ক্রিয়াবাদ প্রতিষ্ঠায় জন ডিউয়ির এবং জেমস এঙ্গেল সম্পর্কে আলোচনা
১৮৯৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে মতবাদ বা সিস্টেম হিসেবে ক্রিয়াবাদ প্রতিষ্ঠা করেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন ডিউয়ি এবং জেমস আর এনজেল। এই দুই জনই নব প্রতিষ্ঠিত শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানে অধ্যাপনা করতে আসেন।
জন ডিউয়ির অবদান
জন ডিউয়ি একাধারে একজন দার্শনিক, শিক্ষাবিদ এবং মনোবিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি ১৮৫৯ সালের ২৫ অক্টোবর আমেরিকার বার্লিংটনে জন্মগ্রহণ করেন। ভার্মাউন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে থাকাকালে তিনি দর্শনের প্রতি আগ্রহী হন। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে তিন বছর যাবৎ তিনি মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতাও করেন। কিন্তু জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় দর্শনের প্রতি তার আগ্রহ পরিবর্তিত হয়। তিনি জনস হপকিনস্ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্ট্যানলি হলের সাথে পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। জন ডিউয়ি প্রথম ব্যক্তি যিনি মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে একই সাথে দর্শন ও মনোবিজ্ঞান উভয় বিষয়ে শিক্ষাদান করতেন। কর্মজীবনে তিনি মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যায়ে অধ্যাপনা করে।
১.
১৮৮৬ সালে ডিউয়ি (Psychology) বই প্রকাশ করেন। এটিই আমেরিকায় প্রকাশিত মনোবিজ্ঞানের প্রথম বই। তৎকালীন সময়ে বইটি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তবে পরবর্তীকালে জেমস এর Principles of psychology (1890) বইটি প্রকাশ হওয়ায় ডিউয়ির বইয়ের জনপ্রিয়তা কমে যায়।
১৮৯৬ সালে তাঁর প্রকাশিত 'The Replax Arc concept in Psychology' প্রবন্ধটি মনোবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার ক্রমবিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই প্রবন্ধটিকে মনোবিজ্ঞানের একটি মাইল ফলক এবং ক্রিয়াবাদী মনোবিজ্ঞানের প্রাথমিক সূচনাকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই প্রবন্ধে তিনি আচরণকে প্রতিবর্তী ক্রিয়ার এককে বিশ্লেষণের বিরোধিতা করেন।
- ১৮৯৪ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নিযুক্ত হন। ১৮৯৬ সালে তিনি 'The Reflex are concept in psychology' প্রবন্ধটি লেখেন যা ক্রিয়াবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। বোরিং (১৯৫৩)-এর মতে, এই প্রবন্ধটি আমেরিকান ক্রিয়াবাদের স্বাধীন সূচনার ঘোষণাপত্র।
প্রতিবর্তী চক্রের ধারণা অনুসারে, আচরণ এক বা একাধিক প্রতিবর্তী চক্রের দ্বারা গঠিত হয় এবং প্রতিবর্তী চক্রে সংবেদী, নিয়ন্ত্রণকারী ও সঞ্চালন উপাদানসমূহ পৃথকভাবে কাজ করে।
- সংবেদী উপাদানসমূহ উদ্দীপক দ্বারা তৈরি হয় এবং সংবেদী স্নায়ুর মাধ্যমে প্রবাহিত হয়।
- নিয়ন্ত্রণকারী উপাদান মেরুরজ্জু ও মস্তিষ্কে কাজ করে।
- সঞ্চালন উপাদান যা গতিবাহী স্নায়ু দ্বারা প্রবাহিত হয়ে শেষে একটি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
কিন্তু ডিউয়ি-এর মতে, প্রতিবর্তী ক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে এর উপাদানসমূহকে সংবেদী প্রক্রিয়া (Sensory Process), মস্তিষ্ক প্রক্রিয়া (Brain Process) এবং সঞ্চালন প্রক্রিয়া (Motor process)-এ 'আলাদা আলাদাভাবে বিবেচনা করার' প্রক্রিয়াটি ভুল ও যান্ত্রিক। তার মতে, কোনো লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়াসমূহকে Co-ordinate system বা সমন্বিত প্রক্রিয়া হিসেবে প্রত্যক্ষণ করতে হবে যা প্রাণীর জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য।
তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেন উইলিয়াম জেমস এবং বলডউইন প্রতিবর্তী ক্রিয়ার সাহায্যে আচরণের যে বিশ্লেষণ করেছেন পুরোপুরি সঠিক নয়। জন ডিউয়ি প্রাণীকে একটি অখণ্ড সত্তা হিসেবে বিবেচনা করেন। তার মতে, আচরণ হলো প্রাণীর সামগ্রিক সমন্বয়-সাধনপ্রক্রিয়া যা জীবকে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়।
২.
১৮৯০ সালে Psychology & Social Practice-বক্তৃতায় প্রগতিশীল শিক্ষা আন্দোলনের শুরু করেন যা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণার বিকাশ ঘটায়।
- শিক্ষাই জীবন,
- কাজের মাধ্যমে শিক্ষণ,
- শিক্ষণ হবে ছাত্র কেন্দ্রিক।
Dewey মনে করতেন, শিক্ষা Subject oriented না হয়ে student oriented হওয়া উচিত। আর এই জন্য কোনো কিছু শেখানোর জন্য বক্তৃতা না- দিয়ে হাতে কলমে শেখানো উচিত। তিনি আরও মনে করতেন যে, শিক্ষাকে সৃজনশীল বুদ্ধিমত্তার মাপকাঠিতে বিবেচনা করা উচিত এবং জটিল সমাজব্যবস্থায় বাস করার জন্য শিশুদেরকে প্রস্তুত করা উচিত।
৩.
১৯১০ সালে উপযোগ আচরণ হিসেবে চিন্তন (Thinking in adptive terms) একটি গবেষণাকর্ম প্রকাশ করেন। একজন বিবর্তনবাদী হিসেবে তিনি মনে করতেন যে, সামাজিক পরিবর্তন হলো অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু সঠিক কাজের পরিকল্পনার মাধ্যমে কিছুটা হলেও একে প্রভাবিত করা যায়।
পরিশেষে বলা যায় যে, ক্রিয়াবাদকে কাঠামোবাদের সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত না-করে গেলেও Dewey মনোবিজ্ঞানীদের কাছে ন্যায় সব সময় স্মরণীয় হয়ে আছেন। কারণ তিনি বহুসংখ্যক উৎসাহী মনোবিজ্ঞানী তৈরি করেছেন এবং ক্রিয়াবাদের দার্শনিক ভিত্তি তৈরি করেছেন। John Dewey ১৯৫২ সালের ১ জুন ৯৩ বছর বয়সে মারা যান।
জেমস আর এনজেল এর অবদান
জেমস রাউল্যান্ড এনজেল (১৮৬৯-১৯৪৯) মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। এরপর তিনি হার্ভার্ডে জেমসের সাথে পড়াশোনা করেন। তিনি জার্মানির University of Halle-তেও পড়াশোনা করেছেন। ১৮৯৬ সালে তার প্রথম প্রবন্ধ Psychological Review সাময়িকীতে প্রকাশ হয়। ১৯০৪ সালে অ্যাঞ্জেল প্রকাশ করেছিলেন তার বিখ্যাত বই Psychology: An Introductory Study of the Structure and Functions of Human Consciousness.
১. প্রতিক্রিয়া-কালের উপর গবেষণাকর্ম:
James R. Angell প্রথম পরীক্ষণমূলক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন A.W. moore-এর যৌথভাবে প্রতিক্রিয়াকাল সম্পর্কে ফলাফল প্রকাশের মাধ্যমে। এই গবেষণায় তিনি বলডউইন ও টিচেনারের মতের পার্থক্য দূর করতে চেষ্টা করেন। টিচেনারের মতে, পরীক্ষণপাত্ররা যদি প্রতিক্রিয়ার উপর মনোযোগ নিবদ্ধ করে তখন প্রতিক্রিয়া কাল কম হয়। কিন্তু বলডউইনের মতে, পরীক্ষণপাত্ররা যদি উদ্দীপকের উপর মনোযোগ নিবদ্ধ করে তাহলে প্রতিক্রিয়ার কালও কম হয়। Angell ও Moor-এর মতে অশিক্ষিত তথা প্রশিক্ষণবিহীন পরীক্ষণ পাত্রদের বেলায় প্রতিক্রিয়া কালের ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ করা যায় এবং কিছু সংখক ব্যক্তির সংবেদীয় প্রতিক্রিয়া কাল কম। কিন্তু অনুশীলন যত বড়তে থাকে পেশির প্রতিক্রিয়াকাল তত কমতে থাকে। James R. Angell বলডউইন এবং টিচেনারের বিতর্কের সমাধান করতে গিয়ে কাঠামোবাদী এবং ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরেন। কাঠামোবাদীরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পরীক্ষণপাত্রের উপর গুরুত্বারোপ করত; অন্যদিকে ক্রিয়াবাদীরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং প্রশিক্ষণবিহীন উভয় ধরনের পরীক্ষণ-পাত্র গ্রহণ করতেন।
২. ক্রিয়াবাদের সংজ্ঞা স্পষ্টকরণ:
টিচেনার একটি ক্ষীয়মান মতবাদের সপক্ষে সংগ্রাম করেছিলেন। শতাব্দীর শেষের দিকে বিকাশ মনোবিজ্ঞান, প্রাণী মনোবিজ্ঞান, মানসিক অভীক্ষা ও সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানগুলিতে প্রভূত উন্নতি সাধন। James R. Angell কাঠামোবাদী ও ক্রিয়াবাদী মনোবিজ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে একটি বই Psychology: An Introductory Study of the Structure and Functions of Human Consciousness (১৯০৪) লেখেন। ১৯০৬ সালে Province of functional psychology শিরোনামে একটি বক্তৃতায় পরিষ্কারভাবে ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে আরোও স্পষ্ট করে তোলেন। বক্তৃতাটি ১৯০৭ সালে প্রকাশ হয়। James R. Angell ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিভঙ্গির তিনটি অর্থ তুলে ধরেন।
প্রথমত, ক্রিয়াবাদী মনোবিজ্ঞানকে মানসিক কার্যপ্রণালি (mental operations) সম্পর্কিত বিজ্ঞান বলা যায়। অপর পক্ষে কাঠামোবাদ হলো মানসিক উপাদানের বিজ্ঞান। তিনি বলেন মন কী করে এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে মন কীভাবে (How) কাজ করে এবং কেন (Why) করে এসব প্রশ্ন এসে যায়। সুতরাং ক্রিয়াবাদী মনোবিজ্ঞান মানুষ কী করে, কেন করে এবং কীভাবে করে-এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে চেষ্টা করে।
দ্বিতীয়ত, ক্রিয়াবাদী মনোবিজ্ঞানকে চেতনার মৌলিক উপযোগিতার মনোবিজ্ঞান (Psychology of fundamental utilities of consciousness) বলা যায়। এই ধারণাটি জেমসের ধারণা থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। জেমসের মতে, চেতনার বৈশিষ্ট্যের কথা বলতে গিয়ে জেমস বলেন যে, চেতনা হলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং সদা পরিবর্তনশীল। এটি ব্যক্তির অভিজ্ঞতার প্রতিফলন এবং এটা মনের সকল সাধারণ উপাদানের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। চেতনা বা মানসিক প্রক্রিয়াসমূহ প্রাণী ও পরিবেশের মাঝে যোগসূত্র স্থাপন এবং নতুন অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে সাহায্য করে।
তৃতীয়ত, ক্রিয়াবাদী মনোবিজ্ঞানকে মনোদৈহিক সম্পর্কের মনোবিজ্ঞান (Psychology of psychophysical relations) বলা যায়। দেহ-মনের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয়ও এই বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য। তাই প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে শারীরবৃত্তীয় অভ্যন্তরীণ পরিবেশের সম্পর্ক নির্ণয় করতে গিয়ে অনৈচ্ছিক (অচেতন) ও অভ্যাসগত আচরণকেও ক্রিয়াবাদী মনোবিজ্ঞানের গবেষণার আওতায় আনা হয়।
৩. শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগ স্থাপন:
James R. Angell ২৫ বছর বয়সে অ্যাঞ্জেল শিকাগো (Chicago) বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছিলেন। তার অধীনে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিয়াবাদের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। তিনি ১৯২১ সালে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং ১৯৩৭ সালে অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত এখানেই কর্মরত ছিলেন।
উপসংহার
জন ডিউয়ি এবং জেমস আর এনজেলের প্রচেষ্টায় ক্রিয়াবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং কাঠামোবাদের শক্তিশালী প্রতিযোগী হিসেবে প্রকাশ হয়েছিল। বিবর্তনবাদ-তত্ত্বের সাথে সাদৃশ্য থাকার কারণে, ক্রিয়াবাদ শুধু চেতনার শিক্ষণ নয়, বরং শিশু মনোবিজ্ঞান, অভ্যাসের গঠন এবং স্বতন্ত্র পার্থক্যের শিক্ষণেও উৎসাহ দিয়েছিল। তাছাড়া শক্তিশালী প্রায়োগিক দিক থাকায় এটা মনোবিজ্ঞানকে ব্যবসা এবং ক্লিনিক্যাল মনোবিজ্ঞানে প্রয়োগ করার উৎসাহ দিয়েছিল।