গবেষণায় পরিমাণগত উপাত্ত সংগ্রহের ধরনসমূহ

সাধারণভাবে, উপাত্ত হলো তথ্য বা সংখ্যারাশি, যা থেকে উপসংহার টানা সম্ভব। এ সকল তথ্য বা সংখ্যারাশি গবেষকদের দ্বারা গবেষণার উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সংগ্রহ করা হয়। সুতরাং গবেষণা ও বিশ্লেষণের ভিত্তি হিসাবে কাজ করে, এমন অতীত এবং বর্তমানের সব প্রাসঙ্গিক উপাদানই হলো উপাত্ত।

গবেষণায় পরিমাণগত উপাত্তসংগ্রহের ধরণসমূহ

গবেষণায় পরিমাণগত উপাত্তসংগ্রহের ধরণসমূহ নিন্মরূপঃ

১. পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি: 

আবদ্ধ নয়, বরং স্বাভাবিক অবস্থায় যখন পারীক্ষকের আচরণের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিরীক্ষণ করে উপাত্ত সংগ্রহ করা হয় তাকে পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি বলে। পর্যবেক্ষণ পদ্ধতিতে কোনো উদ্দীপক প্রয়োগ না-করে জীবের মধ্যে আচরণ যেভাবে ঘটে এবং যে অবস্থায় ঘটে সেভাবেই তা নিরীক্ষণ করা হয়। এ পদ্ধতিকে বস্তুনিষ্ঠ পদ্ধতি বলা হয়। পর্যবেক্ষণ স্বাভাবিক ও নিয়ন্ত্রিত এ দুই ধরনের হতে পারে। কোনো রকম নিয়ন্ত্রণ ছাড়া প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘটা কোনো ঘটনাকে অনুরূপভাবে পর্যবেক্ষণ করাই হলো স্বাভাবিক পর্যবেক্ষণ। আর নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে অত্যন্ত সুসংহতভাবে যখন মানুষ বা প্রাণীর আচরণকে নিরীক্ষণ করা হয় তখন তাকে নিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ বলে।

২. পরীক্ষণ পদ্ধতি: 

পরীক্ষণ পদ্ধতিতে সুনিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বিভিন্ন চলকে নিয়ন্ত্রণ করে কার্য-করণ সম্পর্ক জানার চেষ্টা করা হয়। এ পদ্ধতিতে পরীক্ষক পরিবেশের কোন অবস্থাকে পরিবর্তন করে পারীক্ষের উপর তার প্রভাব দেখেন অর্থাৎ অনির্ভরশীল চল প্রয়োগের ফলে নির্ভরশীল চলের কী পরিবর্তন হয় তা দেখে থাকেন। সাধারণত গবেষণাগারে নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী কোনো আচরণের কার্যকারণ এ পদ্ধতিতে অনুসন্ধান করা হয়।

Weikart এবং তাঁর সহকর্মীদের (১৯৬৮) গবেষণার আলোকে উপর্যুক্ত বিষয়টি নিম্নে বর্ণনা করা হলো: 

সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত কিছু ছেলেমেয়ের বুদ্ধির বিকাশের স্বরূপ নির্ণয়ের জন্য গবেষণার লক্ষ্যে পরীক্ষণ নকশা তৈরি করা হলো। প্রাক-বিদ্যালয়গামী শিশুদের বাড়িতে পাঠদানের জন্য বিশেষভাবে একটি পাঠদান কর্মসূচি তৈরি করা হলো। এ কর্মসূচির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, সব শিশুর মায়েদের এ পাঠদান কর্মসূচির পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত করা হয়েছিল। সব শিশুই বুদ্ধি, বয়স, লিঙ্গ, জাতি, ধর্ম সব দিকে একই রাখা হয়েছে। সব শিশুর উপর বুদ্ধি এবং বাচনিক দক্ষতা পরিমাপক অভীক্ষা পরিচালনা করা হলো (Pretest)। এরপর এদের দুটি দলে ভাগ করে ১টি দলের উপর সাপ্তাহিক পাঠদান কর্মসূচি পরিচালনা করা হয় (experimentl group) এবং ২য় দলে এ ধরনের কোনো পাঠদান কর্মসূচি পরিচালনা করা হয়নি (control group)। প্রায় ১০ সপ্তাহ এ পাঠদান কর্মসূচি পরিচালনার পর উভয় দলের উপর বুদ্ধি এবং বাচনিক দক্ষতা পরিমাপক অভীক্ষা প্রয়োগ করা হবে (post test)। Pre এবং Post test-এর ফলাফলের তুলনামূলক বিশ্লেষণই সাপ্তাহিক পাঠদান কর্মসূচীর প্রভাব সুস্পষ্ট হবে। 

৩. আপাত পরীক্ষণ পদ্ধতি: 

মানব আচরণের ক্রমবিকাশে এমন অনেক বিষয় আছে যেখানে সরাসরি পরীক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার করা যায় না বা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সেক্ষেত্রে আপাতত পরীক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে অনির্ভরশীল চলকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় না বা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এ পদ্ধতিতে ঘটনা যখন, যেখানে, যেভাবে ঘটে সেভাবেই পর্যবেক্ষণের আওতাভুক্ত করতে হয়।

Cook এবং Cambell (1974) তাঁদের গবেষণায় এ পদ্ধতির প্রয়োগ দেখিয়েছেন। তারা একদল শিশুকে টেলিভিশনের একটি নির্দিষ্ট শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানে নিয়মিত দেখার জন্য প্রচারণা চালান। এটি পরীক্ষণ দল। অপর একটি দলের উপর এ ধরনের কোনো প্রচারণা চালানো হয়নি। তারা নিয়ন্ত্রিত দল। এখানে প্রচারণা চালানো অনির্ভরশীল চল। প্রচারণা চালানোর আগে (Pre-test) এবং পরে (Post-test) উভয় দলের সাধারণ জ্ঞানের পরীক্ষা নেয়া হয়। পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায় যে, Pre test এ পরীক্ষণ দলের সাফল্যাঙ্ক নিয়ন্ত্রিত দলের চেয়ে কম ছিল কিন্তু প্রচারণার পর তা অনেক বৃদ্ধি পায়। কিন্তু Control group এর ফলাফলে তেমন উন্নতি পরিলক্ষিত হয়নি।

৪. সাক্ষাৎকার পদ্ধতি: 

পর্যবেক্ষক এবং পর্যবেক্ষণকারী মুখোমুখি বসে প্রশ্ন এবং উত্তরের মাধ্যমে যে তথ্য সংগ্রহ করা হয় তাকে সাক্ষাৎকার বলে। প্রশ্নগুলো অবশ্য আগেই নির্ধারণ করা হয়ে থাকে (Structured)। এই পদ্ধতিতে নির্ধারিত প্রশ্নের বাইরের পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করা হয়ে থাকে। প্রশ্নগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য এবং অল্প সময়ে বেশি সংখ্যক প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য তথ্যসমূহকে টেপে রেকর্ড করে রাখা হয়। পরবর্তীতে এগুলো বিশ্লেষণ করা হয়।

৫. ঘটনা অনুধ্যান পদ্ধতি: 

বিভিন্ন উৎস থেকে এক বা একাধিক ব্যক্তি বা ঘটনা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলো বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ব্যক্তি সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা লাভ করার কৌশলকে Case study method বলে। এই পদ্ধতিতে প্রথমে সমস্যাক্রান্ত ব্যক্তির নাম, বয়স, লিঙ্গ তারপর সে কী সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছে সেটা লিপিবদ্ধ করা হয়। এরপর সমস্যাক্রান্ত শিশুর অতীত সম্পর্কে পরীক্ষক প্রথমে বাবা-মার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। স্কুলে শিশুর case study করতে গিয়ে পরীক্ষক ক্লাসের পরিবেশ, শিক্ষার ধরন অন্যান্য শিশুর সাথে তার সম্পর্ক, লেখাপড়ায় সে কেমন মনোযোগী ইত্যাদি বিষয় লিপিবদ্ধ করার পর ঐ শিশুর জন্য কী পদ্ধতি ব্যবহার হতে পারে তা নির্ধারণের জন্য I.Q test নিতে হতে পারে। অবশেষে পরীক্ষক সমস্যাক্রান্ত শিশুর সাথে কথাবার্তা বলে তার স্মৃতি থেকে সমস্যা সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করে এবং তার আচরণ স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পর্যবেক্ষণ করে সমস্যা নির্ণয় করেন। এভাবে ব্যক্তিকে বিভিন্ন unstructured প্রশ্ন করে তার ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন সম্পর্কে ধারণা লাভ সম্ভব। ১৮ এবং ১৯ শতকে শিশুদের এককভাবে case study-এর আওতাভুক্ত করা হতো। এ পদ্ধতি সবচেয়ে সফলভাবে প্রয়োগ করেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড। তিনি এ পদ্ধতিতে অসংখ্য পর্যবেক্ষণের তথ্য সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করেন এবং এগুলো থেকেই মানববিকাশের মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব দেন।

৬. প্রশ্নমালা পদ্ধতি: 

যে পদ্ধতিতে প্রশ্নমালা প্রণয়ন করে গবেষণা সমস্যা-সংক্রান্ত উপাত্ত সংগ্রহ করা হয় তাকে প্রশ্নমালা পদ্ধতি বলে। নির্দিষ্ট কোনো আচরণ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রশ্নমালা প্রদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। প্রশ্নামালার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলো বিশ্লেষণের দ্বারা সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধান করা হয়। এই পদ্ধতির সাফল্য নির্ভর করে অনেকটা প্রশ্নমালা প্রণয়নের উপর। এ পদ্ধতি প্রথম প্রয়োগ করেন Arnold Gesell. তার প্রকাশিত The First Five Years of Life (1925) বইতে তিনি পিতামাতা ও শিশুদের থেকে প্রশ্নমালা প্রয়োগ করে উপাত্ত সংগ্রহের বিকাশমূলক নর্ম উপস্থাপন করেন। তাছাড়াও তিনি ঘুমানো, খাদ্যাভ্যাস ও সঞ্চালন দক্ষতার বিষয়ক উপাত্ত সংগ্রহে প্রশ্নমালা প্রয়োগ করেন।

উপসংহার: 

যে কোন অনুসন্ধানে পূর্ব নির্ধারিত উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে উপাত্ত সংগ্রহ করতে হয়। পরিমাণগত উপাত্তের প্রাথমিক স্তর হচ্ছে সংখ্যাত্মক উপাত্ত। উপাত্ত সংগ্রহ করার সময় কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় যাতে করে উপাত্ত নির্ভুল হয়। নির্ভুল সংখ্যাত্মক উপাত্তের মাধ্যমেই পরিসংখ্যানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url