ফলপ্রসূ প্রচারণার নীতিসমূহ
প্রচারণা মনোবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রাচীনকাল থেকে মানুষের চিন্তাধারা ও কার্যাবলিকে প্রভাবিত করার জন্য প্রচারণা ব্যবহৃত হচ্ছে। আধুনিক যুগে কোনো কিছুর সফলতা প্রচারণার ওপর নির্ভর করে। কোনো পণ্যের প্রচারণার ওপর এর সফলতা নির্ভর করে। প্রচারণার গুরুত্ব নিয়ে সমাজ মনোবিজ্ঞানিগণ আলোচনা করেছেন।
প্রচারণা
প্রচারণা শব্দটি ল্যাটিন প্রতিশব্দ Propaganda থেকে উৎপত্তিলাভ করেছে। Propaganda শব্দের অর্থ হচ্ছে জনন্ম দেয়া বা উৎপাদন করা। প্রচারণার একটি সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের আচরণের পরিবর্তন ঘটানো। ব্যক্তির মতামত এবং মনোভাবকে প্রভাবিত করার জন্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সুসংগঠিত ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রচেষ্টাই হচ্ছে প্রচারণা।
ফলপ্রসূ প্রচারণার নীতিসমূহ
প্রচারণাকে ফলপ্রসূ করে তোলার ক্ষেত্রে প্রচারণাকারীদের কতিপয় নীতি মেনে চলতে হয়। নিম্নে ফলপ্রসূ প্রচারণার নীতিসমূহ প্রদত্ত হলো-
১. জনগণের মনোভাব ও মূল্যবোধের প্রতি গুরুত্বারোপ:
প্রচারণাকারীকে জনগণের মনোভাব ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে প্রচারণা চালাতে হবে। জনগণের অনুভূতি যাতে কখনও অবহেলিত বা আঘাতপ্রাপ্ত না হয় এ বিষয়ে প্রচারককে বিশেষ যত্নবান হতে হবে। জনগণের মূল্যবোধ, অনুভূতি ও ধ্যান-ধারণার প্রতি প্রচারকের শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। তবেই প্রচারণা ফলপ্রসূ হবে।
২. বয়স, বুদ্ধিমত্তা ও শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্য:
প্রচারণার ক্ষেত্রে আর একটি বিশেষ দিক বিবেচনা করতে হয়। যে জনগণের ওপর প্রচারণা চালানো হয় তাদের বয়স, শিক্ষা, বুদ্ধিমত্তা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার উপযোগী করে প্রচারণার উপকরণকে সাজিয়ে নিতে হয়। সাধারণত কম বয়সি ও অশিক্ষিত জনগণের ওপর প্রচারণা অধিক কার্যকরী হয়।
৩. উৎস অজানা:
যে বিষয় নিয়ে প্রচারণা চালানো হয় তার উৎস জনগণের নিকট জানা না-থাকলে তা সহজেই কার্যকর হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রচারণা চালানো হয় পাকসেনারা গরুর মাংস খেতে না-পেরে তা ফেলে দিচ্ছে। কিন্তু ঘটনাটি সাধারণ মানুষের কাছে অজানা।
৪. প্রতিযোগিতা মোকাবেলা:
প্রতিপক্ষের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য প্রচারককে কতিপয় কৌশল অবলম্বন করতে হবে। প্রতিপক্ষের প্রচারণাকে সুকৌশলে দমন করে নিজের প্রচারণাকে সমুজ্জ্বল করতে হবে। আজকাল কোনো পণ্যের প্রচারণায় অন্য পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা জরুরি।
৫. শ্রুতিমধুর শব্দের ব্যবহার:
প্রচারণাকে ফলপ্রসূ করতে শ্রুতিমধুর, আকর্ষণীয় ও সদর্থক শব্দের ব্যাপক প্রয়োগ করতে হবে। শ্রুতিমধুর শব্দের প্রতি জনগণের সভাবতই আকর্ষণ থাকে। তাই প্রচারণার সময় প্রচারককে শ্রুতিমধুর শব্দের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।
৬. চাহিদা ও ব্যর্থতার প্রতি গুরুত্ব:
প্রচারণাকে ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে যাদের উদ্দেশ্যে প্রচারণা করা হয় তাদের চাহিদা, ব্যর্থতা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ-দৈন্য দূরীকরণে যে প্রচারণা আশ্বাসের বাণী শুনতে পারবে সে প্রচারণার আবেদন হবে খুবই ফলপ্রসূ। প্রচারণা যদি জনগণের চাহিদা পূরণ অথবা ব্যর্থতা দূর করতে পারে তবে তা সফল হবে।
৭. একাত্মতা ঘোষণা:
প্রচারণাকে ফলপ্রসূ করার অন্যতম নীতি হচ্ছে একাত্মতা ঘোষণা। যে বিষয়ের প্রচারণা চালানো হয় সে বিষয়ের প্রতি জনগণ যাতে একাত্মতা ঘোষণা করে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে; যেমন: ভারতের জনগণের নিকট বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানিকে আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য যে প্রচারণা চালানো হয়েছিল তার প্রতি জনগণ একাত্মতা ঘোষণা করেছিল।
৮. পুনরাবৃত্তি:
প্রচারণাকে ফলপ্রসূ করার উল্লেখযোগ্য নীতি পুনরাবৃত্তি। সময় ও পরিবেশ বুঝে একই প্রচারণা বারবার করতে হয়।
এতে করে প্রচারিত বিষয়ের প্রতি জনগণের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। জার্মানির বিখ্যাত প্রচারক গোয়েবলস মনে করেন, একটি মিথ্যা বারবার সত্য বলে প্রচার হলে জনগণ সেটাকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করে।
৯. মনোরঞ্জন:
তথ্য প্রচার প্রচারণাকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে প্রচারক মনোরঞ্জন তথ্য প্রচার করেন। দেখা যায়, প্রচারক যত মধুময় বাক্য দ্বারা বিষয়টি উপস্থাপন করবেন প্রচারণাটি ততই ফলপ্রসূ হবে; যেমন- যদি কোনো দ্রব্যের প্রচারণায় গ্রহণযোগ্য শব্দ দ্বারা দ্রব্যটির উপস্থাপন করা হয় তাহলে তা ফলপ্রসূ হবে।
১০. গণমাধ্যমের ভূমিকা:
প্রচারণাকে ফলপ্রসূ করার জন্য জনপ্রিয় গণমাধ্যম নির্বাচন করা জরুরি। কোনো পণ্যের প্রচারণার জন্য সংবাদপত্র ও টিভির মাধ্যমে যদি পণ্যের গুণগত মান মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়া হয় তবে পণ্যের প্রচারণা কার্যকরী হবে।
১১. আকর্ষণ করার ক্ষমতা:
প্রচারণার ক্ষেত্রে জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করার ক্ষমতা থাকতে হবে। প্রচারণার ক্ষেত্রে নতুনত্ব, বর্ণাঢ্যতা প্রভৃতি গুণাবলি থাকতে হবে। এ গুণাবলি ব্যক্তির মনোযোগ আকৃষ্ট করে। শুধু দ্রব্যের প্রচারণার সময় দ্রব্যকে নতুনভাবে ও আকর্ষণীয় করে জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে হবে।
উপসংহার
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্রচারণার একটি সুস্পষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের আচরণের পরিবর্তন ঘটানো। ব্যক্তির মনোভাব এবং মতামতকে প্রভাবিত করার জন্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সুসংগঠিত এবং সুসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রচেষ্টাই হচ্ছে প্রচারণা। প্রচারণার সফলতা প্রচারণার নীতির ওপর নির্ভরশীল। প্রচারণা জনগণের চাহিদা, রুচি, মনোভাব প্রভৃতির ওপর নির্ভর করে।