জনমত গঠনের উপাদানসমূহ

গণতন্ত্রের প্রথম ও প্রধান ভিত্তি হচ্ছে জনমত। জনমতকে পুঁজি করে গণতান্ত্রিক সরকার রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। কেননা সুসংগঠিত ও সদাজাগ্রত জনমত ছাড়া গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে না। প্রত্যেক রাষ্ট্রেই এই জনমত গঠনের কতগুলো মাধ্যম বা বাহন রয়েছে। এই সকল মাধ্যমের সাহায্যে জনমত গঠিত হয়।

জনমত

শাব্দিক অর্থে জনমত বলতে জনগণের মতামতকে বোঝায়। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানে জনমত বলতে ভিন্ন অর্থে ব্যবহার হয়ে থাকে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চিন্তাবিদ জনমতকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। নিম্নে তাদের কতিপয় সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো-

সমাজবিজ্ঞানী জিন্সবার্গ বলেছেন, 

'জনমত হচ্ছে সমাজে বসবাসকারী মানুষের মানসিক ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার ফল।'

সুতরাং বলা যায়, 

জনমত হলো সমকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাবলি বা অন্য কোনো বিষয় সম্পর্কে সুচিন্তিত জনহিতকর সেসব সুদৃঢ় মতামত: যেগুলো সরকার ও জনগণকে প্রভাবিত করতে সক্ষম।

জনমত গঠনের উপাদানসমূহ 

জনমত স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠে না। কতগুলো বাহনের মাধ্যমে জনমত গড়ে উঠতে পারে। যে সকল বাহন বা মাধ্যম জনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে তন্মধ্যে বিশেষ বিশেষ মাধ্যম বা বাহনসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো-

১. পরিবার: 

জনমত গঠনের প্রাথমিক মাধ্যম হচ্ছে পরিবার। পরিবারে মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং পরিবারেই তার বৃদ্ধি, প্রসার ও বিকাশ ঘটে। পরিবারেই শিশু প্রথমে পাঠ শুরু করে এবং তার চিন্তা ও বিবেকের বিকাশ ঘটে থাকে। পরিবারের সদস্যগণ বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করে। তারা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয় সম্পর্কে অনেক কিছু অবগত হয় আর তাতে বিভিন্ন বিষয়ে জনমত গড়ে উঠতে পারে।

২. বন্ধুবান্ধব: 

শিশু যখন শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে এবং যৌবনে পদার্পণ করে তখন সে তার পরিবার থেকে বেরিয়ে আসে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বন্ধুবান্ধব ও খেলার সাথির সাথে মিশে যায়। তাদের সাথে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে এক ধরনের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। জনমত প্রকাশে বন্ধুবান্ধবের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। 

৩. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সুষ্ঠু জনমত গঠনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে পড়ালেখা করা হয়। এসময়ে ছাত্র-ছাত্রীগণ সমাজ ও রাষ্ট্র-সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে সঠিক ও নির্ভুল জ্ঞান অর্জন করে। স্কুল- কলেজে ছাত্রদের জ্ঞানের বিকাশ সাধন হয়। তারা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ চিন্তা করার সুযোগ পায়। তাদের এ স্বাধীন ও মুক্তচিন্তা বলিষ্ঠ জনমত গঠনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৪. রাজনৈতিক দল: 

জনমত গঠনের অন্যতম বাহন হলো রাজনৈতিক দল। স্বতন্ত্র আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কার্যক্রমের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে। একটা রাষ্ট্রের বিভিন্ন সমস্যা রাজনৈতিক দল জনগণের সামনে নিয়ে আসে এবং জনমত তৈরি করে। উপরন্তু রাজনৈতিক দলসমূহ জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ করে থাকে। একথা অনস্বীকার্য যে, প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক সরকারের প্রধান চালিকাশক্তি জনমত কখনও রাজনৈতিক দলসমূহের সাহায্য ছাড়া সুন্দরভাবে ও কার্যকরভাবে প্রণীত ও বাস্তবায়িত হতে পারে না।

৫. সভা-সমিতি: 

সভা-সমিতির দ্বারা জনমত গড়ে ওঠে। দেশের রাজনৈতিক দলসমূহ সভা-সমিতির মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সমস্যাদি সম্পর্কে জনগণের মধ্যে চিন্তাভাবনার উন্মেষ ঘটাতে সক্ষম হন। সভা-সমিতি জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভৃতি বিষয় সভা-সমিতিতে আলোচনা হয়ে থাকে। সাধারণ জনগণ এ আলোচনা থেকে অনেক কিছু জানতে পারে এবং তারা সচেতন হয়ে ওঠে, ফলে তাদের মধ্যে জনমত তৈরি হয়।

৬. গণমাধ্যম: 

গণমাধ্যম হলো জনমত তৈরির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। গণমাধ্যমের মধ্যে আছে রেডিও, টেলিভিশন, বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যম। পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে দেশের সর্বস্তরের শিক্ষিত সমাজ দেশের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত হতে পারে। অপরদিকে, রেডিও ও টেলিভিশন অশিক্ষিত ও শিক্ষিত সকল শ্রেণির মানুষের কাছে দেশের খবরা- খবর পৌঁছে দেয়। ফলে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে জনমত জাগ্রত হয়।

৭. সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যম: 

সাম্প্রতিক সময়ে জনমত গঠনের সবচেয়ে বড়ো মাধ্যম হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ- মাধ্যম; যেমন- ফেসবুক, টুইটার প্রভৃতি। এসকল মাধ্যমে বর্তমান সময়ে যেকোনো বিষয়ে অতি দ্রুত মানুষের কাছে যেকোনো খবর পৌঁছে দেয়া যায় এবং জনমত গঠন করা সম্ভব হয়।

৮. পত্রপত্রিকা: 

নির্বাচনের প্রাক্কালে সভা-সমিতিতে বক্তৃতার ঝড় ওঠে, আলাপ-আলোচনা হয় এবং জনমত সংগঠিত হয়। নির্বাচনে তাই জনমতের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

৯. আইনসভা: 

আইনসভা হলো রাজনৈতিক দলগুলোর বিশেষ কর্মক্ষেত্র, আইনসভায় বিতর্ক, সমালোচনা ও প্রশ্নোওরের মাধ্যমে সরকার ও বিরোধী দল পরস্পরের দোষ-ত্রুটিগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরে এবং স্ব-স্ব দানের উৎকর্ষ প্রমাণ করে জনমত গঠনের প্রচেষ্টা চালায়।

১০. পেশা বা ব্যবসা: 

ব্যক্তি তার পেশায় বা ব্যবসায় বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। এর প্রেক্ষিতে সে যেকোনো নতুন মত গ্রহণ বা পুরাতন মত পরিবর্তন করতে পারে। বর্তমানে শ্রমিক ইউনিয়ন, কৃষকসমিতি ও অন্যান্য পেশাভিত্তিক সংঘ প্রায়ই জনমতকে প্রভাবিত করে। ব্যক্তি তার পেশায় বা ব্যবসায়ে নিয়োজিত থেকে তার চাকরি, মজুরি, দ্রব্যমূল্য ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য ও মতামত লাভ করে। এভাবে পেশা বা ব্যবসা ব্যক্তির মতামত গঠনে সহায়ক হয়।

১১. ধর্মীয় সংঘ: 

জনমত গঠনে ধর্মীয় সংঘগুলোর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। অনেক ধর্মীয় নেতাই সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করেন বা রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচার করেন। দেশের বিভিন্ন সম্পর্কে ধর্মীয় নেতা ও সংঘগুলোর মতামত তাদের অনুগত ভক্তদের মতামতকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। অনেক দেশেই ক্যাথলিক গির্জা কোনো শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রবিন্দু। 

১২. গ্রন্থসমূহ: 

গ্রন্থ ও বিভিন্ন প্রকাশিত পুস্তিকাও জনগণকে তথ্য ও ভাবধারা প্রদান করে। আর এভাবে এগুলো তাদের মত গঠনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করে।

উপসংহার 

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, উল্লিখিত মাধ্যমগুলো জনমত গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আধুনিক যুগে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি এতই জটিল যে, সাধারণ মানুষ এগুলোকে বুঝতে পারে না। বস্তুত এ মাধ্যমগুলোই জনগণের মতামত সৃষ্টি করে। বর্তমানে প্রত্যেক দেশেই গণমাধ্যমের সাহায্যেই জনমত গড়ে ওঠে। গণ-মাধ্যমের অনুকরণেই সংখ্যাগুরুর মতামত গড়ে ওঠে এবং প্রচারকৌশলে সেই মতামতই জনমতের রূপ পরিগ্রহ করে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url