থর্নডাইকের অনুষঙ্গবাদ

অনুষঙ্গবাদের সূচনা হয় জ্ঞানের উৎস সম্পর্কিত দার্শনিক সমস্যা থেকে। আমরা কীভাবে জ্ঞান অর্জন করি? এ প্রশ্নের প্রেক্ষিতে দার্শনিক গণের উত্তর- জ্ঞানের উৎস হলো সংবেদন। তাঁদের মতে সংবেদন থেকে ধারণা গঠিত হয় এবং সরল ধারণাগুলোর অনুষঙ্গ থেকে জটিল ধারণার সৃষ্টি হয়। এটাই হলো অনুষঙ্গবাদের প্রথম সূত্র। অনুষঙ্গবাদের সূত্র সমূহের সাহায্যে মনোবিজ্ঞানে বহু সংখ্যক আচরণের ব্যাখ্যা প্রদান সম্ভব হয়েছে। এছাড়া মনোবিজ্ঞানের অন্য সকল মতবাদ কোনো না কোনোভাবে অনুষঙ্গবাদের ধারণা গ্রহণ করেছে।

থর্নডাইকের অনুষঙ্গবাদ 

থর্নডাইক অনুষঙ্গবাদের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটালেও তিনি একটিমাত্র গ্রন্থে বা প্রবন্ধে সামগ্রিকভাবে অনুষঙ্গবাদকে উপস্থিত করেননি। এর কারণ হয়ত এই যে, থর্নডাইক নিজেকে কোনোদিন একটি সুশৃঙ্খল তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে কল্পনা করেননি। তবে তার কিছু প্রবন্ধ ও বইয়ের কিছু অধ্যায় একত্রে সংকলণ করা হয়েছে। এ সংকলনের নাম Selected Writings from a Conncetionist's Psychology (1949)। এই সংকলনের উপর ভিত্তি করেই ম্যাকগিয়কের মানদণ্ড অনুসারে প্রণালি হিসেবে অনুষঙ্গবাদ আলোচনা করা হলো-

প্রণালি হিসেবে অনুষঙ্গবাদ 

মনোবিজ্ঞানের কোনো System বা প্রণালিকে মূল্যায়ন করার জন্য Mc. Geoch (1933) ৬টি মানদণ্ড উল্লেখ করেছেন। মানদণ্ডগুলো হলো:

  1. মনোবিজ্ঞানের সংজ্ঞা 
  2. মৌলিক স্বতঃসিদ্ধ 
  3. উপাত্তের স্বরূপ 
  4. মন ও দেহের অবস্থান 
  5. সংযোজন-নীতি 
  6. নির্বাচন-নীতি

উপর্যুক্ত মানদণ্ডের আলোকে অনুষঙ্গবাদ মূল্যায়ন করা হলে, প্রণালি হিসেবে অনুষঙ্গবাদে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ করা যায়-

১. 

মনোবিজ্ঞানের সংজ্ঞা: 

থর্নডাইকের মতে, 

মনোবিজ্ঞান হলো-উদ্দীপক-প্রতিক্রিয়ার সংযোগ বা বন্ধন সম্বন্ধে গবেষণা। 

তিনি উদ্দীপক প্রতিক্রিয়ার সংযোগকে ব্যাপকভাবে দেখতে চেষ্টা করেছেন।

২. 

মৌলিক স্বতঃসিদ্ধ

থর্নডাইকের বক্তব্যে-সুস্পষ্ট স্বতঃসিদ্ধের উল্লেখ পাওয়া না গেলেও তিনি কতকগুলো পরোক্ষ স্বতঃসিদ্ধ উপস্থাপন করেছেন; যেমন-

  • আচরণকে অনুষঙ্গের সাহায্যে বিশ্লেষণ করা যায়।
  • আচরণের প্রক্রিয়াসমূহকে পরিমাপ করা সম্ভব অর্থাৎ যদি কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকে, তা হলে সেটা একটা পরিমাণে থাকবে।

৩. 

উপাত্তের স্বরূপ: 

থর্নডাইক যে সকল উপাত্তের ভিত্তিতে অনুষঙ্গবাদ তৈরি করেন সেগুলো ছিল বস্তুনিষ্ঠ এবং পরিমাণগত। তিনি দেখান যে-মনোবিজ্ঞানিগণ যেভাবে ব্যক্তিগত পার্থক্য নির্ণয় করেন, ঠিক একই পদ্ধতি ব্যবহার করে সমাজ বিজ্ঞানিগণ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারেন। তিনি শহরের বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন এবং সেগুলোর মধ্যে পার্থক্য এবং পারস্পরিক সহ-সম্পর্ক নির্ণয় করেন।

৪. 

মন ও দেহের অবস্থান: 

উপযোগবাদী মনোবিজ্ঞানী হিসেবে থর্নডাইক দেহ-মন সম্পর্কে তেমন গুরুত্ব দেননি। তবে তাঁর লেখায় মন (mind) এবং মানসিক (mental) শব্দ দুটির ব্যবহার লক্ষ করা যায়; তবে দেহ-মন সমস্যার জন্য এসবের তেমন কোনো গুরুত্ব দেননি। এই সমস্যাকে তিনি দার্শনিক সমস্যা হিসেবে গণ্য করেছেন। তিনি বলেছেন, 'সম্ভবত কোনো অবস্থায়ই আমি দর্শনকে আমার বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করতে সম্মত বা সমর্থ হতাম না।' 

৫. 

সংযোজন-নীতি:

ক. থর্নডাইকের সবচেয়ে বেশি পরিচিত এবং বিতর্কিত নীতি হলো তার ফলাফলের নীতি (Law of effect)। একটি উদ্দীপক- প্রতিক্রিয়ার সংযোগ স্থায়ী হবে কিনা তা নির্ভর করে প্রতিক্রিয়ার ফলাফলের উপর। কোনো প্রতিক্রিয়া সন্তোষজনক ফলাফল উৎপন্ন করলে সংখ্যাটি স্থায়ী হয়। পক্ষান্তরে শাস্তিপ্রদ বা অসন্তোষজন হলে সংযোগটি বিচ্ছিন্ন হয়।

খ. প্রাণীর ধাঁধাঁ শিক্ষণ-সম্পর্কিত প্রাথমিক গবেষণাগুলোতে তিনি দেখতে পান, প্রাণী ধীরে ধীরে সঠিক প্রতিক্রিয়া করতে শেখে এবং একই সাথে ভুল প্রতিক্রিয়াসমূহ পরিহার করে। তিনি এটার নাম দেন প্রচেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে শিক্ষণ।

গ. তবে তিনি পরোক্ষভাবে কতগুলো স্বতঃসিদ্ধ মেনে নিয়েছিলেন বলে মনে হয়; যেমন- 

  • আচরণকে অনুষঙ্গের সাহায্যে 'বিশ্লেষণ করা যায়। 
  • আচরণের প্রক্রিয়াসমূহকে পরিমাপ করা যায়।

৬. 

নির্বাচন-নীতি: 

থর্নডাইকের সর্বাধিক জনপ্রিয় মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হলো উদ্দীপক-প্রতিক্রিয়ার সংযোগের ধারণা। সত্যিকার অর্থে মানুষ কখনো একটি পরিস্থিতিকে সমানভাবে গ্রহণ করে না। এমন কি সম্পূর্ণরূপে পরিস্থিতি দ্বারা বাধ্য হলেও, সে কতগুলো অবস্থা থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখে। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ঘটনা মানুষের মনে সমনাভাবে রেখাপাত করে না। তিনি নির্বাচিত আচরণের সমস্যাগুলোকে, যেমন- সৃজনশীল চিন্তনকে শিক্ষণের নীতিগুলো দ্বারাই ব্যাখ্যা করেছিলেন।

তাঁর মতে,  

মানুষের সকল শিক্ষণ এমনকি সকল আচরণ নির্বাচনমূলক। কোনো একটি পরিস্থিতিতে আচরণ ঘটবে কিনা তা নির্ভর করে উদ্দীপক প্রতিক্রিয়ার সংযোগের উপর এবং সেটা অর্জনের (acquisition) উপর।

উপসংহার 

আলোচনা পরিশেষে বলা যায় যে, অনুষঙ্গবাদের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটান এডওয়ার্ড এল থর্নডাইক। পর্নডাইক মনোবিজ্ঞানী হিসেবে গবেষণাগারে বিভিন্ন প্রাণীর শিক্ষণ-সম্পর্কে গবেষণা পরিচালনার মাধ্যমে তার পেশা শুরু করেন। এসব গবেষণার মাধ্যমে তিনি অনুষঙ্গবাদের একটি শক্তিশালী ভিত্তি রচনা করেন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url