গবেষণার উপাত্ত সংগ্রহের প্রশ্নমালা পদ্ধতি
গবেষণায় উপাত্ত সংগহের জন্য বহুল ব্যবহৃত একটি পদ্ধতি হলো প্রশ্নমালা পদ্ধতি। এই পদ্ধতি স্বল্পসময়ে অধিক সংখ্যক নমুনা থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করা যায়। নিম্নে এই পদ্ধতি আলোচনা করা হলো-
প্রশ্নমালা পদ্ধতি
প্রশ্নমালা হলো কোনো একটি সমস্যার বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানার জন্য নির্ধারিত সকল প্রশ্নের সমন্বয়। অর্থাৎ যে সকল প্রশ্নের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সমস্যার সবদিক সম্পর্কে জানা সম্ভব, সে সকল প্রশ্নের সেটকে প্রশ্নমালা বলে। এর দ্বারা উত্তরদাতা কারো সাহায্য ছাড়াই নিজে নিজে প্রশ্নমালা পূরণ করে থাকেন। সুতরাং প্রশ্নমালা হলো কতগুলো প্রশ্নের সমন্বয়ে গঠিত একটি ফরম, যা উত্তরদাতা নিজেই পূরণ করে প্রশ্নের উত্তর প্রদান করেন। এটি উত্তরদাতার কাছে সরাসরি পৌঁছে দেওয়া হয় অথবা ডাকযোগে পাঠানো হয় এবং উত্তরদাতা সেটি পূরণ করে গবেষকের ঠিকানা সম্বলিত ডাকটিকিটযুক্ত ফেরতে উত্তরদাতার ব্যয় ও ঝামেলা কম হয়। প্রায়ই আমরা কোনো না কোনোভাবে প্রশ্নমালা পূরণের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে থাকি। যেমন- ব্যাংকে হিসাব খোলা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, চাকরির জন্য আবেদনপত্র পূরণ ইত্যাদি। তবে গবেষণায় ব্যবহৃত প্রশ্নমালা প্রণয়ন ও পূরণের ক্ষেত্রে আরো বেশি বিধিবদ্ধ নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। একইসাথে অনেক বেশি সংখ্যক ব্যক্তির কাছ থেকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে ও দ্রুততার সাথে কোনো বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রশ্নমালার মাধ্যমে পরিচালিত জরিপ একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি।
প্রশ্নমালা পদ্ধতির সুবিধা
সামাজিক গবেষণার তথ্য সংগ্রহের বহুল প্রচলিত এবং জনপ্রিয় পদ্ধতি হলো প্রশ্নমালা পদ্ধতি। কেননা এ পদ্ধতিতে দেশের বিস্তৃত এলাকায় কম সময়ে দ্রুততার সাথে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। তবে প্রশ্নমালা পদ্ধতির যে সকল বিশেষ সুবিধা রয়েছে, তা হলো-
১। কম ব্যয়সাপেক্ষ: প্রশ্নপত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা হলো-এটা কম ব্যয় সাপেক্ষ। কেননা এতে উত্তরদাতার কাছে ডাকযোগে বা লোক মারফত প্রশ্নপত্র পাঠিয়ে দিতে হয় এবং সেখানে কোন তথ্য সংগ্রহকারীর উপস্থিতি প্রয়োজন হয় না। ফলে তথ্য সংগ্রহে তুলনামূলকভাবে কম খরচ হয়।
২। বিস্তৃত এলাকায় তথ্য সংগ্রহ: প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে একটি বিস্তৃত এলাকার জনসাধারণ কিংবা বিচ্ছিন্ন জনসাধারণের কাছ থেকে সহজে তথ্য সংগ্রহ করা যায়। বিশেষ করে যখন কোন উত্তরদাতা গবেষকের নিকট হতে দূরে থাকেন এবং তার মুখোমুখি হওয়া অসম্ভব হয়ে উঠে, তখন এই পদ্ধতি বেশ উপকারী।
৩। পক্ষপাতদুষ্টতা মুক্ত: ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের অসুবিধা হলো এতে প্রাপ্ত তথ্য সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আশা-আকাঙ্খা বা মতামত দ্বারা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে। কিন্তু প্রশ্নমালার মাধ্যমে সংগ্রহীত তথ্য পক্ষপাতদুষ্টতা থেকে অনেকাংশে মুক্ত।
৪। ব্যক্তিগত সাক্ষাৎহীনতা: প্রশ্নমালা পদ্ধতির বিশেষ আরেকটি সুবিধা হলো এতে তথ্য সংগ্রহের জন্য উত্তরদাতার সাথে কোন রকম ব্যক্তিগত সাক্ষাতের প্রয়োজন হয়না।
৫। কম দক্ষতার প্রয়োজন: সাক্ষাৎকার কিংবা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে ব্যাপক দক্ষতা সম্পন্ন লোকের প্রয়োজন হয়। কিন্তু প্রশ্নমালা পদ্ধতিতে তুলনামূলভাবে কম দক্ষতা সম্পন্ন লোক দিয়েও তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়।
৬। নির্ভরযোগ্য তথ্যের সম্ভাবনা বেশী: প্রশ্নপত্রের বিশেষ সুবিধা হলো এর মাধ্যমে নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রাপ্তির সম্ভাবনা বেশি থাকে। কেননা উত্তরদাতা সময় নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যক্তির সাথে আলোচনা সাপেক্ষ সঠিক উত্তর দিতে পারে। পরে এর নির্ভরযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়।
৭। সঠিক তথ্য: প্রশ্নমালা পদ্ধতির মাধ্যমে অনেক সঠিক তথ্য পাওয়া যায়। সে সব ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি অনেক বেশি সুবিধাজনক।
৮। সংবেদনশীল তথ্য: মানুষের জীবনে এমন অনেক সংবেদনশীল বিষয় আছে যা সে মুখে বলতে পারে না, বরং লিখে প্রকাশ করতে সে স্বচ্ছান্দ্যবোধ করে। এ সকল সংবেদনশীল তথ্য প্রশ্ন পত্রের মাধ্যমে সহজে পাওয়া যায়।
৯। বিচ্ছিন্ন উত্তরদাতা: এমন অনেক বিষয় আছে যে ক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহের জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে থাকা উত্তরদাতার কাছে যেতে হয়। এসব ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে তথ্যসংগ্রহ অত্যন্ত সুবিধাজনক।
প্রশ্নমালা পদ্ধতির অসুবিধা
প্রশ্নমালা পদ্ধতির মাধ্যমে তথ্যসংগ্রহ সুবিধাজনক হলেও এ পদ্ধতির কতগুলো অসুবিধা রয়েছে। প্রশ্নমালা পদ্ধতির অসুবিধাগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো-
১। অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অনুপযোগী: প্রশ্নপত্র পদ্ধতির প্রধান অসুবিধা হলো এটা অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য অনুপযুক্ত। কেননা এটার সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষিত জনগণ যাতে তারা প্রশ্নপত্র পড়তে, বুঝতে এবং নির্ভুলভাবে পূরণ করতে পারে। কিন্তু কোন দেশের জনগণ শতভাগ শিক্ষিত না হলে এটা ব্যবহার করা যায় না।
২। প্রশ্নপত্র ফেরত না পাওয়া: প্রশ্নপত্র পদ্ধতির অপর অসুবিধা হলো-প্রশ্নপত্র যথাথভাবে ফেরত না পাওয়া। সাধারণতঃ একটি প্রশ্নপত্র পূরণ করে ফেরত পাঠানোর জন্য নির্দিষ্ট সময় দেয়া থাকে। কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই উত্তরদাতার ব্যস্ততা, স্মরণ না থাকা কিংবা অন্যকোন কারণে প্রশ্নপত্র নির্দিষ্ট সময়ে ফেরত পাঠায় না, যা তথ্য সংগ্রহের অন্তরায়।
৩। পর্যবেক্ষণের সুযোগ না থাকা: ডাকযোগে প্রেরিত প্রশ্নপত্রের সবচেয়ে বড় ত্রুটি হলো-প্রেরিত উত্তরকেই চুড়াড় বলে ধরে নিতে হয়। উত্তরের যথার্থতা, কিংবা দুর্বোধ্য প্রশ্নের উত্তর বুঝার কোন উপায় থাকে না। এমনকি উত্তরদানের সময় তার বলার ভঙ্গি, আচরণ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণের সুযোগও থাকেনা।
৪। স্বতঃস্ফূর্ততার অভাব: যদি কোন উত্তরদাতার নিকট হতে স্বতঃস্ফূর্ত উত্তর চাওয়া হয় সে ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র পদ্ধতি যথাযথ হয় না। কেননা একজন উত্তরদাতা অনেক সময় অন্যের কাছে শুনে উত্তর দিতে পারে। ফলে তার জ্ঞানের মাত্রাও বুঝা কঠিন হয়ে পড়ে।
৫। উত্তরদাতার ব্যাখ্যার সুযোগ থাকে না: কোন উত্তর প্রদানের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য উত্তরের বিকল্প কোন ব্যাখ্যা উত্তরদাতার কাছে থাকতে পারে। কিন্তু প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে গবেষকের কাছে সে ব্যাখ্যা প্রদানের সুযোগ কম থাকে। যা এ পদ্ধতির বিশেষ অসুবিধা।
৬। ত্রুটিপূর্ণ প্রিন্টিং: প্রশ্নমালা পদ্ধতির বিশেষ আরেকটি অসুবিধা হলো এতে অনেক ত্রুটিপূর্ণ অস্পষ্ট প্রিন্ট হয়ে থাকে, যা উত্তরদাতার পক্ষে অনেক সময় বুঝতে কষ্ট হতে পারে।
উপসংহার:
যখন একই সাথে অনেক বেশী সংখ্যক ব্যক্তির কাছ থেকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে ও দ্রুততার সাথে কোন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজন হয়, তখন প্রশ্নমালা পদ্ধতি অধিক উপযোগী।