আধুনিক মনোবিজ্ঞানে 'ওয়েবার' ও 'ফেকনার'-এর অবদান

উদ্দীপক ও সংবেদন একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উদ্দীপক ও সংবেদনের মধ্যে সম্বন্ধ নির্ধারণ করার জন্য জার্মান মনোবিজ্ঞানী ই. এইচ ওয়েবারের একটি সূত্র প্রণয়ন করেন। পরবর্তীকালে গুস্তাভ ফেকনার নামক অন্য এক মনোবিজ্ঞানী ওয়েবার প্রবর্তিত সূত্রটি পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেন। নিম্নে আধুনিক মনোবিজ্ঞানে ওয়েবার ও ফেকনারের অবদান তুলে ধরা হলো- 

আর্নেস্ট হেনরিখ ওয়েবারের অবদান 

১৮১৫ সালে ওয়েবার লিপজিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন এবং সেখানেই ১৮৭১ সালে অবসরে যাওয়ার পূর্ব- পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। তিনি মূলত একজন শারীরবিদ ছিলেন এবং তার প্রধান আকর্ষণ ছিল অনুভূতি ও সংবেদনমূলক বিষয়ে গবেষণা। প্রথমদিকে তিনি স্পর্শের ক্ষেত্রে আমাদের অনুভূতি এবং মাংসপেশির অনুভূতি সম্পর্কিত বিষয়ে গবেষণা করেন।

স্পর্শ নিয়ে ওয়েবারের গবেষণা 

স্পর্শের অনুভূতি নিয়ে গবেষণার জন্য ওয়েবার কম্পাসের মতো দুই প্রান্ত বিশিষ্ট একটি ছোটো যন্ত্র ব্যবহার করেন। এই যন্ত্র দিয়ে তিনি পরীক্ষণ পরিচালনার সময় পরীক্ষণের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যক্তির চামড়ার কাছাকাছি দুটি বিন্দুতে চাপ দেয়া হতো এবং দূরত্ব পরিমাপ করা হতো। এভাবে কম্পাস দিয়ে ব্যক্তির সমগ্র শরীরে অনুভূতি বিন্দুর অনুভবীয় পার্থক্য পরিমাপ করা হয়। তিনি পরীক্ষণের মাধ্যমে দেখতে পান যে, কম দূরত্বের অনুভূতি স্থান হলো জিহ্বার চামড়া। জিহ্বায় দু প্রান্তের অনুভূতি পার্থক্যের স্থানের দূরত্ব হলো ১ মিলিমিটার। অপর দিকে সর্বোচ্চ দূরত্বের স্থান হলো পিঠের মাঝ বরাবর অবস্থিত; অর্থাৎ, এখানে কম্পাসের দুপ্রান্তের সর্বোচ্চ দূরত্ব হলো ৬০ মিলিমিটার। ওয়েবার তাঁর এ গবেষণা থেকে স্পর্শের সম্পর্কে অনুমান করেন যে, স্পর্শের ভিন্নতা মূলত আমাদের শারীরিক গঠনের তারতম্যের জন্যই বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন অনুভূত হয়।

মাংসপেশির অনুভূতি-সংক্রান্ত ওয়েবারের গবেষণা

তিনি মাংসপেশির সর্বনিম্ন দূরত্বের দুই প্রান্তে ওজন (Weight) রেখে মাংসপেশির অনুভূতি-সম্পর্কিত গবেষণা করেন। এক্ষেত্রে মাংসপেশির এক প্রান্তে প্রমাণ ওজনের মানদণ্ড রেখে (Standard weight) কিছু দূরত্বে পরিমেয় ওজন রাখেন এবং পারীক্ষকে ওজনের অনুভূতিজাত বিভিন্ন তথ্য জানাতে বলেন; অর্থাৎ, প্রমাণ ওজনের তুলনায় পরিমেয় ওজনটি অপেক্ষাকৃত হালকা নাকি ভারী। অথবা উভয় ওজন সমান কিনা তা বলতে বলেন। যখন প্রমাণ ওজনের তুলনায় পরিমেয় ওজনটি ন্যূনতম পার্থক্য সৃষ্টি করে তখন ওয়েবার মাংসপেশির দু প্রান্তের এ ন্যূনতম ওজনের দূরত্বকে Just Noticeable Difference বা ন্যূনতম অনুভবীয় পার্থক্য বলে অভিহিত করেন। কোনো বিষয় সম্পর্কে বিচার-বিবেচনা হলো আপেক্ষিক পরম নয় (Judgements are relative, not aboslute)। ওয়েবার বলেন যে, এক্ষেত্রে মাংসপেশির ওজনের অনুভূতি হালকা নাকি ভারী তা বিচার করা মূলত একটি আপেক্ষিক ব্যাপার, এটি পরম কোনো সিদ্ধান্ত নয়।

ওয়েবারের সূত্র 

উদ্দীপকের শক্তি বাড়লেই সংবেদন বাড়ে তা নয়। সংবেদনের স্বল্পতম বৃদ্ধি বা ন্যূনতম অনুভবনীয় পার্থক্য অনুভব করতে হলে মূল উদ্দীপকের সাথে সংগতি রেখে একটি বিশেষ অনুপাতে তার পরিমাণ বাড়াতে হবে। ওয়েবারের মতে, এ ন্যূনতম অনুভবনীয় পার্থক্য 'হচ্ছে উদ্দীপকের পরিমাণগত পার্থক্যের আপেক্ষিক অনুপাত। ওয়েবার আবিষ্কার করেন যে, প্রতিটি সংবেদীয় প্রক্রিয়া একটি ধ্রুবক আনুপাতিক বৃদ্ধির প্রতি সাড়া দেয়। এ ধ্রুবক অনুপাত ওয়েবারের ধ্রুবক নামে পরিচিত। উডওয়ার্থ এবং শ্লোজবাগ ওয়েবারের সূত্রটি নিম্নরূপে বর্ণনা করেন, একটি উদ্দীপকের মাত্রার ন্যূনতম পার্থক্য উপলব্ধি করতে হলে তা উদ্দীপকটির সামগ্রিক মানের একটি ধ্রুবক ভগ্নাংশ অনুযায়ী বাড়াতে অথবা কমাতে হবে।

গাণিতিকভাবে প্রকাশ করলে সূত্রটি দাঁড়ায় - △I / I = K

এখানে, I = আদর্শ উদ্দীপকের শক্তি বা মাত্রা, 

△I = ন্যূনতম অনুভবনীয় পার্থক্যের জন্য উদ্দীপকের হ্রাস-বৃদ্ধির মাত্রা,

K = ধ্রুবক ভগ্নাংশ।

ওয়েবারের ধ্রুবক সকল পর্যায়ে একই রকম থাকে না। নিম্নসীমা থেকে উচ্চসীমা পর্যন্ত উদ্দীপকের তীব্রতার ক্রমপরিবর্তন ওয়েবারের ধ্রুবকের মাত্রার পরিবর্তন ঘটায়।

গুস্টাব থিওডোর ফেকনারের অবদান  

গোস্তাভ টি ফেকনার ১৬ বছর বয়সে তিনি লিপজিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর অধ্যায়ন শুধু করেন এবং ১৮২২ সালে ২১ বছর বয়সে তিনি চিকিৎসায় ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীকালে তাঁর আগ্রহ জীববিজ্ঞান থেকে গণিত এবং শারীর বিজ্ঞানের দিকে স্থানান্তর করেন। ১৮৩৪ সালে যখন ৩১ বছর বয়সে তখন তিনি লিপজিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি সংবেদনশীলতার নানাবিধ সমস্যা নিয়ে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ১৮৪০ সালে "Color vision and Afterimage" এর উপর একটি প্রবন্ধ লিখেন। ফেকনার মোট ১৮৩টি প্রবন্ধ এবং ৮১টি বই লেখেন। 

ভৌত মনোবিজ্ঞান

ফেকনার মন এবং শরীরবিদ্যার মধ্যকার সম্পর্কের দার্শনিক মতবাদের উপর ভিত্তি করে Psychophysics ধারাণাটি উপস্থাপন করেন। ১৮৫০ সালের ২২ অক্টোবর সকালে তিনি বিছানায় শুয়ে ছিলেন। হঠাৎ করে তিনি শরীরের এক পার্শ্বে একটু সমস্যা অনুভব করলেন। এমতবস্থায় তিনি তার মানসিক অনুভূতিতে একটু পরিবর্তন আনেন ফলে তিনি দেখলেন যে তার শরীরের সমস্যা গ্রন্থ অংশের অনুভূতিও পরিবর্তন হচ্ছে। এভাবে গোস্তাভ ফিচেনার অনুমান করেন যে, আমরা যদি আমাদের মানসিক অনুভূতি গাণিতকি হারে (Arithmetically) পরিবর্তন করি, তাহলে তা আমাদের শারীরিক অনুভূতিকে জ্যামিতিক হারে (Geometrically) পরিবর্তন করবে। ফেকনার তার এ অনুমানের উপর অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন এবং পরবর্তীতে মনোবিজ্ঞানে তা নতুন নামে অর্থাৎ "Psychophysics" হিসেবে স্থান দখন করে নেয়। Psyschophysics মন ও শরীরের মধ্যকার সম্পর্ক বিষয়ক বিজ্ঞান। ফেকনার প্রথম ব্যক্তি হিসেবে একে গাণিতিকভাবে প্রকাশের চেষ্টা করেন। কিন্তু ওয়েবার তার এ ধারণা গাণিতিকভাবে প্রকাশ করেন যা পরবর্তীতে ওয়েবারের নীতি হিসেবে পরিচিত হয়। 

ফেকনারের সূত্র 

ফেকনার ১৮৬০ সালে ওয়েবারের সূত্রটি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেন এবং সূত্রটির পরিবর্তন সাধন করেন। ওয়েবারের সূত্রে সংবেদনের ন্যূনতম অনুভবনীয় পার্থক্য সৃষ্টির জন্য উদ্দীপকের শক্তিকে একটি নির্দিষ্ট ভগ্নাংশ দিয়ে গুণ করতে হয়। কিন্তু এর ফলে সংবেদনের কি পরিমাণ বৃদ্ধি ঘটে ওয়েবার তা উল্লেখ করেন নি। ফেকনারের মতে, উদ্দীপকের বৃদ্ধিকে যেমন অঙ্কের সাহায্যে প্রকাশ করা যায়, সংবেদনের বৃদ্ধিকেও তেমনি অঙ্কের সাহায্যে প্রকাশ করা যায়। সংবেদন যে পার্থিব উদ্দীপকের সাথে সম্পর্কযুক্ত তা তিনি পরিমাপ করেন। এভাবে যে সম্পর্কটি ফেকনার পেলেন তাই ওয়েবার-ফেকনার সূত্র নামে পরিচিত। 

সূত্রটি হলো- S = K log R

এখানে, S = প্রত্যক্ষিত তীব্রতা, 

log R = উদ্দীপক শক্তির লগারিদম, 

K ধ্রুবক।

এ সূত্রে এটিই বলা হয়েছে যে, সংবেদনের শক্তি উদ্দীপকের লগারিদমের সাথে সরাসরি ক্রিয়া করে।

মনোদৈহিক পদ্ধতিসমূহ 

গুস্তাভ ফেকনার মন ও শরীরের সম্পর্ক ব্যাখ্যা দানের ক্ষেত্রে কিছু পদ্ধতির কথা বলেছেন যা Psychophysics-কে আরো বৈজ্ঞানিক মর্যাদা প্রদানে সাহায্য করেছে। 

  1. সীমা পদ্ধতি (The method of limits), 
  2. ধ্রুবক উদ্দীপক পদ্ধতি (The method of constant Stimuli) 
  3. উপযোজনমূলক পদ্ধতি (The method of Adjustment)

মন ও শরীরের সম্পর্ক নিরুপনের ক্ষেত্রে গুস্তাভ ফেকনারের পদ্ধতিগুলো এক অনন্য সৃষ্টি। যা আজও বিশ্ব ব্যাপী ব্যবহৃত হচ্ছে। 

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায় যে, ওয়েবার ও ফেকনার যদিও দেহ ও মন সম্পর্কিত সমস্যা সমাধান করতে পারেন নি। তবুও আধুনিক মনোবিজ্ঞানে তাদের অবদান অতুলনীয় ও প্রাণবন্ত।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url