সমাজ মনোবিজ্ঞান মৌলিক বিজ্ঞান, নাকি ফলিত বিজ্ঞান
সমাজ মনোবিজ্ঞান সামাজিক বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের অংশ হিসেবে মানুষের মানবিক বিষয়াবলির বিজ্ঞানসম্মত অধ্যয়ন করে থাকে। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ একে অন্যের সাথে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার লিপ্ত হওয়ায় এবং এ ধরনের ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়ায় যে আচরণের সৃষ্টি হয় সমাজ মনোবিজ্ঞান তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে। ব্যক্তির সামাজিক আচরণ এর বিষয়বস্তু। ব্যক্তির সামাজিক আচরণকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে অধ্যয়ন করে বলে একে বৈজ্ঞানিক মর্যাদা দান করা হয়েছে।
সমাজ মনোবিজ্ঞান মৌলিক বিজ্ঞান, না ফলিত বিজ্ঞান
কোনো বিজ্ঞানকে তখনই মৌলিক বিজ্ঞান বলা যায়, যখন এর একটি পর্যবেক্ষণযোগ্য বিষয়বস্তু থাকে এবং সেই বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করার জন্য কতিপয় নীতিমালা থাকে। অপরদিকে, কোনো বিজ্ঞানকে তখনই ফলিত বিজ্ঞান বলা যায় যখন ব্যবহারিক জীবনে এটি কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে। এ সংজ্ঞায়নের আলোকেই বিচার করা যাবে সমাজ মনোবিজ্ঞান আসলে মৌলিক বিজ্ঞান, না ফলিত বিজ্ঞান। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
মৌলিক বিজ্ঞান হিসেবে সমাজ মনোবিজ্ঞান
সমাজ মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হলো ব্যক্তির সামাজিক আচরণ, জীবনযাত্রা ইত্যাদি।
ব্যক্তিত্ব পারস্পরিক আচরণ; যেমন- মনোভাব, পারস্পরিক আকর্ষণ, নেতৃত্ব, মতানুবর্তিতা ইত্যাদি সকল আচরণই পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপযোগ্য। সমাজ মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু সম্বন্ধে প্রকল্প প্রণয়ন করা হয় এবং এরূপ প্রকল্পকে প্রমাণসাপেক্ষ করার জন্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। প্রমাণসাপেক্ষ উপাত্তগুলোকে যেকোনো নিয়মের নিয়ন্ত্রণাধীনে ফেলা যায় এবং এর মাধ্যমে উপাত্তগুলোকে নিয়মসাপেক্ষ করা হয়। অন্যদিকে, যে বিজ্ঞানের একটি পর্যবেক্ষণযোগ্য বিষয়বস্তু থাকে এবং সেই বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করার জন্য কতকগুলো নীতি বা মতবান থাকে তারে মৌলিক বিজ্ঞান বলে। এসব বিবেচনা করে বলা যায়, সমাজ মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু বিজ্ঞানসম্মত এবং সমাজ মনোবিজ্ঞানিগণ বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে এ বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে থাকেন। তাই সমাজ মনোবিজ্ঞানকে নিঃসন্দেহে একটি মৌলিক বিজ্ঞান বলা যায়। সামাজিক আচরণের ব্যাখ্যা প্রদানের ক্ষেত্রে সমাজ মনোবিজ্ঞানিগণ সাধারণ মনোবিজ্ঞানের তথ্যের উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল।
উদাহরণস্বরূপ, পারস্পরিক আচরণ পর্যালোচনা করতে হলে সমাজ মনোবিজ্ঞানীকে ব্যক্তির চাহিদা, প্রত্যক্ষণ, শিক্ষণ প্রভৃতি মৌলিক আচরণ সম্বন্ধে জানতে হয়। এসব আচরণের নীতি বা সূত্রগুলো ব্যক্তির সামাজিক আচরণ বুঝতে সহায়তা করে। সমাজ মনোবিজ্ঞজ্ঞানিগণ গবেষণাগার থেকে ল্য আচরণ সম্বন্ধীয় মৌলিক নীতিগুলো সামাজিক আচরণের ক্ষেত্রে অর্থপূর্ণভাবে প্রয়োগ করেন। এভাবে বিভিন্ন সামাজিক আচরণের ব্যাখ্যা, মৌলিক আচরণ সম্বন্ধে বহু নীতি এবং মূত্রবান সমাজ মনোবিজ্ঞানকে একটি মৌলিক বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
এছাড়াও নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করে সমাজ মনোবিজ্ঞানের মৌলিকত্ব প্রমাণ করা যায়:
১. পর্যবেক্ষণযোগ্য বিষয়বস্তু:
যে বিজ্ঞানের নিজস্ব পর্যবেক্ষণযোগ্য বিষয়বস্তু থাকে তাকে মৌলিক বিজ্ঞান বলা যায়। পদার্থ, রসায়ন, জীববিদ্যা, ভূতত্ত্ব, প্রাণিবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা ইত্যাদি মৌলিক বিজ্ঞানের ন্যায় সমাজ মনোবিজ্ঞানের একটি পর্যবেক্ষণযোগ্য বিষয়বস্তু হলো 'আচরণ'। এ কারণে সমাজ মনোবিজ্ঞানকে মৌলিক বিজ্ঞান বলা যায়।
২. প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব:
প্রতিটি বিজ্ঞানেরই বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করার জন্য প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব থাকা আবশ্যক। সমাজ মনোবিজ্ঞানেও তেমনি কতকগুলো প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব রয়েছে। এগুলো হচ্ছে-সামাজিক শিক্ষণ এবং অনুকরণ, সামঞ্জস্যহীনতা তত্ত্ব, মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব, দলীয় প্রক্রিয়াকরণ তন্ত্র, প্রেষণা তত্ত্ব, অবহিতিমূলক তত্ত্ব। এসবের বিচারে সমাজ মনোবিজ্ঞানকে মৌলিক বিজ্ঞান বলা যায়।
৩. তথ্য সংগ্রহের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি:
অন্যান্য মৌলিক বিজ্ঞানের ন্যায় সমাজ মনোবিজ্ঞানের তথ্য সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যেমন--পরীক্ষণ পদ্ধতি, পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি, প্রশ্নমালা পদ্ধতি, জরিপ পদ্ধতি, ক্ষেত্র অনুসন্ধান পদ্ধতি ইতাদি। এসব পাতির মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক উপায়ে' তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণের মাধ্যমে ফলাফল অর্জনের কারণে সমাজ মনোবিজ্ঞানকে মৌলিক বিজ্ঞান বলা যায়।
৪. বিষয়বস্তু নির্বাচন:
মৌলিক বিজ্ঞানের দাবিদার বিজ্ঞানগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো বিষয়বস্তু নির্বাচন, যার দাবিদার একমাত্র সেই শাখাটিই হবে। তেমনিভাবেই সমাজ মনোবিজ্ঞানও ব্যক্তির আচরণকে বিষয়বস্তু হিসেবে নিয়ে বিশ্লেষণ ও অনুধ্যান করে থাকে। এছাড়াও সমাজ মনোবিজ্ঞান একজন ব্যক্তিকে সামাজিক মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করে থাকে। এ কারণেই সমাজ মনোবিজ্ঞানকে ব্যক্তির আচরণের মৌলিক বিজ্ঞান হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।
ফলিত বিজ্ঞান হিসেবে সমাজ মনোবিজ্ঞান
আমাদের সমাজজীবন তথা ব্যবহারিক জীবনে অপরাধ, পূর্বসংস্কার, আন্তদলীয় সন্ত্রাস, বিবাহ-বিচ্ছেদ ইত্যাদি নানাবিধ সমস্যা রয়েছে। সমাজের এসব সমস্যার প্রতি সমাজ মনোবিজ্ঞানিগণ উদাসীন থাকেন না। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের পর্যালোচনা করতে গিয়ে তারা বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধানের পথ বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে খুঁজতে চেষ্টা করেছেন। তাই সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য সমাজ মনোবিজ্ঞানিগণ একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিভিন্ন উপায় নির্দেশ করে থাকেন। তাদের এরূপ প্রচেষ্টার ফলশ্রুতি হলো ফলিত সমাজ মনোবিজ্ঞান। কেননা যে বিজ্ঞান প্রাত্যহিক জীবনে গঠনমূলক, ফলপ্রসু ও কার্যকর ভূমিকা পালন করে সেই বিজ্ঞানকেই ফলিত বা প্রায়োগিক বিজ্ঞান বলা হয়।
উদাহরণ হিসেবে কিশোর অপরাধের কথাই ধরা যাক, এখানে সমাজ মনোবিজ্ঞানীর কাজ হবে একজন কিশোর কেন অপরাধী হয় তা খুঁজে বের করা, অপরাধের ধরন এবং পরিবর্তন সম্পর্কে কারণ নির্দেশ করা এবং এসবের ভিত্তিতে কুসংস্কার দূর করার জন্য মানুষের আচরণ পরিবর্তন সংক্রান্ত কার্যকর পন্থা নির্দেশ করা। শুধু অপরাধের ক্ষেত্রেই নয়, এভাবে সমাজ মনোবিজ্ঞানী আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক স্বচ্ছ, জাতিগত বিদ্বেষ ইত্যাদি। সামাজিক সমস্যা সমধানেও অংশগ্রহণ করে চলেছেন। কাজেই সমাজ মনোবিজ্ঞানকে একটি ফলিত বিজ্ঞান হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায়।
এছাড়াও নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করে সমাজ মনোবিজ্ঞানকে ফলিত বিজ্ঞান বলা যায়:-
১. বিশেষ নীতি প্রয়োগ:
সমাজে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন সমস্যা এবং সামাজিক আচরণগুলো সম্পর্কে সমাজ মনোবিজ্ঞানী পরিষ্কার ধারণা রাখেন। তাই তিনি এসব সমস্যা সমাধানকল্পে সমাধানের উপায় নির্দেশ করে থাকেন। সমাজ মনোবিজ্ঞানের এই প্রায়োগিক বৈশিষ্ট্যের ক্লারণে সমাজ মনোবিজ্ঞানকে প্রায়োগিক বিজ্ঞানও বলা যায়।
২. কার্যকর উপায় নির্দেশ:
সমাজ মনোবিজ্ঞানে বিদ্যমান মতবাদগুলোর আলোকে সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধান ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে সমাজ মনোবিজ্ঞানী কার্যকর উপায় নির্দেশ করে থাকেন। বিষয়টি সমাজ মনোবিজ্ঞানকে ফলিত বিজ্ঞানের মর্যাদা দানে সহায়তা করে থাকে।
৩. চলমান সমস্যার তাত্ত্বিক সমাধান:
সমাজ মনোবিজ্ঞানে কোনো একটি সমস্যা সম্পর্কে বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিভিন্ন সমাধানের নীতি বিদ্যমান। থাকে। এর মাধ্যমেই সমাজ মনোবিজ্ঞানিগণ দক্ষতার সাথে যেকোনো দেশের চলমান সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকেন। উদাহরণপ বাংলাদেশে, চলমান জাতিগত বিষেষ, রাজনৈতিক কোন্দল, সামাজিক অপরাধ, জনসংখ্যাস্ফীতি, দারিদ্র্যয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাস ইত্যাদি সমস্যার সমাধানে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, আইন প্রণয়নকারী সংস্থাসমূহের পাশাপাশি সমাজ মনোবিজ্ঞানিগণ সফলভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
৪. সাধারণ মনোবিজ্ঞানে নীতির প্রয়োগ:
সমাজ মনোবিজ্ঞানী সাধারণ মনোবিজ্ঞান থেকে নীতি গ্রহণ করে সকল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রগুলোতে প্রয়োগ করে থাকেন। এছাড়াও সব ধরনের সামাজিক সমস্যা সমাধানকল্পে তারা বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন এবং নতুন কৌশলের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন সাধন করতে পারেন বলেই সমাজ মনোবিজ্ঞানকে ফলিত বিজ্ঞানের মর্যাদা দেওয়া হয়।
উপসংহার
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ে পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। এই সত্যটি সমাজ মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় প্রমাণিত হয়। তাই সমাজ মনোবিজ্ঞান কেবল একটি মৌলিক বিজ্ঞানই নয়, ফলিত বিজ্ঞান হিসেবেও এর গুরুত্ব রয়েছে। এর যেমন মৌলিক দিক রয়েছে, তেমনি রয়েছে ফলিত দিকও। সমাজ মনোবিজ্ঞান যেমন তার গবেষণা কাজে মৌলিক বিজ্ঞানের নিয়ম অনুসরণ করে তেমনি সামাজিক সমস্যার সমাধানে ফলিত বিজ্ঞানের নিয়মও অনুসরণ করে থাকে। সুতরাং বিজ্ঞান হিসেবে সমাজ মনোবিজ্ঞানকে মৌলিক ও ফলিত উভয় বিজ্ঞান বলাই যুক্তিযুক্ত।