পারস্পরিক আর্কষণের বিনিময়তত্ত্ব
মানবেতিহাসের ক্রমোন্নতির ধারা লক্ষ করলে দেখা যায়- সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের পরিচিতির মূলে ভূমিকা পালন করেছে তাদের মধ্যকার পারস্পরিক আকর্ষণ। এরূপ পারস্পরিক আকর্ষণের সূত্র ধরে গড়ে উঠেছে মানবগোষ্ঠী, সমাজ, পরিবার এবং বন্ধুত্ব। পারস্পরিক আকর্ষণ বলতে কোনো একজন ব্যক্তির প্রতি অন্য ব্যক্তির এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতাকে বোঝায়।
আকর্ষণের বিভিন্ন মাত্রা রয়েছে; যেমন- ভালোবাসা, পছন্দ, অপছন্দ ইত্যাদি ক্ষেত্রে অতিশয় ধনাত্মক, অনিশ্চিত এবং অতিশয় ঋণাত্মক সম্পর্ক হতে পারে।
নিম্নে পারস্পরিক আকর্ষণের বিনিময়তত্ত্ব আলোচনা করা হলো-
বিনিময়তত্ত্ব
পারস্পরিক আকর্ষণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ হলো বিনিময়তত্ত্ব। থিবো ও কেলী (১৯৫৯) এবং হোমাঙ্গ (১৯৬১) পৃথকভাবে পারস্পরিক আকর্ষণের এমন একটি ব্যাখ্যার অবতারণা করেছেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য রয়েছে। উভয়ের মতবাদই পারস্পরিক ক্রিয়ায় পুরস্কার বিনিময় (exchange) এবং খরচ (cost) এই দুইটি ধারণা দ্বারা সামাজিক আকর্ষণের ব্যাখ্যা করেছে।
এই তত্ত্বের মূল কথা হলো পারস্পরিক ক্রিয়ায় ব্যক্তির পুরস্কারের মাত্রা খরচের তুলনায় বেশি হলে একে অপরের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে এবং দুজনের মধ্যে একটি ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। চারটি মৌলিক ধারণা (concept), যথা- পুরস্কার (reward), খরচ (cost), ফলাফল (outcome) এবং তুলনার স্তর (comparison level)-এর সাহায্যে পারস্পরিক আকর্ষণকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
১. পুরস্কার: পারস্পরিক সম্পর্কে যে কোনো ধরনের আচরণ বা প্রতিক্রিয়া যা ব্যক্তির চাহিদা পূরণে অবদান রাখে তাকেই পুরস্কার বলে অভিহিত করা হয়।
২. খরচ: 'খরচ' শব্দটিও বেশ ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। 'খরচ' বলতে শুধু শাস্তিকেই বোঝায় না। কোনো কাজ করবার ক্লান্তি, দুশ্চিন্তা, ভোগান্তি প্রভৃতি বোঝায়। এমনকি কোনো কাজে ব্যাপৃত হওয়ার জন্য কতটুকু পুরস্কার হাতছাড়া হলো তাও 'খরচ' এর অন্তর্ভুক্ত।
৩. ফলাফল: 'ফলাফল' বলতে খরচ বাদে পুরস্কার বোঝায়। পারস্পরিক ক্রিয়ার ইতিবাচক ফলাফলকে 'লাভ' (profit) এবং নেতিবাচক ফলাফলকে 'ক্ষতি' (loss) বলা হয়।
৪. তুলনার স্তর: অন্য ব্যক্তির সাথে পারস্পরিক আদান-প্রদানের পর ব্যক্তি লাভবান হলেই যে একজন অন্যজনকে পছন্দ করবে এমন নয়। আকর্ষণ অনুভব করার জন্য ফলাফলকে অবশ্যই সর্বনিম্ন প্রত্যাশা সীমার ঊর্ধ্বে যেতে হবে। একেই 'তুলনার স্তর' বলে। এই তুলনার স্তর কোনো পারস্পরিক সম্পর্কের অভিজ্ঞতা, অন্যান্য ব্যক্তিরা কী ধরনের ফলাফল লাভ করছে এবং সে কী লাভ করছে সে সম্বন্ধে ধারণা প্রভৃতি দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে থাকে।
পারস্পরিক আকর্ষণকে এভাবে ব্যাখ্যা করার দুটো সুবিধা রয়েছে-
প্রথমত, কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তি অন্যের কাছে কেন বেশি আকর্ষণীয় হয় অথবা কেন এক ধরনের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তি অন্যধরনের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিকে পছন্দ করে-এই তত্ত্ব তার সংগত ব্যাখ্যা দিতে পারে।
দ্বিতীয়ত, একটি দলের সদস্যদের মধ্যে আকর্ষণের যে পরিবর্তন দেখা যায় সেই পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকে এই তত্ত্ব সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। সমবৈশিষ্ট্য ও বিপরীত বৈশিষ্ট্যের ব্যাখ্যা: একই ধরনের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিরা কেন একে অপরের প্রতি আকর্ষিত হয় তার ব্যাখ্যা, হিসেবে বিনিময়তত্ত্ব উল্লেখ করে যে দুজন ব্যক্তির মনোভাব, মূল্যবোধ বা সামাজিক পদমর্যাদার সাদৃশ্য থাকলে পারস্পরিক ক্রিয়া বা আচরণে দুজনের পুরস্কারের মাত্রা খরচের তুলনায় বেশি হয়। তাই একই বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিরা একে অপরকে পছন্দ করে। বিপরীত বা ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিরা কেন পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে, সে সম্বন্ধে বিনিময়তত্ত্বের ব্যাখ্যা হলো একজনের চাহিদা অপরজনের চাহিদার সম্পূরক হলেও ব্যক্তির পুরস্কারের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে। এবং যে কোনো দুই বা ততোধিক ব্যক্তির পারস্পরিক ক্রিয়ায় খরচের তুলনায় পুরস্কারের মাত্রা বৃদ্ধি গেলেই পারস্পরিক আকর্ষণের সৃষ্টি হতে পারে।
সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য
এইভাবে বিনিময়তত্ত্ব বৈশিষ্ট্যগত সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য উভয় ক্ষেত্রের পারস্পরিক আকর্ষণকে যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। তাছাড়া আকর্ষণের হ্রাসবৃদ্ধি বা স্থিতিশীলতাকেও এই তত্ত্বের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। কোনো সঙ্গীর কাছ থেকে পারস্পরিক ক্রিয়ার মাধ্যমে যা একজন ব্যক্তি বর্তমানে পাচ্ছে তার তুলনায় ব্যক্তির প্রত্যাশার সীমা যদি বৃদ্ধি পায় অথবা অধিকতর পুরস্কৃত হওয়ার বিকল্প সুযোগ যদি তার নাগালের মধ্যে থাকে তাহলে সেই সঙ্গীর প্রতি ঐ ব্যক্তির আকর্ষণ হ্রাস পেতে পারে। অন্যদিকে প্রত্যাশার হ্রাস-বৃদ্ধি না-হলে অথবা বেশি পুরস্কার লাভের বিকল্প সুযোগ না-থাকলে আকর্ষণের মাত্রা স্থিতিশীল থাকা স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে পারস্পরিক বিনিময়ে পুরস্কারের মাত্রা যত বৃদ্ধি পাবে আকর্ষণও তত বৃদ্ধি পাবে। নৈকট্যের ব্যাখ্যা: নৈকট্য কীভাবে আকর্ষণ বৃদ্ধি করে সে সম্বন্ধে থিবো ও কেলী বিনিময়তত্ত্বের সাহায্যে (১৯৫৯) বিভিন্ন প্রকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
প্রথমত: বিনিময়তত্ত্বে কাছাকাছি থাকার জন্য পরস্পর পুরস্কৃত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
দ্বিতীয়ত: যারা কাছাকাছি বাস করে তারা প্রায়ই সদৃশ বৈশিষ্ট্যের হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, এক এলাকায় বসবাসকারী ব্যক্তিরা, সচরাচর একই আর্থ-সামাজিক অবস্থার হয়ে থাকে। 'একই পদমর্যাদাবিশিষ্ট হওয়ার কারণে তাদের মূল্যবোধে সাদৃশ্য অপেক্ষাকৃত বেশি হতে পারে।
তৃতীয়ত: পারস্পরিক ক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তিবর্গ তথ্যের আদানপ্রদান করে। এই আদানপ্রদান সাদৃশ্য বৃদ্ধি করে যা পরবর্তীকালে পারস্পরিক আকর্ষণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
চতুর্থত: পারস্পরিক আকর্ষণ যত চলতে থাকে তত একজন অপরজনের আচরণ সম্বন্ধে অপেক্ষাকৃত ভালোভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। এতে করে পারস্পরিক ক্রিয়ায় খরচের মাত্রা হ্রাস পায় এবং পুরস্কারের মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
সর্বশেষ কারণটি হলো যারা কাছাকাছি বাস করে তাদের পারস্পরিক ক্রিয়া করার জন্য সময় ও প্রচেষ্টা অপেক্ষাকৃত কম লাগে, অর্থাৎ, বিনিময়তত্ত্বের ভাষায়, এক্ষেত্রে খরচ কম হয় যা পারস্পরিক আকর্ষণ সৃষ্টিতে সহায়ক হতে পারে। উপর্যুক্ত ব্যাখ্যাসমূহ বিভিন্ন গবেষণালব্ধ তথ্য দ্বারা সমর্থিত হয়েছে (সিডাউস্কি ও অন্যান্য, ১৯৫৬; সিডাউস্কি, ১৯৫৭; বিনিময়তত্ত্বের কেলী ও অন্যান্য, ১৯৬২)। থিবো ও কেলী এবং হোমাগ বিভিন্ন গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বিনিময়তত্ত্বের সত্যতা প্রমাণের প্রয়াস পেয়েছেন। বিনিময়তত্ত্বের ব্যাখ্যা সমর্থনকারী এসব গবেষকের মধ্যে জেনিংস (১৯৫০) কিড (১৯৫১) বনি, হবটি ও ডেসার (১৯৫৩)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
উপসংহার
বিনিময়তত্ত্ব একদিকে যেমন পারস্পরিক আকর্ষণ কীভাবে সৃষ্টি হয়; তার প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করেছে, তেমনি পারস্পরিক আকর্ষণের পরিবর্তন বা হ্রাসবৃদ্ধি কীভাবে হয় অথবা আকর্ষণ কখন স্থিতিশীল থাকে এসব বিষয়কেও ব্যাখ্যা করেছে। তাছাড়া পারস্পরিক বৈশিষ্ট্যগত সাদৃশ্য এবং চাহিদা সম্পূরকতা কীভাবে কার্যকর হয় তারও সংগত ব্যাখ্যা এই তত্ত্বে পাওয়া যায়। এমনকি নৈকট্য উপাদানটি পারস্পরিক সম্পর্ক সৃষ্টিতে কীভাবে কাজ করে বিনিময়তত্ত্ব তারও সুস্পষ্ট ও সংগতিপূর্ণ ব্যাখ্যা প্রদান করেছে। এসব দিক থেকে বিবেচনা করলে বিনিময়তত্ত্ব নিঃসন্দেহে পারস্পরিক আকর্ষণের বিষয়টিকে বিশ্লেষণে প্রশংসার দাবিদার।