আবেগকালীন শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনসমূহ
আবেগ মানুষের সহজাত ধর্ম। মানুষের আচরণে উত্তেজনা, অস্থিরতা, চঞ্চলতা, তীব্রতার যে তারতম্য ঘটে তার মূলে রয়েছে আবেগ। কোনো বিশেষ বস্তু বা ধারণা একে জাগ্রত করে। আবেগে দেহের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন ঘটে। তখন দেহে কতগুলো বিশেষ ধরনের দৈহিক প্রকাশ ঘটে, যার জন্য আমরা নানা রকম আবেগময় আচরণে প্রবৃত্ত হই। প্রতিদিন আমরা আনন্দ, বিষাদ, আশানিরাশা, ভয়, ক্ষোভ ইত্যাদি অনুভূতি লাভ করি। এসব অনুভূতি ছাড়া আমাদের জীবন অসুখী হতো, জীবন হতো উত্তাপহীন। অনুভূতির কারণেই আমরা জীবনকে উপভোগ করতে পারি। আর আবেগ আমাদের কর্মতৎপরতাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
আবেগকালীন শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনসমূহ
আবেগের অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলো দৈহিক পরিবর্তন। আমরা যেসব বাহ্যিক পরিবর্তন দেখে থাকি তাদের পেছনে কতগুলো বিশেষ বিশেষ আবেগের পরিবর্তন সাধিত হয়। বাহ্যিক আচরণসমূহ এদের দ্বারাই প্রভাবিত হয়। দেহ অভ্যন্তরে যেসব পরিবর্তন ঘটে তাদের অধিকাংশ স্নায়ুতন্ত্র ও অনালি গ্রন্থির দ্বারা সাধিত হয়। স্নায়ুতন্ত্রের শরীর প্রক্রিয়ার গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, আবেগের সময় শরীরের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রমন্ডলীতে যে পরিবর্তন হয় তা স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র দ্বারা সূচিত হয়। এজন্যে এসব পরিবর্তনকে স্বয়ংক্রিয় পরিবর্তন বলা হয়ে থাকে। আবেগকালীন সময় দৈহিক যেসব পরিবর্তন হয় তাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা: ক. বাহ্যিক পরিবর্তন, খ. অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন।
ক. বাহ্যিক পরিবর্তন:
আবেগকালীন সময়ে দৈহিক পরিবর্তনসমূহ যা বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণ করা যায় তাকে বাহ্যিক পরিবর্তন বলে। নিচে উল্লেখযোগ্য কয়েকটির বর্ণনা দেয়া হলো:
১. লোমের প্রতিক্রিয়া: তীব্র আবেগে লোমের প্রতিক্রিয়ায় পরিবর্তন দেখা যায়। ভয়ে গায়ের লোম খাড়া হওয়ার কথা আমাদের সবারই জানা আছে।
২. চর্মের তাপমাত্রা: যখন কেউ তীব্র আবেগ বা ক্রোধেরর বশবর্তী হয় তখন হাত ও মুখমন্ডলের তাপমাত্রা কমে যায়।
৩. মাংসপেশীর কঠিনতা প্রাপ্তি এবং কম্পন: যদি কেউ খুব রেগে যায়, অথচ গালিগালাজ বা অন্য কোনো বাহ্যিক প্রতিক্রিয়ার সাহায্যে তার রাগ প্রকাশ করতে না পারে, তাহলে তার হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায়। যখন আবেগের সঙ্গে দ্বন্দ্ব জড়িত থাকে তখন মাংসপেশীর কম্পন দেখা দেয়।
৪. চোখের তারার প্রতিক্রিয়া: তীব্র আবেগে সমবেদী স্নায়ুতন্ত্রের প্রভাব যেসব দৈহিক পরিবর্তন সৃষ্টি করে তার একটি হলো চোখের তারার প্রতিক্রিয়া। আবেগের সময় চোখের তারা বা মণির প্রসারণ এবং সংকোচন সহজে পরিলক্ষিত হয়।
৫. কন্ঠস্বরের পরিবর্তন: তীব্র আবেগের মুহূর্তে কণ্ঠস্বরের তীক্ষ্ণতা লক্ষ্য করা যায়। তবে একই আবেগ জগতের সব মানুষের ক্ষেত্রে অনুরূপ পরিবর্তন সৃষ্টি করে না।
৬. দেহের অসাড়তা: তীব্র আবেগে দেহ অসাড় হয়ে পড়ে। অনেকে ভয়ে শত্রুর সামনে অসাড় হয়ে যায় এবং পলায়নের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
৭. ঘর্মগ্রন্থির প্রতিক্রিয়া: তীব্র উত্তেজনার সময় স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র ঘর্মগ্রন্থি এর ওপর প্রভাব বিস্তার করে। ফলে, তীব্র আবেগের সময় দেহ হতে বেশি পরিমাণ ঘর্ম নির্গত হয়।
৮. মুখমন্ডলের অভিব্যক্তি: মুখমন্ডলের অভিব্যক্তি হলো আবেগ প্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক। মানুষ আবেগতাড়িত হলে তা তার মুখমন্ডলের অভিব্যক্তিতে প্রকাশ পায়।
৯. অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহারে পরিবর্তন: আবেগের সময় বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নাড়াচাড়া সাধারণভাবে হয় না। যেমন রাগের সময় আমরা জোরে জোরে হাত পা নাড়ি, যখন দুঃখ পাই তখন চুপচাপ বসে থাকি।
১০. মুখভঙ্গি: আবেগতাড়িত হলে মুখভঙ্গির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। এসময় চক্ষু, নাসিকা, ঠোঁট ও কপালসহ মুখমন্ডলের পরিবর্তন হয়।
খ. অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন:
আবেগকালীন সময়ে দেহের অভ্যন্তরে যেসব পরিবর্তন সাধিত হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পরিবর্তন নিচে বর্ণনা করা হলো:
১. রক্তের চাপ: আবেগের সময় রক্ত চাপের পরিবর্তন দেখা দেয়। আবেগের সময় রক্ত রক্তনালির ভেতর দিয়ে ত্বকের দিকে প্রবাহিত হয়। আবার, ভয়ের সময় মুখমন্ডল যখন ফ্যাকাশে হয়ে পড়ে তখন রক্তের চাপ বিপরীতমুখী হয়। প্রেসার মিটারের সাহায্যে এটা পরিমাপ করা যায়।
২. হৃৎপিন্ডের ক্রিয়া: আবেগের সময় হৃৎপিন্ডের ক্রিয়া দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়, এ সময় বুক ধরফর করে। মনোবিজ্ঞানিরা পলিগ্রাফ নামের উন্নত যন্ত্রের সাহায্যে আবেগকালীন হৃৎপিন্ডের ক্রিয়া পরিমাপ করে দেখছেন যে, 'আবেগের সময় হৃদকম্পন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি হয়।
৩. ত্বকের মাধ্যমে রাসায়নিক তড়িৎ প্রবাহ: আবেগের উদ্রেক হলে ত্বকের মধ্যে রাসায়নিক তড়িৎ প্রবাহের গতি বৃদ্ধি পায়। হাতের তালুতে তড়িৎ সঞ্চালক লাগিয়ে রাসায়নিক তড়িৎ প্রবাহ পরিমাপের ভেতর দিয়ে আবেগের উদ্রেক অনুমান করা যায়।
৪. পাকস্থলীর ক্রিয়া: তীব্র আবেগের সময় পাকস্থলীর পীড়া দেখা দেয়। আবার এ সাথে স্ফিংটার মাংসপেশীর অনৈচ্ছিক শিথিলতা আসে, যার ফলে তীব্র আবেগে বা ভয়ে মানুষ (শিশু, বৃদ্ধ) মলমূত্র ত্যাগ করে ফেলে।
৫. রক্তের উপাদানের পরিবর্তন: তীব্র আবেগে অনালি গ্রন্থি সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং রক্তে হরমোন নিঃসরণ করে। ফলে রক্তের উপাদানে পরিবর্তন দেখা যায়। স্বাভাবিক অবস্থায় রক্তে এড্রিনাল হরমোন পাওয়া যায়। কিন্তু আবেগকালীন সময় এড্রিনাল গ্রন্থি থেকে এড্রিনাল হরমোন নিঃসৃত হয়। এ হরমোন দেহকে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার জন্য প্রস্তুত করে।
৬. লালা ক্ষরণের পরিবর্তন: তীব্র আবেগের সময় লালাগ্রন্থির ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার ফলে লালা ক্ষরণ হয় না। এর জন্যই ভয়ে আমাদের মুখ শুকিয়ে যায়।
৮. অন্ত্রের ক্রিয়া: প্রচন্ড আবেগের সময় অন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। সেই সাথে স্ফিংটার মাংসপেশীর অনৈচ্ছিক শিথিলতা আসে, ফলে অতিরিক্ত ভয়ে মানুষ মলমূত্র ত্যাগ করে ফেলে।
৯. এড্রিনাল গ্রন্থির পরিবর্তন: আবেগের সময় এড্রিনাল গ্রন্থি থেকে এড্রিনালিন নামক এক প্রকার হরমোন নির্গত হয়। এড্রিনালিনের প্রভাবে যকৃতে সংরক্ষিত শর্করা রক্তশ্রোতে মিশে শর্করার পরিমাণ বাড়ায়। এ হরমোন দেহের ক্ষতস্থানে রক্ত জমাট বাঁধে।
১০. শ্বাস-প্রশ্বাসের পরিবর্তন: আবেগের সময় শ্বাসপ্রশ্বাসের পরিবর্তন খুব স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। কোনো কোনো আবেগের সময় আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলি, আবার কোনো বিশেষ আবেগময় দ্বন্দ্বে আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসে।
উপসংহার
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মানুষের প্রত্যেকটি কাজের সাথে জড়িত রয়েছে কোনো না কোনো ধরেনর আবেগ। যখন আবেগের সৃষ্টি হয়, তখন শারীরিক কতকগুলো পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। আবেগ জরুরি অবস্থায় জীবকে পরিস্থিতি মোকাবেলায় সাহায্য করে। আবেগে পরিবর্তনের সাথে সাথে কিছু মানসিক পরিবর্তনও হয়ে থাকে।