আচরণবাদ প্রতিষ্ঠায় ওয়াটসনের অবদান
বস্তুনিষ্ঠ মনোবিজ্ঞানের একটি প্রণালি হিসেবে আচরণবাদ, যার প্রবর্তক ছিলেন জন.বি ওয়াটসন (J.B Watson 1878-1958) আমেরিকার সবচেয়ে জোরালো ও প্রভাবশালী বিতর্কিত মতবাদ। ওয়াটসন ১৮৭৮ সালে আমেরিকার ক্যারলিনায় জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি ১৯০৮ সালে জনহপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগদান করেন। যদি আচরণবাদী চল মনোবিজ্ঞান শিক্ষা দিতে গিয়ে তিনি ক্রমেই ক্রিয়াবাদী মনোবিজ্ঞানের বিমূর্ত ও অবৈজ্ঞানিক ব্যক্তি-নির্ভর বিষয়বস্তু ও পদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত বস্তুনিষ্ঠ মনোবিজ্ঞান শিক্ষাদানের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন। তার এই বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাধারাই 'আচারণবাদ' নামে পরবর্তীকালে প্রচার ও প্রকাশ হয়।
আচরণবাদ
আচরণবাদের মূলকথা হচ্ছে মন বা চেতনা মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হতে পারে না। কারণ মন অদৃশ্য ও অস্পৃশ্য। তাই মন দিয়ে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব নয়। মন ও চেতনাকে মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হিসেবে স্বীকার করলে মনোবিজ্ঞান দর্শনের অংশ হওয়াই থাকবে সত্যিকার অর্থে তা বিজ্ঞান হতে পারে না। তাছাড়া ওয়াটসন মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় উন্ডের অন্তর্দর্শন-পদ্ধতিকে অকার্যকর মনে করতেন। কারণ এ পদ্ধতির সাহায্যে মানসিক ক্রিয়া সম্বন্ধে নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করা যায় না। তাছাড়া শিশু ও বিকারগ্রস্তদের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা যায় না বা সম্ভব নয়। সেজন্য ওয়াটসন মানুষের বাহ্যিক আচরণকে উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়া এককে বিশ্লেষণ করেন। ওয়াটসনের পরবর্তী আধুনিক মনোবিজ্ঞানীরাও মনের পরিবর্তে আচরণকে এবং অন্তর্দর্শনের পরিবর্তে পর্যবেক্ষণকে যথাক্রমে মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু ও পদ্ধতি হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছেন। ফলে মনোবিজ্ঞান আচরণ- সম্পর্কিত বিজ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
জন. বি. ওয়াটসনের পরিচয় জন ব্রোডাস ওয়াটসন (1878-1958) আমেরিকার দক্ষিণ ক্যারলিনায় জন্মগ্রহণ করেন। ফারম্যান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯০০ সালে এমএ পাস করেন। তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে এঙ্গেলের অনুপ্রেরণায় পরীক্ষণমূলক মনোবিজ্ঞানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। শিকাগোতে তিনি ডোনাল্ডসন এবং জ্যাকুয়েস লোয়েরের অধীনে শরীরতত্ত্ববিদ্যা এবং স্নায়ুতন্ত্র অধ্যয়ন করেন। তারপর ১৯০৩ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
আচরণবাদ প্রতিষ্ঠায় ওয়াটসনের অবদান মনোবিজ্ঞানের প্রণালি হিসেবে কাঠামোবাদ যখন চরম শিখরে এবং গত দুই দশক ধরে ক্রিয়াবাদ যখন দ্রুত বিকাশ লাভ করছিল ঠিক তখনই, অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে দুই মতবাদের বিরুদ্ধে আমেরিকার যুবক ওয়াটসনের মনে এক প্রতিবাদী চিন্তাধারার বিকাশ লাভ থাকে যা ১৯১৩ সালে Psychology as the Behaviourist views it নামক প্রবন্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ হয়। উক্ত প্রবন্ধে তিনি 'কাঠামোবাদী' ও ক্রিয়াবদী দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র সমালোচনা করে অত্যন্ত জোরালো ভাষায় তার আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। তার এই নবতর দৃষ্টিভঙ্গিকে Chaplin ও Krauice (1988) Behaviorristice Revolt হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
Psychology as the Behaviourist views it প্রবন্ধে ওয়াটসন মনোবিজ্ঞানকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের একটি বস্তুনিষ্ঠ ও পরীক্ষামূলক শাখা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন এবং প্রাণীর আচরণ সম্পর্কে পরীক্ষণলব্ধ বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের উপর গুরুত্বারোপ করেন। তার পরীক্ষণভিত্তিক মনোবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য ছিল আচরণের পূর্বানুমান করা (মার্কস ও হিলিক্স, ১৯৭৩)।
গবেষণা
শিকাগোতে তিনি প্রাণীদের নিয়েই বেশির ভাগ গবেষণা করেন। তার একটি গবেষণা ছিল সাদা ইঁদুরের ক্রমবর্ধমান জটিল আচরণের বিকাশের সঙ্গে মস্তিষ্কের মেডুলেশন এবং অনুবন্ধা নির্ণয় করা। আর একটি ইঁদুর ধাঁধা শিক্ষণে ব্যবহৃত সংবেদী সংকেত বিশ্লেষণ। এই গবেষণায় তিনি স্থল মরগ্যান এবং থর্নডাইকের পরীক্ষণ-পদ্ধতি ব্যবহার করেন এবং ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন সংবেদী ইন্দ্রিয় নষ্ট করে দিয়ে প্রাণীদের শিক্ষণে এসব সংকেতের প্রভাব লক্ষ করেন। তিনি সিদ্ধান্ত করেন যে, ধাঁধা শিক্ষণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবেদন হলো গতি-সংবেদন বা (Kinesthesis)।
দৃষ্টিক্ষমতা পরীক্ষাযন্ত্র উদ্ভাবন
১৯০৮ সালে তিনি হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক নিযুক্ত হওয়ার পর ইয়ারকিস ও ওয়াটসন যৌথভাবে প্রাণীদের দৃষ্টিক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্য একটি যন্ত্র উদ্ভাবনের চেষ্টা করেন।
ওয়াটসনের নিজের বর্ণনা অনুযায়ী শিকাগোতে পড়াশোনার সময়ই তিনি সম্পূর্ণ বস্তুনিষ্ঠ ধারণার মাধ্যমে চিন্তন করতে শুরু করেন। আচরণবাদের প্রাথমিক সূত্র তিনি শিকাগোতে প্রাণীদের নিয়ে গবেষণা করার সময়েই আরেক জন সহযোগীর সঙ্গে যৌথভাবে উদ্ভাবন করেন। কিন্তু তখন তার বিরুদ্ধে প্রধান সমালোচনা ওঠে যে, তত্ত্বটি প্রাণীদের আচরণের বেলায় সত্য হলেও মানুষের বেলায় প্রযোজ্য হবে না। তারপর তিনি তার মতবাদ হয়েল ইউনিভার্সিটিতে ১৯০৮ সালে একটি বক্তৃতায় প্রকাশ করেন। কিন্তু সেখানেও তিনি প্রত্যাখ্যাত হন। অবশেষে ১৯১২ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি বক্তৃতায় তার আচরণবাদী তত্ত্বকে আরো দৃঢ়ভাবে এবং স্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরেন। এসব বক্তৃতায় একটি ছিল 'Psychology as the behaviourist views it (1913) psychological review.'। এই বক্তৃতাটি পত্রিকায় প্রকাশ হয় এবং এই প্রবন্ধটির মাধ্যমেই আচরণবাদ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচার হয়।
পরীক্ষণভিত্তিক মনোবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য তিনি যেসব পরীক্ষণ করেন সেই পরীক্ষণভিত্তিক মনোবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য ছিল আচরণের নিয়ন্ত্রণ এবং পূর্বানুমান করা। তিনি আরো বলেন যে প্রাণী ও মানুষের আচরণে ঐক্য বিদ্যমান এবং এ দুধরনের প্রাণীর মধ্যে কোনো পার্থক্যসূচক সীমারেখা নেই। মনোবিজ্ঞানীদের উচিত চেতনাকে বর্জন করা।
তাঁর দ্বিতীয় প্রবন্ধে আলোচ্য বিষয় ছিল প্রতিরূপ এবং আবেগ। এই প্রবন্ধে তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, প্রতিরূপ হলো প্রচ্ছন্ন বা অনুচ্চারিত দুটি রচনা। একত্রে তার প্রথম বই 'Behaviour: An introduction to comparative psychology (1914)'-এ হর্নস্টাইনের ভূমিকাসহ প্রকাশ হয়। হর্নস্টাইন দেখিয়েছেন যে, ওয়াটসন প্রথমে প্যাভলভের চিন্তাধারা অস্বীকার করতে চাইলেও পরে তা সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করেছেন। এছাড়া ওয়াটসনের চিন্তাধারার সাথে হাল এবং স্কিনানের চিন্তা-ধারার সাদৃশ্য রয়েছে। ১৯২৫ সালে ওয়াটসনের কতকগুলো বক্তৃতা Behaviourism শিরোনামে আত্মপ্রকাশ পায়। এই বক্তৃতায় দুটো জিনিসের উপর গুরুত্ব দেয়া হলো; যথা:
- আচরণে পরিবেশের উপর প্রভাব।
- মানুষের জীবনের উন্নতি ও কল্যাণের জন্য ইতিবাচক কর্মসূচি।
উক্ত গ্রন্থটির পর তিনি শিশুদের যত্ন সম্পর্কে একটি পুস্তক এবং কতকগুলো প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। এরপর ১৯৩৬ সালে তাঁর আত্মজীবনী প্রকাশ হয়।