শারীরবৃত্তীয় মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু
মনোবিজ্ঞান হলো আচরণ ও মানসিক প্রক্রিয়ার বিজ্ঞানসম্মত অনুধ্যান। মনোবিজ্ঞানের একটি মৌলিক শাখা হলো শারীরবৃত্তীয় মনোবিজ্ঞান। এটিকে মৌলিক বিজ্ঞানও বলা হয়।
শারীরবৃত্তীয় মনোবিজ্ঞান
শারীরবৃত্তীয় মনোবিজ্ঞান জীবের আচরনের বিজ্ঞানসম্মত শারীরতাত্ত্বিক আলোচনা করে। এটি মনোবিজ্ঞানের একটি মৌলিক শাখা। জীবের আচরনের মৌলিক ভিত্তি সম্বন্ধে জানা এবং জীবদেহে কিভাবে মানসিক কার্যাবলী সম্পাদিত হয় তার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা রয়েছে শারীরবৃত্তীয় মনোবিজ্ঞানে।
শারীরবৃত্তীয় মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু
শারীরবৃত্তীয় মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ
ক. শারীরবৃত্তীয় গঠন ও সংবেদনমূলক কার্যাবলী:
১. সংবেদী গ্রাহকযন্ত্র: প্রাণী মাত্রই উদ্দীপনার প্রতি সংবেদনশীলতা প্রকাশ করে। বাহ্যিক উদ্দীপক এবং অভ্যন্তরীন উদ্দীপক নানাভাবে প্রাণীকে উদ্দীপিত করে। উদ্দীপনা গ্রহণ করার জন্য জীবদেহে বিভিন্ন প্রকার সংবেদী অঙ্গ বা সংগ্রাহক যন্ত্র রয়েছে। এ সকল যন্ত্রের মাধ্যমে জীব প্রতিক্রিয়ত উদ্দীপক গ্রহণ করে এবং আলোড়িত হয়।
বিভিন্ন প্রকার গ্রাহক যন্ত্রের মধ্যে রয়েছেঃ রসায়নিক গ্রাহক, যান্ত্রিক গ্রাহক, তাপীয় গ্রাহক, আলোক গ্রাহক।
উপরোক্ত গ্রাহক যন্ত্রেগুলোর মধ্যে রাসায়নিক গ্রাহক স্বাদ এবং ক্ষরণমূলক উদ্দীপক, যান্ত্রিক গ্রাহক শ্রবণমূলক উদ্দীপক, তাপীয় গ্রাহক স্পর্শ বা চাপমূলক উদ্দীপক এবং আলোর গ্রাহক দৃশ্যমূলক উদ্দীপকের প্রতি সাড়া দেয় এবং সম্পর্ক যুক্ত ঘটনা প্রত্যক্ষ করে।
২. নিউরোঅ্যান্টমি: শারীরবৃত্তীয় মনোবিজ্ঞানে মৌলিক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু হলো স্নায়ুতন্ত্রের গঠন এবং এর কার্যাবলী অধ্যয়ন। এর মধ্যে রয়েছে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ (যেমন, কর্টেক্স, লিম্বিক সিস্টেম, ব্রেনস্টেম), মেরুরজ্জু এবং পেরিফেরাল স্নায়ুতন্ত্রের অধ্যয়ন।
৩. নিউরোকানেকটিভিটি: শারীরবৃত্তীয় মনোবিজ্ঞান আচরনের স্নায়ুবিক গঠনের ও কার্যাবলী পাশাপাশি কার্যপ্রক্রিয়া অধ্যয়নে গুরুত্বারোপ করে। শারীরতাত্ত্বিক মনোবিজ্ঞানীগণ কিভাবে নিউরন বৈদ্যুতিক এবং রাসায়নিক সংকেত প্রেরণ করে, তারা কীভাবে তথ্য একত্রিত করে এবং কীভাবে তারা একে অপরের সাথে সংযোগ রক্ষা করে প্রভৃতি বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা করে থাকেন।
খ. সঞ্চালনমূলক কার্যাবলী অধ্যয়ন:
১. সংবেদনশীল এবং প্রত্যক্ষণ প্রক্রিয়া: এই অঞ্চলে গবেষণা কীভাবে সংবেদনশীল অঙ্গগুলি (যেমন, চোখ, কান, ত্বক) পরিবেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। অতিরিক্তভাবে, এটি অন্বেষণ করে কিভাবে মস্তিষ্ক এই সংবেদনশীল ইনপুটকে প্রক্রিয়া করে এবং ব্যাখ্যা করে, যা উপলব্ধির দিকে পরিচালিত করে। বিষয়গুলির মধ্যে দৃষ্টি, শ্রবণ, স্পর্শ, স্বাদ এবং গন্ধ অন্তর্ভুক্ত।
২. সঞ্চালনমূলক নিয়ন্ত্রণ: শারীরবৃত্তীয় মনোবিজ্ঞান মানুষ ও প্রাণি ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে সঞ্চালনমূলক গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ পর্যালোচনা করে থাকে। এটি সাধারণ প্রতিবর্তী ক্রিয়া থেকে শুরু করে হাঁটা এবং কথা বলার মতো জটিল ক্রিয়াগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে।
৩. আবেগ: শারীরবৃত্তীয় মনোবিজ্ঞান আবেগের স্নায়বিক এবং শারীরবৃত্তীয় ভিত্তি আলোচনা করে। এটি কীভাবে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চল এবং নিউরোট্রান্সমিটারগুলি ভয়, সুখ, রাগ এবং দুঃখের মতো আবেগ তৈরিতে ভূমিকা রাখে তা অধ্যয়ন করে।
৪. শিক্ষা এবং স্মৃতি: শারীরবৃত্তীয় মনোবিজ্ঞান শিক্ষণ এবং স্মৃতি গঠনের অন্তর্নিহিত শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলি অধ্যয়ন করে। প্রাণীর আচরনের পরিবর্তন সমস্যা সমাধানের কৌশল, শিক্ষন ও স্মৃতির বেলায় স্নায়ুতন্ত্রের ভূমিকা ইত্যাদি বিষয় শারীরবৃত্তীয় মনোবিজ্ঞান আলোচনা করে।
৫. পুনঃউদ্দার কার্য: এটি শিক্ষনের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি গতিবাহী কার্য। একজন ব্যক্তি যখন স্টোক করে (মস্তিষ্কের রক্তনালী বিনষ্ট) একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর সে লক্ষণের উন্নতি লাভ করে। একই ভাবে ব্যক্তি কোনো ব্রেইন ইনজুরির কারনে কখনও কখনও তার স্মৃতি এবং অভ্যাস হারিয়ে ফেলতে পারে। তবে এই ইনজুরি যদি মারাত্মক না হয় তাহলে ব্যক্তি পুনরায় তার হারানো অভ্যাস ফিরে পেতে বা পুনঃমিলনের ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। এরূপ ঘটনা দ্বারা এটা প্রমানিত হয় যে, ব্রেইন ইনজুরির ফলে হারানো শিক্ষণ ও স্মৃতি পুনরুদ্ধার সম্ভব।
৬. ব্যক্তি এবং তার বৈকল্য: ব্যক্তির মস্তিষ্কের বৈকল্যের কারনে প্রত্যক্ষন, চেষ্টার কাজ, স্মৃতি এবং কথামালার ক্ষেত্রে কি ধরনের সমস্যা হয়; বৃদ্ধি এবং ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে সৃষ্ট বৈকল্য ইত্যাদি শারীরবৃত্তীয় মনোবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়।
গ. সমন্বয়মূরক কার্যাবলী:
১. নিউরোকেমিস্ট্রি: শারীরবৃত্তীয় মনোবিজ্ঞান মস্তিষ্কে নিউরোট্রান্সমিটার, হরমোন এবং অন্যান্য রাসায়নিক উপাদানের ভূমিকা কীভাবে তারা আচরণ, মেজাজ এবং জ্ঞানীয় প্রক্রিয়াগুলিকে প্রভাবিত করে তা আলোচনা করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্যহীনতা প্রায়ই বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধির সাথে সম্পর্কিত।
২. নিউরোএন্ডোক্রাইনোলজি: শারীরবৃত্তীয় মনোবিজ্ঞান স্নায়ুতন্ত্র এবং গ্রন্থিতন্ত্রের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া অন্বেষণ করে। হরমোন, যেমন কর্টিসল এবং অ্যাড্রেনালিন 'শরীরের চাপের প্রতিক্রিয়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং আচরণ ও আবেগকে প্রভাবিত করে থাকে। গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত হরমন হলো দেহের বৃদ্ধি, ক্ষয়পূরণ, শক্তি ও কার্যক্ষমতার উৎস। দেহের অঙ্গ প্রতঙ্গের সামঞ্জস্য বৃদ্ধি এবং উহাদের কার্যাবলীর মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রয়োজনে গ্রন্থিসমূহ ভূমিকা পালন করে। শারীরবৃত্তীয় মনোবিজ্ঞান গ্রন্থি এবং উহাদের থেকে ক্ষরিত হরমনের কার্যাবলী সম্বন্ধে আলোচনা করে।
ঘ. প্রায়োগিক কার্যাবলী:
১. স্ট্রেস এবং সাইকোফিজিওলজি: সাইকোফিজিওলজি মনস্তাত্ত্বিক চাপের শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়াগুলি অন্বেষণ করে। কীভাবে স্ট্রেস হরমোন, হার্ট রেট, রক্তচাপ এবং অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া মানসিক চাপ দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং কীভাবে তারা আচরণ ও স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে তা শারীরবৃত্তীয় মনোবিজ্ঞান আলোচনা করে।
২. মস্তিষ্কের ইমেজিং কৌশল: মস্তিষ্কের ইমেজিং প্রযুক্তির অগ্রগতি যেমন এমআরআই (ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং), পিইটি (পজিট্রন এমিশন টোমোগ্রাফি), এবং ইইজি (ইলেক্ট্রোয়েন্সফালোগ্রাফি) শারীরবৃত্তীয় মনোবিজ্ঞানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। এই সরঞ্জামগুলোর মাধ্যমে গবেষকদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ, গঠন ও বিভিন্ন জ্ঞানীয় প্রক্রিয়া বর্ণনা করতে সক্ষম হচ্ছে।
৩. স্নায়বিক এবং মানসিক ব্যাধি: শারীরবৃত্তীয় মনোবিজ্ঞানীরা স্নায়বিক অবস্থার এবং মানসিক রোগ যেমন মৃগীরোগ, মাল্টিপল ক্লেরোসিস, বিষণ্ণতা, সিজোফ্রেনিয়া প্রভৃতির শারীরতাত্ত্বিক ভিত্তি অধ্যয়ন করেন। স্নায়বিক ও মানসিক রোগের অন্তর্নিহিত জৈবিক কারণ নির্ণয় এবং কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারনের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৪. ফার্মাকোলজি এবং সাইকোফার্মাকোলজি: শারীরবৃত্তীয় মনোবিজ্ঞানের একটি উচ্চতর ক্ষেত্র হলো সাইকোফার্মাকোলজি। এই সাইকোফার্মাকোলজি স্নায়ুতন্ত্র এবং আচরণের উপর ওষুধ এবং ওষুধের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে। তাছাড়া মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাধির চিকিৎসার জন্য ওষুধের উদ্ভাবন ও উন্নয়নকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
উপসংহার
আলোচনা পরিশেষে বলা যায় যে, শারীরবৃত্তীয় মনোবিজ্ঞান একটি বহুমুখী ক্ষেত্র যা মানব এবং প্রাণীর আচরণের জৈবিক ভিত্তিকে অন্বেষণ করে। এটি মস্তিষ্ক এবং শরীর কীভাবে আমাদের চিন্তাভাবনা, আবেগ এবং ক্রিয়াকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে তা উন্মোচনের জন্য স্নায়ুবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞানের জ্ঞানকে একীভূত করে।