মতবাদ হিসেবে কাঠামোবাদের বৈশিষ্ট্য। অথবা, কাঠামোবাদের পাঁচটি স্বতঃসিদ্ধ
জার্মান মনোবিজ্ঞানী Wilhelm wundt (1832-1920) লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাঠামোবাদের সূচনা করেন।
মতধারা হিসেবে কাঠামোবাদের বৈশিষ্ট্য
নিম্নে কাঠামোবাদের পাঁচটি স্বতঃসিদ্ধ আলোচনা করা হলো-
১. মনোবিজ্ঞানের সংজ্ঞা (Definition of Psychology)
কাঠামোবাদীদের মতে 'মনোবিজ্ঞান হলো অন্তর্দর্শন-পদ্ধতির মাধ্যমে সাধারণীকরণকৃত প্রাপ্তবয়স্ক স্বভাবি মানবমনের বিশ্লেষণাত্মক অনুধ্যান'। এই সংজ্ঞাটি থেকে বোঝা যায়, উন্ড এবং টিচেনার ব্যক্তিক ভিন্নতা (Individual differences) এবং শিশু ও অস্বভাবী মানবমনের গবেষণাকে মনোবিজ্ঞানের আওতাভুক্ত করেননি।
২. মৌলিক স্বতঃসিদ্ধ (Basic postulates)
কাঠামোবাদের স্বতঃসিদ্ধগুলো কোনো রীতিবদ্ধ স্বতঃসিদ্ধ নয়। মনোবিজ্ঞানীদের কীভাবে কাজ করতে হবে তার দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য থেকে সেগুলো সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তবে এ সকল বক্তব্য থেকে কাঠামোবাদের স্বতঃসিদ্ধের সঠিক সংখ্যা এবং যথার্থতা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় যৌক্তিক বক্তব্য পাওয়া যায় না।
১. জ্ঞান হলো অভিজ্ঞতা-নির্ভর; যুক্তি বা চিন্তা-নির্ভর নয়। জন্মগতভাবে বা অভিজ্ঞতা ব্যতীত জ্ঞানলাভ সম্ভব নয়।
২. মনোবৈজ্ঞানিক অনুধ্যানের দুটি কার্যকর ধারণা হলো-মন এবং চেতনা। এই দুটি ধারণাই মনোবিজ্ঞানের যথার্থ বিষয়বস্তু হতে পারে।
৩. মনোবৈজ্ঞানিক অনুধ্যানের তথা মন ও চেতনা অনুধ্যানের যথার্থ পদ্ধতি হলো অন্তর্দর্শন। অন্তর্দর্শন-পদ্ধতির কার্যকর প্রয়োগের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষক আবশ্যক।
৪. চেতনার ক্ষেত্রে কতগুলো সাধারণ নিয়ম ও সূত্র প্রযোজ্য।
৫. মন ও দেহ দুটি সমান্তরাল ব্যবস্থা (System)।
৬. মনোবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির দুটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এ দুটি বৈশিষ্ট্য হলো নিয়ন্ত্রণ (Control) এবং বিশ্লেষণ (Analysis)।
৭. পরীক্ষণের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন এবং অন্যান্য পদ্ধতিকে অবৈজ্ঞানিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
৩. উপাত্তের স্বরূপ (Nature of the data)
উন্ড এবং টিচেনার উভয়ই মনোবিজ্ঞানের পদ্ধতি হিসেবে অন্তর্দর্শনকে বেছে নিয়েছিলেন। তবে উন্ডের অন্তর্দর্শন অপেক্ষা টিচেনারের অন্তর্দর্শন ছিল অধিক সুসংগঠিত এবং পরিশীলিত। টিচেনার বিশ্বাস করতেন, মনোবিজ্ঞানের উপাত্ত সংগৃহীত হবে অন্তর্দর্শনের মাধ্যমে এবং কঠোর নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষণ-পরিস্থিতি থেকে যা নিঃসন্দেহে অন্যান্য বৈজ্ঞানিক উপাত্তের ন্যায় বস্তুনিষ্ঠ হবে।
৪. মন ও দেহের অবস্থান (Mind-Body position)
স্বতঃসিদ্ধর আলোচনায় বলা হয়েছে, মন ও দেহ দুটি সমান্তরাল ব্যবস্থা। এই ক্ষেত্রে টিচেনার উন্ডের মনোদৈহিক সমান্তরালবাদ (Psycho-physical Parallelism)-কে গ্রহণ করেছেন। তবে, টিচেনার দেহ ও মনের ঐক্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন। টিচেনার জ্ঞান বলতে অভিজ্ঞতাকে নির্দেশ করেছে। তার এই মতবাদ ম্যাক (1838-1916)-এর মতবাদের অনুরূপ। ম্যাক বলেছেন, সংবেদন বা অভিজ্ঞতাই সকল বিজ্ঞানের ভিত্তি। অভিজ্ঞতা বলতে টিচেনার দৈহিকর কিংবা মানসিক অভিজ্ঞতাকে নয়; বরং সামগ্রিক অভিজ্ঞতাকে বুঝিয়েছেন। টিচেনার অভিজ্ঞতাকে চরম সত্য বলে ধরে নিয়েছেন।
এ সম্পর্কে টিচেনারের একটি বাড়তি ভাবধারা রয়েছে। তা হলো অধিবিদ্যার তাত্ত্বিক চিন্তাধারায় এমন এক পর্যায় আছে যখন বস্তু এবং আত্মা বিলুপ্ত হয়ে একক অভিজ্ঞতার ধারাকে স্থান করে দেয়। এরূপ ধারণার প্রেক্ষিতে স্বভাবতই মনে হয় টিচেনার মন এবং দেহকে অভিজ্ঞতার দুটো দিক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। টিচেনার মনে করতেন যে, দেহ ও মনকে পৃথক বিবেচনা করা যায় না। তবে মন এবং দেহ সম্বন্ধে টিচেনারের চিন্তাধারায় যাই থাকুক না কেন উন্ডের সমান্তরালবাদকে ভিত্তি হিসেবে রেখেছেন।
৫. সংযোজন-নীতি (Principles of connection)
১. টিচেনারের মতে চেতনার বা মনের উপাদানের স্বরূপ নির্ণয় করাই মুখ্য এবং উপাদানসমূহ কীভাবে সংযোজিত হয় তা নির্ণয় করা গৌণ।
২. চেতনার উপাদানগুলোর স্বরূপ নির্ণয় করার পর আসবে সংযোজন-নীতির প্রয়োজনীয়তা। সুতরাং চেতনার (অভিজ্ঞতা) উপাদানসমূহের বিশদ বৈশিষ্ট্য বা কাঠামো প্রথমে উন্মোচন করতে হবে। ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকবৃন্দ চেতনার তিনটি উপাদানের কথা বলেছেন। উন্ড এবং টিচেনার সেই তিনটি উপাদান পরীক্ষণমূলক পদ্ধতিতে যাচাই করেছিলেন এবং সত্যতা স্বীকার করেছিলেন। চেতনার তিনটি মৌলিক উপাদান হলো-
ক. সংবেদন Sensations),
খ. প্রতিরূপ (Images)
গ. অনুভূতি (feelings)
এখানে, সংবেদন হলো প্রত্যক্ষণের উপাদান, প্রতিরূপ হলো ধারণার মৌলিক উপাদান এবং অনুভূতি হলো অভিব্যক্তির উপাদান।
সংবেদন এবং প্রতিরূপের মধ্যে পার্থক্য হলো, প্রতিরূপ সংবেদন অপেক্ষা কম জীবন্ত বা স্পষ্ট, কম তীব্র এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কম স্থায়ী। সংযোজন-নীতি সম্পর্কে জনতে হলে চেতনার উপাদানগুলোর ক্রিয়া বা প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে হবে।
৩. চেতনার উপাদানগুলো বস্তুর মতো নয়। এই উপাদানগুলো হলো প্রক্রিয়া এবং এই প্রক্রিয়া সংযোজন-নীতির মাধ্যমে হয়ে থাকে। তাই টিচেনার প্রক্রিয়ার বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য হয়েছিল।
- দুটি উপাদানের মধ্যে সংযোগের কারণ হলো নৈকট্য (Contiguity)
- একটি একক সংবেদনের কোনো অর্থ (Meaning) নেই। একটি সংবেদনের অর্থ (Meaning) তৈরি হয় যখন এর সংবেদনের পটভূমি ও প্রতিরূপের সমন্বয় ঘটে। সংবেদনের পটভূমি হলো সংবেদনটির অতীত অভীজ্ঞতা। সুতরাং সংবেদনের অর্থ হলো সংবেদনটির অতীত অভিজ্ঞতা ও প্রতিরূপসূহের সংযোজনের ফল।
- টিচেনারের মতে, সংবেদন হলো প্রত্যক্ষণের উপাদান। সংবেদনের কোনো অর্থ নেই; বরং প্রত্যক্ষণের অর্থ রয়েছে। সংবেদন একটি অর্থ বহন করে যা শারীরবৃত্তীয় পর্যায় ঘটে, চেতন পর্যায়ে ঘটে না।
তিনি সংযোজন এবং ক্রিয়াকে একই দৃষ্টিতে দেখেছেন। তিনি মনের ক্রিয়াকে স্বীকৃতি দিয়েছেন, তবে প্রাথমিকভাবে চেতনার উপাদান বা কাঠামোর উপর বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন।
৬. নির্বাচন-নীতি (Principles of Selection)
কোন কোন উদ্দীপক চেতনায় অন্তর্ভুক্ত হয়? এ সমস্যার সমাধান দিতে গিয়ে টিচেনার মনোযোগ ধারণাটি অবতারণা করেন। মনোযোগ হলো সংবেদনের সুস্পষ্টতা। টিচেনারের মতে, মনোযোগের তিনটি পর্যায় রয়েছে। পর্যায় তিনটি হলো-
১. প্রাথমিক বা মুখ্য মনোযোগ (Primary Attention): এটা হলো প্রথামিক পর্যায়ের জন্মগত (Native) বা সহজাত ও অনৈচ্ছিক মনোযোগ। এরূপ মনোযোগের উপর উদ্দীপকের আকৃতি (size), তীব্রতা (intensity), গুণ (quality), নতুনত্ব (novelty) ও স্বতঃস্ফূর্ত পূর্ব-প্রস্তুতি (Sponteneous Pre set) ইত্যাদি সংবেদী অভিজ্ঞতার সহজাত উপাদান প্রভাব বিস্তার করে।
২. মাধ্যমিক বা গৌণ মনোযোগ (Secondary attention): এটা হলো দ্বিতীয় পর্যায়ের ঐচ্ছিক মনোযোগ। মুখ্য মনোযোগের উপাদানসমূহের প্রভাব হ্রাস পেলে মনোযোগ ধরে রাখার জন্য ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয়।
৩. তৃতীয় পর্যায়ের বা অভ্যাসগত মনোযোগ (Tartiary or Habitual Attention): এটা হলো তৃতীয় পর্যায়ের শিক্ষা বা অভিজ্ঞতালব্ধ অভ্যাসগতভাবে অর্জিত মনোযোগ। এ পর্যায়ই হলো মনোযোগের চরম লক্ষ্য। এ পর্যায়ে মনোযোগ অনেকটা অনৈচ্ছিক হয়ে পড়ে। কিন্তু এরূপ অনৈচ্ছিকতা শিক্ষা ও অভিজ্ঞতালব্ধ বিকাশের উপর নির্ভরশীল, সহজাত ঘটনার উপর নির্ভরশীল নয়।
টিচেনারের মতে, মনোযোগের এ তিনটি পর্যায়কে স্পষ্টভাবে পৃথক করা যায় না। সুতরাং এ তিনটি পর্যায়ের ভেতর একটি অবিচ্ছিন্নতা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মনোবিজ্ঞানের একটি বই পড়ার আগ্রহ সম্বন্ধে আলোচনা করা যেতে পারে। প্রথমত, মনোবিজ্ঞান বিষয়টির নতুনত্ব অথবা বিষয়টি সম্পর্কে পূর্বধারণা-প্রসূত স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ পাঠকের মনে মনোবিজ্ঞানের প্রতি প্রাথমকি বা মুখ্য মনোযোগ তৈরি করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, মনোবিজ্ঞান বিষয়টি পড়তে পড়তে যখন মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর দুরূহতা অথবা পূর্ব-প্রত্যাশার অসামঞ্জস্য পাঠকের মনে একটি নেতিবাচক মনোভাবের উদ্রেক করতে পারে। তখন মনোযোগকে আগের মতো নিবদ্ধ অবস্থায় ধরে রাখা যাবে না। এ পর্যায়ই হলো মনোযোগের দ্বিতীয় পর্যায়। এই পর্যায় কাটিয়ে উঠতে প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয়।
তৃতীয়ত, দ্বিতীয় পর্যায়টি যদি শিক্ষার্থী কোনো রকমে কাটিয়ে উঠতে পারে তাহলে বিষয়বস্তুর সাথে গভীরভাবে পরিচিতি মনোযোগকে আবার মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর প্রতি নিবদ্ধ রাখতে সহায়তা করবে। আর তখনি উদ্ভব হবে মনোযোগের তৃতীয় পর্যায়।
উপসংহার
কাঠামোবাদ মনোবিজ্ঞানকে নিঃসন্দেহে একটি বৈজ্ঞানিক মর্যাদাসম্পন্ন বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। তাছাড়া, দর্শনের নাগপাশ থেকে মুক্ত করে মনোবিজ্ঞানকে একটি অভিজ্ঞতালব্ধ বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কৃতিত্ব কাঠামোবাদের। তবে কাঠামোবাদীরা সমালোচকদের কঠোর সমালোচনারও সম্মুখীন হয়েছেন