পারস্পরিক আকর্ষণের সাদৃশ্যতত্ত্ব
মানব ইতিহাসের ক্রমোন্নতির ধারা লক্ষ করলে দেখা যায়, সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের পরিচিতির মূলে ভূমিকা পালন করেছে তাদের মধ্যকার পারস্পরিক আকর্ষণ। এরূপ পারস্পরিক আকর্ষণের সূত্র ধরে গড়ে উঠেছে মানবগোষ্ঠী, সমাজ, পরিবার এবং বন্ধুত্ব। পারস্পরিক আকর্ষণ বলতে কোনো একজন ব্যক্তির প্রতি অন্য ব্যক্তির এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতাকে বোঝায়।আকর্ষণের বিভিন্ন মাত্রা রয়েছে; যেমন- ভালোবাসা, পছন্দ, অপছন্দ ইত্যাদি ক্ষেত্রে অতিশয় ধনাত্মক, অনিশ্চিত এবং অতিশয় ঋণাত্মক সম্পর্ক হতে পারে। নিম্নে পারস্পরিক আকর্ষণের সাদৃশ্যতত্ত্ব আলোচনা করা হলো-
সাদৃশ্যতত্ত্ব
মনোভাবের সাদৃশ্য পারস্পরিক আকর্ষণের সৃষ্টি করে। এটিই সাদৃশ্য তত্ত্বের মূলকথা। নিউকম্ব (১৯৬১)-এর মতে দুই বা ততোধিক ব্যক্তির চিন্তাধারা বা মনোভাব ও মূল্যবোধের সাদৃশ্য পরস্পরকে আকর্ষণ করে কারণ মানুষ অন্যের কাছ থেকে তার নিজ মনোভাব বা বিশ্বাসের সমর্থন কামনা করে।
পারস্পরিক সম্পর্কে অন্যব্যক্তি যখন কোনো ব্যক্তির মনোভাবের বিপরীত মনোভাব প্রদর্শন করে তখন তা ব্যক্তির মধ্যে একপ্রকার চাপের (strain) সৃষ্টি করে। এই চাপ অস্বস্তির উদ্রেক করে বলে ব্যক্তি তা দূর করার জন্য অন্যের সাথে মতৈক্যে আসে। এই একমত হওয়ার পেছনে যে প্রেরণাটি কাজ করে। তাকে সুলিভানের (১৯৪৭) ভাষায় মতৈক্য দ্বারা যথাযথকরণ বলে উল্লেখ করা যায়; অর্থাৎ, মানুষ অন্যের সমর্থন অন্বেষণের মাধ্যমে তার নিজ মনোভাবের সত্যতা প্রমাণের প্রয়াস পায়।
দুজন ব্যক্তির কাছে কোনো মনোভাবের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা যত বেশি হয় পারস্পরিক আকর্ষণের মাত্রাও তত বেশি বৃদ্ধি পাবে বলে নিউকম্ব মনে করেন। গুরুত্ব বলতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রতি অনুভূতি, অবহিতি ও আচরণের শক্তি বোঝায়।
উদাহরণস্বরূপ, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সন্তান লালন-সম্পর্কিত মনোভাবটি যত গুরুত্বপূর্ণ, কোনো আসবাবপত্র কেনার বিষয়টি ততখানি গুরুত্বপূর্ণ নয়। কাজেই সন্তান লালন-সম্পর্কিত মনোভাবের সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য তাদের পারস্পরিক আকর্ষণের ক্ষেত্রে অধিকতর প্রভাবশালী হওয়া স্বাভাবিক। তেমনি তাদের কাছে সন্তান সম্পর্কিত কোনো বিষয় যতখানি প্রাসঙ্গিক কাপড়ের দাম ওঠানামার বিষয়টি ততখানি প্রাসঙ্গিক নয়। কাজেই পারস্পরিক আকর্ষণের ক্ষেত্রে প্রথমটি যতখানি প্রভাব বিস্তার করবে দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি ততখানি প্রভাবশালী না হওয়াই স্বাভাবিক।
নিউকম্ব-এর মতবাদ অনুসারে ব্যক্তি 'খ'-এর প্রতি 'ক' এর আকর্ষণ যেমন কোন বিষয়ের প্রতি 'ক' এর নিজস্ব মনোভাব এবং তার চোখে 'খ' এর মনোভাবের সাদৃশ্যের উপর নির্ভর করে তেমনি 'খ' এর প্রতি 'ক' এর আকর্ষণের মাত্রা আবার তার নিজ মনোভাব ও 'খ' এর মনোভাব প্রত্যক্ষণকে প্রভাবিত করে থাকে। অন্য কথায়, দুজনের মধ্যে কোনো বিষয়ের প্রতি মনোভাবের সাদৃশ্য থাকলে তারা নিজেদের মধ্যে মনোভাবের বৈসাদৃশ্যকে খাটো করে দেখে বা নিজ মনোভাবকে অন্যজনের মনোভাবের অনুরূপ দেখে থাকে; অর্থাৎ, মনোভাবের সাদৃশ্য যেমন পারস্পরিক আকর্ষণ বৃদ্ধি করে তেমনি পারস্পরিক আকর্ষণ ব্যক্তির নিজের ও অপরের মনোভাব প্রত্যক্ষণকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করে।
পারস্পরিক আকর্ষণ সৃষ্টি সম্পর্কে নিউকম্ব বলেন পরস্পর অপরিচিত ব্যক্তিরা যখন পারস্পরিক আদান-প্রাদন শুরু করে তখন একে অপরের সম্বন্ধে জানতে পারে এবং ক্রমে তারা পরস্পরের মনোভাবের মিল লক্ষ করে নিজের অজান্তে একে অপরের প্রতি গভীর আকর্ষণ অনুভব করতে শুরু করে। একটি পরীক্ষণের (১৯৬১) মাধ্যমে নিউকম্ব এই পরিচিতি প্রক্রিয়াকে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এই গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাগত ১৭ জন ছাত্র নিয়ে গঠিত দুটি দলকে ষোলো সপ্তাহব্যাপী একটি ছাত্রাবাসে রাখা হয়। এরা প্রথমে কেউ কাউকে চিনত না। প্রত্যেক সপ্তাহ শেষে তাদের বন্ধুত্ব ও মনোভাব সম্পর্কিত কিছু প্রশ্নমালার উত্তর দিতে বলা হতো। এসব উত্তর বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে পরিচিতির প্রথম দিকে একই কক্ষে বসবাসকারী ছাত্ররা পরস্পরকে পছন্দ করেছে। এবং এই পছন্দের ব্যাপারে তাদের মনোভাব ও মূল্যবোধের সাদৃশ্যের কোনো গুরুত্বই পরিলক্ষিত হয়নি। কিন্তু যতই সপ্তাহের পর সপ্তাহ পার হতে থাকে ততই দেখা যায় পারস্পরিক মনোভাবের সাদৃশ্য অনুসারে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে দলের অন্যান্য সদস্যের প্রতি মনোভাব সম্পর্কে সাদৃশ্যই এক্ষেত্রে প্রধান ছিল।
তাছাড়া নিজের প্রতি মনোভাবও পারস্পরিক আকর্ষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোনো ব্যক্তি তার নিজের সম্বন্ধে যেমন ধারণা পোষণ করে, অন্য কেউ যদি তার সম্বন্ধে অনুরূপ মনোভাব প্রকাশ করে তাহলে তার প্রতি ব্যক্তির আকর্ষণ বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়।
বার্ন ও গ্রিফিট (১৯৬৬)-এর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের উপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায় যে পারস্পরিক মনোভাবের সাদৃশ্য যত বৃদ্ধি পায় আকর্ষণও তত বৃদ্ধি পায়। এই পরীক্ষণে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে তাদের বয়সোপযোগী বিভিন্ন বিষয়ের উপর সংক্ষিপ্ত মতামত-প্রশ্নমালা পূরণ করতে দেওয়া হয়। পরে প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীকে এমন একটি পূরণ করা প্রশ্নমালা দেখানো হয় যা বিশেষ মাত্রায় তার নিজস্ব মনোভাবের অনুরূপ। পারীক্ষকে বিশ্বাস করানো হয় যে পূরণকৃত প্রশ্নমালাটি তারই বয়সি অপর একজনের। প্রকৃতপক্ষে পরীক্ষণকারী সুপরিকল্পিতভাবে এগুলো নিজেই পূরণ করেন এবং তা এমনভাবে উপস্থাপন করেন যাতে একটি বিশেষ আনুপাতিক হারে মনোভাবের সাদৃশ্য নিরপেক্ষ চল হিসেবে সৃষ্টি হয়। এই পূরণকৃত প্রশ্নমালা দেখানোর পর প্রত্যেক পারীক্ষকে কল্পিত উত্তরদাতাকে সে কতখানি পছন্দ করে তা নির্দেশ করতে বলা হয়। ফলাফল মনোভাবের সাদৃশ্য ও আকর্ষণের মধ্যে রৈখিক (linear) ইতিবাচক সম্পর্ক নির্দেশ করে; অর্থাৎ, নিজের ও কল্পিত ব্যক্তির মনোভাবের সাদৃশ্য বেশি হলে আকর্ষণ বেশি এবং সাদৃশ্য কম হলে আকর্ষণও অপেক্ষাকৃত কম হতে দেখা যায়। পরবর্তী আরও অনেক গবেষণায় দেখা যায় ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সংলক্ষণ ও পারস্পরিক মূল্যবোধে অনেক বেশি সাদৃশ্য থাকে (ইজার্ড, ১৯৬০; রোজেনফেন্ড ও জ্যাকসন, ১৯৬৫; বেগম ও খানম, ১৯৮৩)।
নিউকম্ব ও অন্যান্য গবেষকদের গবেষণালব্ধ তথ্য একথাই নির্দেশ করে যে, মনোভাবের সাদৃশ্য পারস্পরিক আকর্ষণ সৃষ্টি করে এবং এই আকর্ষণের ফলে পারস্পরিক ভারসাম্যের সৃষ্টি হয়। কোনো রকম ভারসাম্যহীনতা সূচিত হলে আকর্ষণ অথবা অন্যের বা নিজ মনোভাবের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের মাধ্যমে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনবার প্রক্রিয়া শুরু হতে দেখা যায়।
স্যাম্পসন ও ইনস্কো (১৯৬৪)-এর গবেষণায় এর প্রমাণ পাওয়া যায়। গবেষকদ্বয় দুটো ভারসাম্যপূর্ণ ও দুটো ভারসাম্যহীন অবস্থার সৃষ্টি করেন। ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থার একটিতে পারীক্ষদের মধ্যে তাদের সঙ্গীদের পছন্দ করার মতো অবস্থা সৃষ্টি করা হয়; অর্থাৎ, তারা দেখতে পায় সঙ্গীরা এমন সব মতামত প্রদান করছে যা পারীক্ষদের মতামতের অনুরূপ। অপর অবস্থায় সঙ্গীদের অপছন্দ করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়; অর্থাৎ, এখানে সঙ্গীদের ভিন্ন ধরনের মতামত প্রদান করতে দেখা যায়। ভারসাম্যহীন অবস্থা দুটি এমনভাবে সৃষ্টি করা হয় যাতে পারীক্ষরা দেখতে পায় যে তাদের পছন্দনীয় সঙ্গীরা তাদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করছে এবং অপছন্দনীয় সঙ্গীরা তাদের সাথে একমত হচ্ছে। এইসব পরীক্ষণ পরিস্থিতি থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থার তুলনায় ভারসাম্যহীন অবস্থায় পারীক্ষরা তাদের মতামতের পরিবর্তন অপেক্ষাকৃত বেশি করেছে।
সংক্ষেপে বলা যায়, নিউকম্ব-এর ভারসাম্য তত্ত্ব অনুসারে ব্যক্তিরা একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা সৃষ্টির জন্য চেষ্টা করে। যখন ব্যক্তি 'ক' এবং 'খ' একে অন্যের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে এবং তাদের প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে উভয়ে একমত পোষণ করে, তখন ভারসাম্য বজায় থাকে। যখন ভারসাম্যহীনতা দেখা যায় তখন ভারসাম্য ফিরিয়ে আনবার জন্য অবহিতিমূলক পরিস্থিতির এক বা একাধিক অংশ পরিবর্তিত হয়। বলাবাহুল্য এইসব অংশের একটি অপরটির উপর প্রভাব ফেলে থাকে। ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যাপারে নিজ মনোভাব ও দলীয় সদস্যদের প্রতি মনোভাবের একটি তাৎপর্য রয়েছে। নিউকম্ব ও অন্যান্য গবেষক প্রকৃত দলের উপর বিভিন্ন গবেষণা পরিচালনা করে সাদৃশ্য তত্ত্বের সমর্থনে তথ্য প্রদান করেন।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায় যে, সমাজজীবনে আকর্ষণের বিষয়টি প্রকৃতিগতভাবে পারস্পরিক। একজন ব্যক্তি যেমন অন্য একজনের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে; একই সাথে এটাও চায় যে, অন্যরাও তার প্রতি আকর্ষিত হোক। এ কারণে ব্যক্তি আকর্ষণ অনুভবকারী ব্যক্তির প্রশংসা করে এবং তাকে সমর্থন করে। একই সাথে নিজের আচরণের মাধ্যমে অন্যের নিকট আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে চায়।