সামাজিকীকরণের মাধ্যম হিসেবে পরিবার এবং বিদ্যালয়ের ভূমিকা
সামাজিক জীব হিসেবে মানুষকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সামাজিক পরিমণ্ডলেই বসবাস করতে হয়। মানুষ সমাজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁচে থাকতে পারে না। তাই শিশু যে সমাজ বা পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেন, বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে তার মধ্যে সেই সমাজোপযোগী আচরণের বিকাশ ঘটে। তখন সে নিজের আচরণের ভালো কিংবা মন্দ দিকটি বুঝতে সক্ষম হয়। সামাজিক প্রভাবের এ ধারাকে সামাজিকীকরণ বলে। সামাজিকীকরণ শুধু শিশুকালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি সমগ্র জীবনে ব্যাপৃত। তবে সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে পরিবার, বিদ্যালয় এবং সমবয়সিদের ভূমিকা অপরিসীম।
সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকা
সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকা নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
১. প্রথম আশ্রয়স্থল:
পরিবারের মাধ্যমেই শিশু জন্মগ্রহণ করে এবং বড়ো হয়ে ওঠে। এ সময় পরিবারের সদস্যের মধ্যে যে ধরনের ধ্যানধারণার প্রতিফলন ঘটে তা শিশুর মনে সঞ্চারিত হয় সহজে। আর এটির প্রভাব তার সারা জীবনকে চলার একটা দিকনির্দেশনা দেয়। পরিবার এমন একটি সংগঠন যেখানে প্রথম আশ্রয়স্থল হিসেবে জীবন চলার নীতিগুলো আয়ত্ত করা যায়।
২. স্নেহ-ভালোবাসার বন্ধন:
পরিবারের মধ্যে পরিবারের সদস্যদের একটা হৃদয়ের সম্পর্ক থাকে। যার কারণে স্নেহ ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তারা জীবনযাপন করে। পরিবারের মাধ্যমে এ জন্য শিশু বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
৩. পরিবারের ওপর নির্ভরশীলতা:
জন্মের পর ব্যক্তি পরিবারের ওপর গভীর ও ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল থাকে। অন্য কোনো সংগঠনে ব্যক্তির এত বেশি নির্ভরশীলতা লক্ষ করা যায় না। বৃস্তুত শিশু পরিবারের মধ্যেই তার জীবনের পরিপূর্ণতা লাভ করে। জীবনের যাবতীয় চাওয়া-পাওয়া এ পরিবারের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব হয়। তাই পরিবারের প্রতি এ নির্ভরশীলতা সামাজিীকরণের শিক্ষাকে ফলপ্রসূ করে তোলে।
৪ . বৃহৎ সমাজে প্রবেশ:
মানবশিশুর প্রথম পদচারণা পরিবারে। এ পরিবারের নানামুখী কার্যকলাপ, ধ্যান-ধারণা, স্নেহ- ভালোবাসায়, রীতি-নীতি ও আদবকায়দার শিক্ষা নিয়ে শিশু বড়ো হতে থাকে। আর একদিন সে পরিবারের মাধ্যমেই বৃহৎ সমাজে তার জায়গা করে নেয় এবং নিজেকে সমাজের উপযোগী মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে।
৫ ব্যক্তিত্ব গঠন:
সমাজে সুন্দর, স্বাভাবিক এবং নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হয়ে বসবাস করতে গেলে অনেক ভালো গুণাবলি অর্জন করতে হয়, ব্যক্তিত্ব গঠন করতে হয়। আর শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনের ক্ষেত্রে সমাজে নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান থাকলেও পরিবারের মাধমেই তার ব্যক্তিত্বের গুণাবলি অর্জন সম্ভব।
৬. মর্যাদার অংশীদার:
জন্মগ্রহণের সাথে সাথে একটি শিশুর পরিচয় প্রকাশ পায় বাবা-মায়ের মাধ্যমে। আর শিশু যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করে সে পরিবারের বংশ, গৌরব ও মর্যাদা তার পরিচয়কে প্রসারিত করে। মূলত একটি শিশুর ভালো পরিবারে জন্ম হলে তার চরিত্রের সার্বিক দিকগুলো এ মর্যাদাবান পরিবারের স্বার্থে আরো বেশি প্রকাশ হয়। যা তার সামাজিকীকরণে বিশেষভাবে সহায়ক হয়।
৭. নিরাপত্তাবোধ:
একটি শিশু জন্মের পর পরিবারেই সবচেয়ে বেশি নিরাপদবোধ করে। আর এ কারণেই তার সামাজিকীকরণের যাবতীয় গুণাবলি অতি সহজে আয়ত্ত করা সম্ভব হয়। সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তাবঞ্চিত শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ যেমন বাধাগ্রস্ত হয় তেমনি সামাজিকীকরণের পথে অন্তরায়।
সামাজিকীকরণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা
সামাজিকীকরণের দ্বিতীয় প্রধান বাহন হচ্ছে বিদ্যালয়। নিচে সামাজিকীকরণে বিদ্যালয়ের গুরুত্ব আলোচিত হলো-
১. আচরণ ও মূল্যবোধ শিক্ষা:
বিদ্যালয় হচ্ছে সমাজ দ্বারা আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচালিত সামাজিকীকরণের একটি মাধ্যম, যেখানে শিশু বিশেষ দক্ষতা ও মূল্যবোধ অর্জন করে। বিদ্যালয়ের বৃহত্তর পটভূমিতে সে সমাজের মূল্যবোধ, ভাবাদর্শ, সমাজ অনুমোদিত আচার-আচরণ এবং নিষিদ্ধ কাজকর্ম সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ পায়। আধুনিককালে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে অনেক মূল্যবোধ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঞ্চার করার চেষ্টা করা হয় যা সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে।
২. ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা:
বিদ্যালয়ে শিশুরা ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষালাভ করে। এতে করে ধর্মীয় মূল্যবোধের দ্বারা লালিত হয় এবং পরবর্তীকালে তা তার জীবনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। বিদ্যালয়ে শিশু ধর্মীয় শিক্ষালাভের মাধ্যমে সমাজে বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করার সাথে সাথে বিভিন্ন অসামাজিক ও অবৈধ কার্যকলাপ থেকে নিজেকে বিরত রাখার প্রণোদনা পায়। শিশু ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মহৎ গুণাবলি অর্জনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে সম্মানী গুণীজনে পরিণত হয় এবং বিভিন্নভাবে সমাজ তথা সমগ্র দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গতিশীলতা দান করতে সক্ষম হয়।
৩. নাগরিক গুণাবলির বিকাশ:
বিদ্যালয়ে শিশু যা শেখে তা তার চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করে। বিদ্যালয়ে সুশিক্ষা লাভের মাধ্যমে শিশুর মধ্যে সুনাগরিকতার সমস্ত বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। সে সমাজের শান্তিশৃঙ্খলা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে দৃঢ়প্রতিষ্ঠা হয়। এককথায়, প্রকৃত শিক্ষলাভের মাধ্যমে শিশুর মধ্যে স্বদেশপ্রেম জাগ্রত হয়, যা তাকে আগামীদিনের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে।
৪. ব্যক্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ রিকাশ:
বিদ্যালয়ের বৃহৎ গণ্ডি শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শিশু যখন বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে তখন থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে তার দীক্ষিতকরণ শুরু হয়। এখানে ক্রমে শিশু শিক্ষক, পাঠ্যপুস্তক ও সহপাঠীর সান্নিধ্য লাভ করে এবং এদের প্রভাব পড়ে শিশুর ওপর। অনেক সময় ছেলেমেয়েরা তাদের শিক্ষকের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয় এবং সে অনুসারে তার ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে; অর্থাৎ, বিদ্যালয়ে এসে শিশু কেবল পুথিগত বিদ্যাই অর্জন করে না, এর পাশাপাশি শিক্ষক ও বিভিন্ন পরিবার থেকে আগত সহপাঠী ও তাদের সংস্কৃতির সান্নিধ্যে আসে। এর ফলে সে স্বীয় সমাজের মূল্যবোধ, নিয়ম ও এবং সমাজ-স্বীকৃত আচরণগুলো শিক্ষালাভ করে। যার ফলে তার ব্যক্তিত্বের দ্রুত বিকাশ ঘটে।
৫. ন্যায়-অন্যায়বোধ শিক্ষা:
ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ন্যায়-অন্যায়বোধ শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে বিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিদ্যালয়ের পরিবেশে শিশুর ন্যায় আচরণ পুরস্কৃত এবং অসৎ ও অন্যান্য আচরণ তিরস্কৃত হয়। এছাড়া সকল শিক্ষালাভের পর একটি শিশু সহজেই কোনটা ন্যায় এবং কোনটা অন্যায় তা চিহ্নিত করতে পারে। বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের উপদেশ ও পাঠ্যপুস্তকের বিশ্লেষণের মাধ্যমে শিশুর মধ্যে ইতিবাচক গুণাবলি গ্রহণ ও অনৈতিক কার্যাবলি বর্জনের মানসকিতা তৈরি হয়। শিশুর পরবর্তী জীবনে এ ভূমিকা প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়।
৬. শৃঙ্খলাবোধ সৃষ্টি:
বিদ্যালয়ে সঠিক সময়ে উপস্থিত হওয়া, ঠিকভাবে বাড়ির কাজ করা, শৃঙ্খলাপূর্ণভাবে অ্যাসেম্বলিতে অংশগ্রহণ করা ইত্যাদির মাধ্যমে শিশুর মধ্যে সময়ানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবোধের সৃষ্টি হয়। তাছাড়া বিদ্যালয়ের নিয়মানুবর্তিতা ভঙ্গ করলে যে শাস্তি পেতে হয় এ বোধ থেকে সে নিয়মানুবর্তিতা পালনের প্রতি সচেতন থাকে। যার ফলে ভবিষ্যতে সামাজিক নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলবোধ পালনে তার কোনো সমস্যা হয় না।
উপসংহার
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ব্যক্তির সামাজিকীকরণ মূলত সামাজিক পরিবেশের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। তাই সামাজিকীকরণের মাধ্যমে ব্যক্তি সমাজের ভালো আচরণ যেমন শেখে তেমনি মন্দ আচরণগুলোও শেখে। আর শিশুর বা ব্যক্তির এসব আচরণ শেখার পেছনে পরিবার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ।