ফলপ্রসূ প্রচারণার কৌশলসমূহ

প্রচারণা মনোবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রাচীনকাল থেকে মানুষের চিন্তাধারা ও কার্যাবলিকে প্রভাবিত করার জন্য প্রচারণা ব্যবহৃত হচ্ছে। আধুনিক যুগে কোনে কিছুর সফলতা প্রচারণার ওপর নির্ভর করে। কোনো পণ্যের প্রচারণার ওপর এর সফলতা নির্ভর করে। প্রচারণার গুরুত্ব নিয়ে সমাজ মনোবিজ্ঞানিগণ আলোচনা করেছেন। প্রচারণার জন্য প্রচারণাকারী বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে থাকে। প্রচারণা বিশ্লেষণের জন্য আমেরিকাতে একটি প্রচারণা-প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছিল। প্রচারণা: প্রচারণা শব্দটি ল্যাটিন প্রতিশব্দ Propaganda থেকে উৎপত্তিলাভ করেছে। Propaganda শব্দের অর্থ হচ্ছে জন্ম দেয়া বা উৎপাদন করা। প্রচারণার একটি সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের আচরণের পরিবর্তন ঘটানো। ব্যক্তির মতামত এবং মনোভাবকে প্রভাবিত করার জন্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সুসংগঠিত সুসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রচেষ্টাই হচ্ছে প্রচারণা। 

প্রচারণার সংজ্ঞা 

সমাজ মনোবিজ্ঞানিগণ বিভিন্নভাবে প্রচারণার সংজ্ঞা দিয়েছেন। নিম্নে কতিপয় সংজ্ঞা প্রদত্ত হলো-

জেমস ড্রেভাবের মতে, 

অভিভাবন এবং আবেগাপ্লুত শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তি বা জনসাধারণের মধ্যে কোনো বিশেষ মনোভাব সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে সুসংগঠিত প্রচেষ্টাকে প্রচারণা বলে। 

সমাজ মনোবিজ্ঞানী নিউকোম্বের মতে, 

'প্রচারণা হলো গণযোগাযোগের মাধ্যমে মনোভাবকে প্রভাবিত করার এক নিয়মতান্ত্রিক প্রচেষ্টা।'

সমাজ মনোবিজ্ঞানী ডুবের মতে, 

'প্রচারণা হলো কোনো স্বার্থসম্পন্ন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের অভিভাবনের মাধ্যমে দলের ব্যক্তিবর্গের মনোভাবকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং ফলত তাদের কার্যাবলিকে নিয়ন্ত্রণ করার এক সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রচেষ্টা।' 

উপর্যুক্ত সংজ্ঞার ভিত্তিতে বলা যায়,  

ব্যক্তির অনুভূতি, চিন্তা ও মনোভাবকে নিয়ন্ত্রণ করে তার আচরণকে প্রভাবিত করার কৌশলকে প্রচারণা বলে।

প্রচারণার কৌশল 

প্রচারণার প্রকৃতি বোঝার জন্য আমেরিকায় একটি প্রচারণা-প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়। প্রচারণার জন্য প্রচারকগণ যে সকল কলাকৌশল অবলম্বন করেন, নিম্নে সেগুলো বর্ণনা করা হলো-

১. চাকচিক্যময় ও শ্রুতিমধুর শব্দের ব্যবহার: 

প্রচারণার অন্যতম কৌশল হচ্ছে চাকচিক্যময় ও শ্রুতিমধুর শব্দের ব্যবহার করা। নিজের সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে গিয়ে মানুষ কিছু অভাবনীয় শব্দ ব্যবহার করে থাকে; যেমন- ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও দেশপ্রেম প্রভৃতি মন ভোলানো শব্দ ব্যবহার করে থাকে। বর্তমানে সরকার নিজেদের গণতান্ত্রিক, দেশপ্রেমিক বলে প্রচারণা চালায়।

২. প্রশংসাপত্রের ব্যবহার: 

প্রচারণার একটি কৌশল হচ্ছে প্রশংসাপত্রের ব্যবহার। কোনো মহান ব্যক্তির প্রশংসাপত্রের সাথে নিজেকে প্রচারণা করার প্রবণতা মানুষের মধ্যে দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় কোনো নির্বাচনে যোগ্য ব্যক্তির প্রশংসাপত্রের সাহায্য নেয়া হয়। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ও জিয়ার প্রশংসাপত্রের সহায়তা নেয়া হয়।

৩. সহজ-সরলভাবে নিজেকে উপস্থাপন: 

কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে ঐ ব্যক্তিকে সহজ সরল ও সাদাসিধে ব্যক্তি হিসেবে জনসাধারণের কাছে তুলে ধরা হয়; যেমন নির্বাচনী প্রচারণার জন্য প্রার্থীর চরিত্রের অমায়িক ও সাদাসিধে গুণগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়। অনেক সময় দেখানো হয় প্রার্থী লুঙ্গি বা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে বাগানে কাজ করছে কিংবা কৃষকদের সাথে ব...বার খাচ্ছে ইত্যাদি।

৪. হুজোগ সৃষ্টিকরণ: 

প্রচারণার আর একটি কৌশল হচ্ছে হুজোগ সৃষ্টিকরণ। একটা বিশেষ ঘটনা ঘটে যাচ্ছে বা একটা লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে এরূপ হুজোগ সৃষ্টি করা হয়। নির্বাচনের আগে প্রত্যেক দলই বলে আমরা জিতে যাচ্ছি, সবাই আমাদের সমর্থন করছে তোমরাও আমাদের সাথে এসো। ব্যবসায়ী মহলে এই কৌশলও তাদের বিজ্ঞাপনের কাজে লাগিয়ে থাকে। বিশেষ দ্রব্য- হ্রাসকৃত মূল্যে বিক্রয় করা হচ্ছে, আগে আসলে আগে পাবেন তিন দিনের জন্য এই সুযোগ- এই জাতীয় বিজ্ঞাপন অনেক সময় হুজোগ সৃষ্টি করে থাকে।

৫. স্লোগান: 

প্রচারের অন্যতম কৌশল হচ্ছে স্লোগান। প্রচারে যেসব স্লোগান ব্যবহৃত হয় তা খুব সংক্ষিপ্ত, সময়োপযোগী এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী হবে। আবার আবেগোদ্দীপক শব্দ দিয়ে স্লোগান দিয়ে তার প্রতি ব্যক্তি আকৃষ্ট হতে পারে, প্রচারকারী স্লোগানের সাহায্যে জনগণের মনোযোগ আকৃষ্ট করে।

৬. গালিগালাজ করা: 

সমাজে প্রতিপক্ষ দলা বা লোকদের সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে গিয়ে প্রতিপক্ষকে অনেক সময় গালি দেয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে এমন কতিপয় শব্দ উচ্চারণ করা হয় যা খুব নিন্দনীয়। প্রতিপক্ষ দলকে হেয় করার জন্য তাদেরকে নাস্তিক, ফ্যাসিস্ট প্রভৃতি বলা হয়।

৭. মর্যাদাসম্পন্ন প্রতীকের ব্যবহার: 

প্রচারণার একটি কৌশল হচ্ছে মর্যাদাসম্পন্ন প্রতীকের ব্যবহার। নিজেকে প্রচার করার জন্য কোনো মর্যাদাসম্পন্ন প্রতীকের সাথে ছবির প্রচারণা চালানো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নির্বাচনে নিজের ছবির সাথে বঙ্গবন্ধুর ছবি সংযোজন করে, জাতীয় পতাকার ও মানচিত্রের সাথে নিজেদের ছবি সংযোজন করে প্রচারণা চালানো হয়ে থাকে।

৮. সাক্ষ্য ও উক্তির ব্যবহার: 

নিজের বা দলের প্রচারের লক্ষ্যে কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির সাক্ষ্য ও উক্তির সহায়তা নেয়া হয়। কোনো পণ্যের প্রচারণার জন্য বিখ্যাত নায়ক, খেলোয়াড় ও নায়িকাদের সাক্ষ্য ও উক্তি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

৯. পুনরাবৃত্তি: 

প্রচারণার একটি কৌশল হচ্ছে পুনরাবৃত্তি। কোনো দ্রব্য যদি বারবার ক্রেতাদের সামনে তুলে ধরা হয় তা ক্রেতাদের মনোযোগ আকৃষ্ট করবে। হিটলার তাঁর Mein Kampt গ্রন্থে সফল প্রচারণার জন্য পুনরাবৃত্তির কথা উল্লেখ করেন। একই কথা বারবার বলাই হচ্ছে প্রচারের সাফল্যের প্রথম ও প্রধান কারণ। জার্মানির প্রচারমন্ত্রী গোয়েবলস ঐ সময় বলেন, একটি মিথ্যা কথা একশত বার বললে লোকে তা সত্য বলে মনে করতে আরম্ভ করবে।

১০. তথ্য-বিকৃতি: 

প্রচারণার উল্লেখযোগ্য কৌশল হচ্ছে তথ্যবিকৃতি। প্রচারণার ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বীর বক্তব্য ও অভিমতকে বিকৃতভাবে তুলে ধরা হয়। তবে এগুলো কৌশলে করা হয়।

১১. প্রতিকূল মনোভাব সৃষ্টি: 

প্রচারের ক্ষেত্রে জনসাধারণের মধ্যে প্রতিকূল মনোভাব সৃষ্টি করে। জনগণের প্রেষণার প্রতি দৃষ্টি রেখে কোনো দ্রব্য তৈরি করা হলে তা খুব সহজেই প্রচার করা যাবে। প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিত্বের প্রেষণা রয়েছে। প্রচারণা হচ্ছে জনযোগাযোগের মাধ্যমে জনগণের মনোভাবকে প্রভাবিত করা।

উপসংহার 

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্রচারণার ক্ষেত্রে প্রচারণাকারী বিভিন্ন কৌশল নিয়ে থাকে। সঠিক প্রচারণার মাধ্যমে কোনো দ্রব্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সৃষ্টি করা হয়। প্রচারণার ক্ষেত্রে প্রচারণা কৌশলসমূহ ব্যবহৃত হয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url