণ: 

কারণ-শিক্ষণের মূল বক্তব্য হলো-প্রাণীর যে আচরণটি সন্তুষ্টি লাভের কারণ হয় সে আচরণটি করার প্রবণতা তার বেড়ে যায়। কারণ শিক্ষণ শিশুরা সামাজিকীকরণের বিশেষভাবে কাজ করে; যেমন একটি শিশুর ভালো কাজ তা যদি অন্যের কাছে ভালো লাগার কারণ হয় তবে বড়োরা তার জন্য প্রশংসাসূচক অভিব্যক্তি করে। ফলে শিশুর কাজের প্রবণতা বেড়ে যায়। আবার শিশু অপ্রত্যাশিত আচরণ করলে, যেমন গালি দিলে তাকে তিরস্কার করা হয়। ফলে তর আচরণ করার প্রবণতা হ্রাস পায়।

৮. প্রাসঙ্গিক শিক্ষণ: 

এমন অনেক আচরণ আমরা করে থাকি যা আমাদের মা-বাবা প্রত্যাশা করে না, যেমন আধো আধো বুলিতে কোনো শিশু যদি কোনো নিষিদ্ধ শব্দ উচ্চারণ করে তার পাশের সকলে হেসে ওঠে।। যদিও তার এই প্রশংসা ইচ্ছাকৃতভাবে পুরষ্কৃত হয়নি। কিন্তু সকলের হাসি শিক্ষার আচরণটিকে পুরষ্কৃত করল। এর ফলে শিশু পরবর্তীকালে আবার শব্দটি উচ্চারণ করতে পারে।

৯. আদর্শ প্রতীকের মাধ্যমে শিক্ষণ: 

সামাজিকীকরণে সামাজিক শিক্ষণ-প্রক্রিয়ায় শিশু তার সামাজিক পরিবেশে অবস্থিত ব্যক্তিদের আচরণ আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। শিশুরা তাদের মা-বাবা-ভাই-বোনদেরকে প্রাথমিক আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। এরপরও শিশু শিক্ষক, শিক্ষিকা, নায়ক, নায়িকা ও খেলোয়াড়কেও আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। তাদের আচার-আচরণ, পোশাক, চুলের স্টাইল ইত্যাদি অনুসরণ করে।

উপসংহার 

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তির সামাজিকীকরণ সম্পূর্ণ হয়। এদের একটি প্রক্রিয়ার অনুপস্থিতিতে ব্যক্তির সামাজিকীরণ সম্পূর্ণ হয় না। সুষ্ঠু সামাজিকীকরণ ব্যক্তির মর্যাদাকে বাড়িয়ে দেয়। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই ব্যক্তি সামাজিক জীবে পরিণত হয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url