যোগাযোগ এবং যোগাযোগের অবাচনিক সংকেতসমূহ

মানুষের সাথে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক বা যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। যদিও প্রাচীন বা তারও পূর্বে মানুষের ভাষা ব্যতীতই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করত। মানুষ ভাষা ছাড়া তার মুখ, হাত, পা, চোখ, শরীর ইত্যাদি বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাধ্যমে মুখভাব দেহভঙ্গি ইশারা ইত্যাদির সাহায্যে মনের ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে পারস্পরিক যে সম্পর্ক বা যোগাযোগ করে তাকেই অবাচনিক যোগাযোগ বলা হয়।

যোগাযোগ 

যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হলো ভাষা। কিন্তু ভাষা ছাড়াও যোগাযোগের আরও মাধ্যম রয়েছে। ইশারা দেহভঙ্গিমা, মুখভাব ইত্যাদি মানুষের যোগাযোগের আদিমতম প্রক্রিয়া। অনেক সময় মানুষ যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না মুখভাবে তা প্রকাশ করতে পারে। সামাজিক পরিস্থিতির মোকাবেলা করার বাচনিক যোগাযোগকে জোরদার করা এবং বাচনিক যোগাযোগের বিকল্প হিসেবে কাজ করণ ইত্যাদি অব্যাচনিক মাধ্যমগুলোর মুখ্য কাজ (Argle, 1972)। 

একম্যান ও ফ্রিসেন (1969) আবচনিক আচরণকে কার্যকারিতার দিক থেকে ৫টি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করেছেন:

প্রথমত: কিছু আচনিক আচরণ বা হাবভাব প্রতীক হিসেবে কাজ করে। এগুলোকে সহজেই ভাষায় রূপান্তর করা যায়; যেমন- মুচকি হাসি, চোখ রাঙানি ইত্যাদি।

দ্বিতীয়ত: এমন কিছু আচরণ আছে যা বাচনিক ভাষাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। হাত ও মাথা নাড়ানো এ ধরনের আচরণের উদাহরণ।

তৃতীয়ত: অনুভূতি ও আবেগের প্রকাশ ঘটানো।

চতুর্থত: কিছু অবাচনিক আচরণকে নিয়ন্ত্রক হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে, সামাজিক পরিস্থিতিতে কথোপকথন চলতে থাকে বা থেমে যায়।

পঞ্চমত: উপযোজনমূলক অবাচনিক সংকেত। এসব আচরণ হলো চুলকানো, আরামদায়ক ভঙ্গিমা ইত্যাদি। যা শারীরিক চাহিদার সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে উপযোজন কাজে সহায়তা করে।

অবাচনিক যোগাযোগ 

যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। কিন্তু ভাষা ছাড়াও যোগাযোগের আরো মাধ্যম আছে। ইশারা, দেহভঙ্গি, মুখভাব প্রভৃতি মানুষের যোগাযোগের প্রাচীন প্রক্রিয়া। অনেক সময় মানুষ যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না মুখভাবে তা প্রকাশ করতে পারে। সামাজিক পরিস্থিতির মোকাবেলা করার বাচনিক যোগাযোগকে জোরদার করা এবং বাচনিক যোগাযোগের বিকল্প হিসেবে কাজ করা প্রভৃতি অবাচনিক মাধ্যমগুলোর প্রধান কাজ।

অবাচনিক যোগাযোগ-প্রক্রিয়ার সংকেতসমূহ 

মানুষের অবাচনিক আচরণের প্রভাবে একটি যোগাযোগ-প্রক্রিয়ায় সংকেতসমূহকে দশটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। একম্যান ও ফ্রিমেন (১৯৬৯)-এর শ্রেণিবিন্যাসের ভিত্তি ছিল অবাচনকি যোগাযোগ-প্রক্রিয়ায় কার্যগত দিক। নিম্নে অবাচনিক যোগাযোগ-প্রক্রিয়ার সংকেতসমূহ উল্লেখ করা হলো- 

১. দৈহিক সংস্পর্শ: 

অনেক সময় দৈহিক সম্পর্কের দ্বারা পরস্পরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা হয়ে থাকে; যেমন- ধাক্কা দেয়, আঘাত করা, হাত ধরা, আলিঙ্গন করা, স্পর্শ করা, চুমু খাওয়া প্রভৃতির মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক যোগাযোগ ঘটে। শারীরিক সম্পর্কের ব্যাপারে কৃষ্টিতে আশ্চর্য ধরনের পার্থক্য রয়েছে। আফ্রিকা ও আরব দেশের অধিবাসীদের মধ্যে যথেষ্ট দৈহিক সম্পর্ক দেখা যায়। আবার ইংল্যান্ড ও জাপানের অধিবাসীরা এদিক থেকে ভিন্ন।

ইউরোপ ও আমেরিকাতে লিঙ্গ অনুযায়ী দৈহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিপরীত লিঙ্গের সদস্যদের মধ্যে দৈহিক সম্পর্ক অধিক লক্ষ করা যায়। এসব ভেদেও দৈহিক সম্পর্কের মাত্রা তুলনামূলক ভিন্ন হতে পারে; যেমন- শিশুর সাথে দৈহিক স্পর্শ যতখানি ঘটে বয়স্কদের সাথে ঠিক ততখানি ঘটে না। তাছাড়া সম্পর্ক অনুসারেও দৈহিক সম্পর্কের তারতম্য লক্ষ করা যায়।

২. নৈকট্য: 

পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার সময় একজন মানুষ অপরের যত নিকটে অবস্থান করে তা পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে অনেক কিছু প্রকাশ করে; যেমন- নিকটবর্তী অবস্থানে ঘনিষ্ঠতা ও পারস্পরিক আকর্ষণের পরিচায়ক। নৈকট্যের ব্যাপারে পরিবশেগত ও কৃষ্টিগত পার্থক্য রয়েছে। তাছাড়া স্থানকাল পাত্রভেদে নৈকট্যের ব্যাপারেও প্রভেদ আছে। উদাহরণস্বরূপ, ল্যাটিন আমেরিকার এবং আরব দেশের অধিবাসীরা উত্তর ইউরোপীয়দের তুলনায় সাধারণত পরস্পরের নিকট দাঁড়িয়ে কথা বলে।

৩. অবস্থানের ধরন: 

পারস্পরিক ক্রিয়ার সময় এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির অবস্থানের ভিত্তিতে কোনো দিকে বসা বা দাঁড়িয়ে থাকে তাকেই অবস্থানের ধরন বলা হয়। মানুষ কথা বলার সময় মুখোমুখি বা পাশাপাশি বসে বা দাঁড়াতে পারে। এ অবস্থান দ্বারা দুজন মানুষের মধ্যকার সম্পর্কের ধরন প্রতিফলিত হয়। মাঝে মাঝেই দেখা যায় সহযোগী মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিরা পাশাপাশি বসতে পছন্দ করে। অন্যদিকে প্রতিযোগী মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিরা মুখোমুখি বসতে রাজি নয়। অর্গাইল বলেছেন, যে যার কথা বলতে চায় তারা পরস্পরের পক্ষে বলতে চায় এবং এক্ষেত্রেও সংস্কৃতি ও কৃষ্টির প্রভাব অন্যতম।

৪. অবয়ব: 

কোনো মানুষের অবসর অন্যের কাছে তার সম্বন্ধে বিভিন্ন বিষয় ব্যক্ত করে থাকে। অবসর বলতে এখানে কেবল নাকমুখের ছবি নয়, ব্যক্তির পোশাক, চুলের স্টাইল, গোঁফ-দাড়ি দৈহিক অবয়ব সবকিছুই বোঝানো হচ্ছে। আর এসব থেকেই আমরা বুঝতে পারি লোকটা খুব সৌখিন অথবা লোকটা গুণ্ডা প্রকৃতির।

৫. ভঙ্গি: 

বিভিন্ন ধরনের দাঁড়ানো, বসা প্রভৃতি বিভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে। কথা বলার সময় সামনের দিকে ঝুঁকে বসা সাধারণত অপর ব্যক্তির প্রতি ইতিবাচক মনোভাবের পরিচায়ক। দেহভঙ্গি দ্বারা আমরা ব্যক্তির পদমর্যাদা সম্বন্ধে ধারণা করে থাকি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পায়ের উপর পা তুলে চেয়ারে বসে অধস্তনদের সাথে কথা বলতে পারে। কিন্তু অধস্তনরা পা দুটি পাশাপাশি বিন্যস্ত করে বিনীতভাবে বসে থাকেন। এমনকি ব্যক্তির মানসিক অবস্থা তার দেহভঙ্গির মাধ্যমে প্রকাশ পায়।

৬. মাথা নাড়ানো: 

অর্গাইল ১৯৭২ সালে লক্ষ করেন যে, মাথা নাড়ানো বা ঝাঁকানো অন্য ব্যক্তির কথায় সমর্থন এবং সে যা বলছে তা বলার অনুমতি উপস্থাপন। উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি শিক্ষক যখন পাঠদান করেন তখন ছাত্রের মাথা নাড়ানো তার সাথে ঐকমত্য প্রকাশ করে এবং বলবর্ধক হিসেবে কাজ করে যার প্রভাবে শিক্ষক সন্তুষ্ট মনে পাঠদান করতে সক্ষম হন।

৭. মুখভঙ্গিমা: 

বাচনিক যোগাযোগের সাথে মুখভঙ্গিমা যুক্ত হয়ে যোগাযোগকে সুদৃঢ় করে তোলে। কোনো কথা মজার না দুঃখের, না ভয়ের তা মুখভঙ্গিমার সাহায্যে প্রকাশ পায়। এসব মুখভঙ্গিমা সাংস্কৃতিক দিক থেকে সর্বজনীন ও সহজাত। ৮. হস্তভঙ্গি বা ইশারা অবাচনিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ইশারা বা হস্তভঙ্গি।

মনোবিজ্ঞানী আলপোর্ট (Allport) ইশারাকে যোগাযোগের প্রাচীনতম ধরন এবং শিশুর ভাষা বিকাশের প্রথম ধাপ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। মূক ও বধিরদের জন্য ইশারা একটি ভাষা হিসেবে কাজ করে। নামসম্পন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রেও ইশারা ব্যক্তির বক্তব্য স্পষ্টতর করতে সাহায্য করে থাকে।

৯. দৃষ্টি বিনিময়: 

দৃষ্টি বিনিময় যোগাযোগে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে এবং এতে পারস্পরিক আকর্ষণ, অন্তরমৃতা ও বিভিন্ন আবেগমূলক অবস্থা প্রতিফলিত হয়। এছাড়া সরাসরি দৃষ্টিসংযোগ যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণে রাখে। এক্সলাইন বা উইন্টার (Exline and Winter)-এর গবেষণায় দেখা গেছে, বক্তব্য বিষয় ও লিঙ্গ অনুসারে পারস্পরিক দৃষ্টি বিনিময়ে তারতম্য লক্ষ করা যায়।

সাধারণত যে সকল ক্ষেত্রে বাচনিক যোগাযোগ সম্ভব হয়ে ওঠে না, সে সকল ক্ষেত্রে দৃষ্টি বিনিময়ের মধ্যমে শ্রোতৃমণ্ডলীকে তার মনের ভাবগত করে থাকেন।

১০. কথাবার্তায় অবাচনিক উপাদান: 

গলার সুর বা স্বর বাচনিক লয়ের দ্রুততা উচ্চারণের অস্পষ্টা প্রভৃতি কথাবার্তায় অবাচনিক উপাদান। এসব উপাদান বাচনিক যোগাযোগের সম্পূরক হিসেবে কাজ করে; যেমন- কোনো কথা মানুষ দাবি অথবা আবদারের সুরে বলতে পারে; অর্থাৎ, অবাচনিক উপাদানসমূহ কথাবার্তার সাথে সংযুক্ত হয়ে পারস্পরিক যোগাযোগকে প্রতিনিয়ত অর্থবহ করে তোলে।

উপসংহার 

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পারস্পরিক যোগাযোগ ভাষার ব্যবহারে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, অবাচনিক প্রক্রিয়াগুলোও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। তাই আধুনিক সমাজ মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণার অবাচনিক যোগাযোগ-সম্পর্কিত অনুসন্ধান ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব গবেষণালব্ধ তথ্য খুব শীঘ্রই সামাজিক আন্তঃক্রিয়া সম্বন্ধে উন্নততর ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দিতে পারবে বলে মনে করা হয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url