জনমত গঠনে গণমাধ্যমের ভূমিকা

গণতন্ত্রের প্রথম ও প্রধান ভিত্তি হচ্ছে জনমত। আধুনিক সমাজ মনোবিজ্ঞানে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয় হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি মানুষের যৌথ আচরণগুলোর মধ্যে অন্যতম। কোনো বিষয়ে আপনা-আপনি জনমত গঠিত হয় না'। বিভিন্ন পদ্ধতি ও মাধ্যম দ্বারা জনমত গঠিত হয়। জনমত গঠনে যেসব বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিভিন্ন গণমাধ্যম। এগুলো খুব সহজে ও দ্রুত জনমত গঠন করতে পারে।

জনমত গঠনে গণমাধ্যমের ভূমিকা 

নিম্নে জনমত গঠনে গণমাধ্যমের ভূমিকা আলোচনা করা হলো-

১. সচেতনতা সৃষ্টি: 

সচেতনতা সৃষ্টি জনমত গঠনে গণমাধ্যমের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। দেশের মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারলে সহজেই জনমত সৃষ্টি হয়। রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র বিভিন্ন বিষয়ে সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে সচেতনতা জাগ্রত করে। সচেতন জনগণ যেকোনো বিষয়ের পক্ষে-বিপক্ষে নিজেদের মতামত দিতে পারে।

২. সমস্যা চিহ্নিতকরণ: 

জনমত সৃষ্টির জন্য কোনো একটি বিষয়কে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিতকরণ অতীব জরুরি। সমস্যাকে ভালোভাবে চিহ্নিত করতে পারলে জনগণের মধ্যে এ ব্যাপারে জানার আগ্রহ জন্মায়। ফলে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বেড়ে যায়। গণমাধ্যম যেকোনো সমস্যার ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করে; যেমন- অশিক্ষিত জনগণের মধ্যে বাল্যবিবাহের প্রবণতা অনেক বেশি। কিন্তু গণমাধ্যমের কল্যাণে এটিকে তারা সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করতে সক্ষম হয়েছে। যার ফলে সমাজে বাল্যবিবাহের মাত্রা ক্রমশ কমে যাচ্ছে।

৩. কোনো বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবন: 

গুরুত্বের সাথে যখন কোনো বিষয়কে জনগণের সামনে তুলে ধরা হয় তখন তারা সে বিষয়কে সমর্থন দেয়। সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও, চলচ্চিত্র প্রভৃতি গণমাধ্যম কোনো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের তাৎপর্য তুলে ধরে। এতে জনগণের মধ্যে সে বিষয়ের গুরুত্ব বহুগুণে বেড়ে যায়। ফলে তাদের মধ্যে এসব বিষয়ে জনমত গড়ে ওঠে।

৪. তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ: 

গণমাধ্যমের কর্মীরা বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে এবং সেগুলো বিশ্লেষণ করে জনগণের নিকট উপস্থাপন করেন। এসব তথ্যের মাধ্যমে জনগণ বিভিন্ন অজানা বিষয় সম্পর্কে অবগত হয়। ফলে কোনো বিষয়ের পক্ষে-বিপক্ষে জনগণের নৈতিক অবস্থান গড়ে ওঠে। এ নৈতিক অবস্থানের ভিত্তিতে জনগণের মধ্যে এক ধরনের ঐকমত্য সৃষ্টি হয়।

৫. ঐক্যবোধ সৃষ্টি: 

কোনো বিষয়ে জনগণের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ কোনো মতামত গড়ে উঠলে তাকে জনমত হিসেবে অভিহিত করা হয়। গণমাধ্যমে কোনো মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনা কিংবা অন্যায় অবিচারের সংবাদ প্রকাশ হলে জনগণ এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করে। মূলত এ প্রতিবাদই জনমতের বহিঃপ্রকাশ; যেমন- ২০ মার্চ ২০১৬ তারিখে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যার প্রতিবাদে দেশবিদেশে জনমত সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যম সবচেয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।

৬. মতামত প্রকাশ: 

টেলিভিশনে প্রচারিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান, টক শো, নাটক ইত্যাদির মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা তাদের নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেন যা জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়াও সংবাদপত্রে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ ও জনগণ তাদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। বর্তমানে অনলাইন পত্রিকাগুলো অনলাইনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভোটের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এ ধরনের ব্যবস্থা জনমত গঠনে বিশেষ সহায়ক হিসেবে কাজ করে।

৭. উদ্বুদ্ধকরণ: 

গণমাধ্যম সফল ব্যক্তিদের সফলতাকে জনগণের সামনে উপস্থাপন করে। এ ধরনের প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা হয়; যেমন- সমাজসেবায় সফল ব্যক্তি ড. ইউনূস কিংবা স্যার ফজলে হাসান আবেদের ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী তা ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। আবার অনেক দেশ তাদের এ ধারণাকে নিজেদের দেশেও প্রয়োগ করেছে। এভাবে সারা বিশ্বে তাদের ব্যাপারে জনমত গড়ে উঠেছে।

৮. ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে ধারণা সৃষ্টি: 

পৃথিবীতে এমন কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো সম্পর্কে জনগণ অজ্ঞ। এসব বিষয়ের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে তাদেরকে সচেতন করতে গণমাধ্যম ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। যেকোনো বিষয়ের কুপ্রভাব, কুফল কিংবা ক্ষতিকর প্রভাব জনগণের সামনে উপস্থাপন করলে এর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠে; যেমন- বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনগণ গণমাধ্যমের দ্বারাই জেনেছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনরোধে ব্যাপক জনমত গড়ে উঠেছে। 

৯. আন্তঃযোগাযোগ সৃষ্টি: 

জনগণের মধ্যে কোনো বিষয়ে যত দ্রুত যোগাযোগ-ক্রিয়া সম্পন্ন হয় তত দ্রুত মতামত গড়ে ওঠে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক, টুইটারের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ বৃদ্ধি পায়।

১০. চিন্তাধারার পরিবর্তন: 

চিন্তাধারার পরিবর্তনের মাধ্যমে কোনো বিষয়ে জনমত গড়ে তোলা যায়। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। আর ব্যাপক প্রচারণার ফলে জনগণের বদ্ধমূল ধারণার পরিবর্তন ঘটে; যেমন- পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে জনগণ প্রথমে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করলেও পরে তাদের চিন্তাধারার পরিবর্তন হয়েছে। এর ফলে পরিবার পরিকল্পনা প্রোগ্রামের ওপর ব্যাপক জনমত গড়ে উঠেছে। 

১১. সমজাতীয় মনোভাব: 

কোনো বিষয়ে জনগণ একই মত অর্থাৎ, সমজাতীয় মনোভাব পোষণ করলে সে বিষয়ে জনমত গঠিত হয়। এক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ ইত্যাদির ভূমিকা সবচেয়ে কার্যকর। এসব মাধ্যম দ্বারা জনগণ সহজেই কোনো বিষয়ে পছন্দ, অপছন্দ ও মতামত দিতে পারে। এছাড়াও রেডিও, টেলিভিশনের বিভিন্ন প্রোগ্রামে কোনো বিষয়ের ওপর জনগণ সমজাতীয় মনোভাব জ্ঞাপন করে যা জনমত গঠনে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

১২. অনুসন্ধান: 

সমাজের অলক্ষে বহু ঘটনা সংঘটিত হয়। এসব ঘটনা সহজেই ধামাচাপা পড়ে যায়। অনুসন্ধানের মাধ্যমে গণমাধ্যম এসব ঘটনাকে জনগণের সম্মুখে নিয়ে আসে। জনগণ এসব ঘটনা সম্পর্কে অবগত হয়ে মতামত দিয়ে থাকে। টেলিভিশন ও সংবাদপত্র এসব অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের ওপর বেশি জোর দেয়, যা জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উদাহরণস্বরূপ, টেলিভিশনে প্রচারিত বিভিন্ন ধরনের ক্রাইম রিপোর্টের কথা বলা যায়।

উপসংহার 

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আধুনিক উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গণমাধ্যমের গুরুত্ব ও ভূমিকা সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। গণমাধ্যম সমাজের কার্যকর মুখপাত্র। তাই সুষ্ঠু জনমত গঠন করতে হলে স্বাধীন গণমাধ্যম একান্ত প্রয়োজন; অর্থাৎ, একমাত্র স্বাধীন গণমাধ্যমের মাধ্যমেই সুষ্ঠু জনমত গঠন করা সম্ভব। সুতরাং বলা যায়, জনমত গঠনে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url