প্রাক-বিজ্ঞান যুগে মনোবিজ্ঞানের ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশ

আক্ষরিক অর্থে মনোবিজ্ঞান বলতে মনের বিজ্ঞানকে বোঝায়। আক্ষরিক অর্থের উপর ভিত্তি করে অনেকে মনে করে মনোবিজ্ঞান শুধু মন নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু মানুষের এই ধারণা ভুল। মনোবিজ্ঞান হলো মানুষ ও প্রাণীর আচরণ ও মানসিক প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক অনুধ্যান-সংক্রান্ত বিজ্ঞান। মনোবিজ্ঞানীগণ এখন মানুষের আচরণ সম্বন্ধে অনুধ্যান করেন এবং এরূপ অনুধ্যান কাজে পরীক্ষণ ও নিরীক্ষণ পদ্ধতিসহ বিভিন্ন প্রকারের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ করে থাকে।

যুগসমূহ

আধুনিক মনোবিজ্ঞানের ইতিহাস বেশি দিনের নয়, এ কথা সত্য। কিন্তু এর সত্যিকারের ইতিহাস শুরু হয়েছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের নক্ষত্র গ্রিক দার্শনিক প্লেটো এবং এরিস্টটলের সময়। তাঁরা মনে করতেন মনোবিজ্ঞান মন বা আত্মা সম্পর্কিত বিজ্ঞান। সূচনালগ্ন থেকে মনোবিজ্ঞানের নাম, বিষয়বস্তু, পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া বিজ্ঞানসম্মত ছিল না। মনোবিজ্ঞান কীভাবে বিজ্ঞান হলো তার একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে। তবে মোটামুটিভাবে বলা যায় যে, মনোবিজ্ঞানের ইতিহাস প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত:

  1. প্রাচীন যুগ (খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতক পর্যন্ত)
  2. মধ্য যুগ (খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতক থেকে ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত)
  3. আধুনিক যুগ (১৮৭৯ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত)

প্রাচীন যুগের সময়: মনোবিজ্ঞানের ইতিহাসের এই তিনটি পর্যায়কে সময়ের ভিত্তিতে সুনির্দিষ্টভাবে পৃথক করা বেশ কঠিন কাজ। তবে বলা যায় যে, প্রাচীন গ্রিক দর্শনের আমল, অর্থাৎ প্রাক-সক্রেটিস আমল (খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০) থেকে মনোবিজ্ঞানের 'প্রাচীন যুগ' শুরু হয়। এই যুগের চিন্তাবিদদের মধ্যে পিথাগোরাস, সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লেটো প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

মধ্যযুগের সময়: মনোবিজ্ঞানের ইতিহাসের মধ্যযুগের প্রথম দিকে এর অগ্রগতি খুবই মন্থর ছিল। পঞ্চম থেকে পঞ্চদশ পর্যন্ত ধর্মীয় আধ্যাত্মবাদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। ইউরোপের রেনেসাঁর পর জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্রুত অগ্রগতির সাথে সাথে মনোবিজ্ঞানের ভিত্তিও সুদৃঢ় হয়। এই যুগের চিন্তাবিদদের মধ্যে সেন্ট অগাস্টিন, টমাস একুইনাস, ইবনে সিনা, রেনে দেকার্ত, জন লক প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ছিলেন। ষোড়শ শতকের ফরাসি দার্শনিক দেকার্তের দ্বৈতবাদ এবং জন লকের অভিজ্ঞতাবাদ দার্শনিক চিন্তাধারায় আলোড়ন সৃষ্টি করে।

আধুনিক যুগ: আধুনিক যুগের সমৃদ্ধ হয় জোহান্স মুলার, ই.এইচ, ওয়েবার ও জি.টি. ফেকনার, ই.বি.টিচেনার এবং উইলহেল্ম উন্ড কর্তৃক শারীরতাত্ত্বিক ও সাইকোফিজিক্যাল গবেষণার মাধ্যমে। আধুনিক যুগের আরেকটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো ডারউইনের বিবর্তনবাদ। এছাড়াও ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস গ্যাল্টন দেহপরিমাপন ল্যাবরেটরি স্থাপন করে মনোদৈহিক বৈশিষ্ট্য পরিমাপের চেষ্টা করেন। জার্মান মনোবিজ্ঞানী উইলহেল্ম উন্ড কর্তৃক জার্মানির লেইপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান গবেষণাগার স্থাপনের পর ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আধুনিক যুগের বিকাশ পূর্ণতা পায়।

প্রাক-বৈজ্ঞানিক যুগসমূহের আলোচনা 

মনোবিজ্ঞানের ইতিহাসে তিনটি যুগ বা পর্যায়কে কয়েকজন দার্শনিকের মতবাদের বা ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণের ভিত্তিতে নিম্নে বর্ণনা করা হলো:

প্রাচীন যুগ: প্রাচীন যুগের মনোবিজ্ঞানের ঐতিহাসিক অগ্রগতি আলোচনা করতে হলে আমাদের গ্রিক দার্শনিক যুগে চলে যেতে হবে। প্রাকসক্রেটিস আমলে খ্রিষ্টপূর্ব (৬০০-৪৫০) সময়ে গ্রিক দার্শনিকরা আত্মা বলতে এমন একটি প্রাণশক্তিকে বোঝাতেন যা দৈহিক জীবনের জন্য প্রয়োজনীয়। তাদের মতে, দেহই আত্মার ধারক ও বাহক। দেহ ছাড়া আত্মা নির্জীব ও সংবেদনহীন। খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীতে গ্রিক দার্শনিক এস্পিডক্লিস (Empedocles) অভিমত ব্যক্ত করেন যে, বস্তু এবং ইন্দ্রিয় উভয়ের মধ্যে থেকে আলোকরশ্মি হওয়ার কারণেই আমাদের পক্ষে দর্শনসংবেদন সম্ভব হয়। এই যুগের চিন্তাবিদদের মধ্যে পিথাগোরাস, সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লেটো প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

১. এরিস্টটল: এরিস্টটল খ্রিষ্টপূর্ব (৩৮৪-৩২২) De anima নামক গ্রন্থে আত্মা সম্পর্কে গ্রিক দার্শনিকদের মতামত বিষদভাবে আলোচনা করেন এবং এ সমন্ধে সুসংবদ্ধ ও পূর্ণাঙ্গ ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেন। তিনি উৎকর্ষের মাত্রা অনুসারে আত্মাকে বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত করেছেন; যেমন-

ক. উদ্ভিদাত্মা: এরিস্টটলের মতে, উদ্ভিদাত্মা, নিম্নতর স্তর। এর কাজ শুধু পুষ্টি সাধন ও বংশবৃদ্ধি।

খ. জীবাত্মা: উদ্ভিদাত্মার চেয়ে উচ্চতর স্তরের আত্মার নাম জীবাত্মা। জীবাত্মার তিনটি শক্তি; যথা- প্রত্যক্ষণ, বাসনা এবং গতি।

গ. মানবাত্মা: এরিস্টটলের মতে, নিজের কার্যকলাপের উপর প্রাণীর কোনো নিয়ন্ত্র নেই। তাঁর মতে, জীবাত্মার চেয়ে মানবাত্মা উচ্চতর স্তরের। এখানে সুখ-দুঃখের অনুভূতি বিদ্যমান। এ আত্মা বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বস্তুর গুণাবলি সম্পর্কে অবহিত হয়। মানবাত্মার একটি উন্নত শক্তি বিদ্যমান। এরিস্টটল আবার মানবাত্মাকে প্রজ্ঞাসঞ্জাত আত্মা বলেছেন।

২. প্লেটো: প্লেটো খ্রিষ্টপূর্ব (৪২৮-৩৪৭) এই সময়ে মানুষের জ্ঞানের দুটি স্তরের কথা বলেন। এ দুটি হচ্ছে- সংবেদনমূলক এবং বিদ্যাবৃত্তিমূলক।

জ্ঞানের এ দুটি স্তরের উপর ভিত্তি করে প্লেটো জড় ও আধ্যাত্মিক জগতের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করেন এবং আত্মা সম্বন্ধে ধারণা দেন। তিনি মনে করতেন মানবাত্মা বিশ্বআত্মার অংশ মাত্র। 

তিনি বলেন মানবাত্মার তিনটি অংশ আছে; যথা:

প্রজ্ঞাংশ (Rational part)

  • আত্মার প্রজ্ঞাংশ স্বপরিচালিত,
  • বাইরের কোনো শক্তি দ্বারা প্রজ্ঞাংশের গতি নিয়ন্ত্রিত হয় না
  • আত্মার এ অংশ অবিনশ্বর।

বীর্যাংশ (Spirited part)

  • এ অংশের উৎপত্তি দেহ থেকে।

কমনাংশ (Appetitive part)

  • উৎপত্তি দেহ থেকে
  • মৃত্যু ঘটলে আত্মার এ অংশটি বিনষ্ট হয়ে যায়।

৩. ডেমক্রিটাস: গ্রিক দার্শনিক ডেমক্রিটাস খ্রিষ্টপূর্ব (৪৬০-৩৭০)-এর মতে, দেহ ও আত্মা একই পদার্থ দ্বারা গঠিত; অর্থাৎ, অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরমাণু দিয়ে দেহ ও আত্মা গঠিত। তাঁর মতে, পরমাণুর গতিশক্তি মানুষের মনে চিন্তা ও কার্যাবলির উদ্রেক ঘটায়। 

৪. হিপোক্রেটিস: হিপোক্রেটিস নামে একজন গ্রিক চিকিৎসক খ্রিষ্টপূর্ব (৪০০) অব্দে প্রথম মানুষের ব্যক্তি সম্পর্কে ধারণা দেন। 

তিনি মনে করেন মানুষের শরীর ৪ প্রকার তরল পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত; যেমন:

  • রক্ত (Blood)
  • হলুদ পিত্ত (Yellow bile)
  • কৃষ্ণ পিত্ত (Black bile)
  • শ্লেষ্মা (Phlegm)

উপর্যুক্ত একেকটি তরল পদার্থের কারণে মানুষ একেক রকম হয় এবং তিনি প্রথম মানুষের শরীরের গড়নের সাথে ব্যক্তিত্বের সম্পর্ক দেখাতে চেষ্টা করেছিলেন।

৫. সক্রেটিস: সক্রেটিস খ্রিষ্টপূর্ব (৪৬৯-৩৯৯): এই সময়ে সর্বপ্রথম আত্মাকে একটি একক শক্তি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন আত্মা এমন একটি শক্তি যা ব্যক্তির ভালো-মন্দ আচরণের জন্য দায়ী।

মধ্যযুগ: মধ্যযুগীয় দর্শন (খ্রিষ্টীয় ৫ম শতক থেকে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত) এ সময় ধর্মীয় আধ্যাত্মবাদের দ্বারা প্রভাবিত। এই সময় দার্শনিক চিন্তার মূল বিষয় হিসেবে স্থান করে নেয় তিনটি বিষয়; যথা- আত্মার স্বরূপ, দেহের সাথে আত্মার সম্পর্ক ও ধর্মীয় বিষয়ের ব্যাখ্যা প্রদান প্রভৃতি। মধ্যযুগের দার্শনিক ও চিন্তাবিদদেরকে দুইটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়; যথা-

১. যাজক শ্রেণির চিন্তাবিদ: যাজক শ্রেণির চিন্তাবিদদের মধ্যে সেন্ট অগাস্টিন ও টমাস একুইনাস উল্লেখযোগ্য ছিলেন।

২. দার্শনিক শ্রেণির চিন্তাবিদ: দশনিক শ্রেণির চিন্তাবিদদের মধ্যে রেনে দেকার্ত, জন লক, স্পিনোজা প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

পরিশেষে বলা যায় যে, মনোবিজ্ঞানে প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকগণ আত্মাকে জীবের মূল সত্তা হিসেবে জানতেন। মনোদর্শন বা মনস্তত্ত্বের বিষয়বস্তু বলতে মন, দেহ ও আত্মাকে বুঝিয়েছেন। দেহ ও আত্মাকে কেন্দ্র করে সংবেদন, প্রত্যক্ষণ, শিক্ষণ, স্মৃতি, প্রেষণা, আবেগ, ব্যক্তিত্ব মানসিক রোগ ইত্যাদির আলোচনাও পাওয়া যায়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url