একটি উত্তম প্রতিবেদনের বৈশিষ্ট্যসমূহ
মনোবিজ্ঞানে একজন গবেষককে গবেষণার আনুষঙ্গিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণের পর গবেষণার প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে হয়। দীর্ঘদিন গবেষণার পর প্রতিবেদন লেখা গবেষকের কাছে অবশ্যই একটি আনন্দের বিষয় হবে। প্রতিবেদনের মাধ্যমে গবেষণালব্ধ ফলাফল সকলের অবগতির জন্য উপস্থাপন করা হয়। কোনো বিষয় সম্পর্কে একটি 'ভালো প্রতিবেদন' সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারে।
একটি ভালো প্রতিবেদনের বৈশিষ্ট্যাবলি
গবেষককে একটি প্রতিবেদনের জন্য বিরামহীন সাধনা করতে হয়। প্রতিবেদন যদি সঠিকভাবে প্রস্তুত করতে হয় তাহলে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দিতে হয়। হ্যানস রাজ (1979) একটি ভালো প্রতিবেদনের কয়েকটি মৌলিক ও অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। নিম্নে এগুলো তুলে ধরা হলো-
১. সহজ ও সঠিক ভাষা:
প্রতিবেদনের ভাষা হবে সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল। যে পাঠকের উদ্দেশ্যে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয় সে পাঠকই যদি বুঝতে অক্ষম হয় তাহলে সব প্রচেষ্টাই বিফল হয়ে যায়। প্রতিবেদনে কোনো উদ্ধৃতির ব্যবহার প্রয়োজন হলে সেটা যথার্থভাবে প্রয়োগ করতে হবে। কোনোক্রমে প্রতিবেদনে কথ্য বা আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার না করাই শ্রেয়। কারণ এতে এক অঞ্চলে প্রস্তুত প্রতিবেদন অন্য অঞ্চলের মানুষের কাছে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। প্রতিবেদনের ভাষায় যাতে অতীতকাল এবং তৃতীয় পুরুষ (Third Person) এর ব্যবহার যথাযথ হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। সুন্দর, সাবলীল ভাষা প্রয়োগের জন্য বিখ্যাত সাহিত্যিকের লেখা বা নিয়মিত অভিধান পাঠে ভালো ফল পাওয়া যায়।
২. স্পষ্ট চিন্তা:
একটি ভালো প্রতিবেদন তৈরীতে যে বিষয়ের প্রতি সর্বপ্রথম দৃষ্টি দিতে হয় সেটি হচ্ছে স্পষ্ট চিন্তা। প্রতিবেদনে গবেষকের চিন্তা স্পষ্ট হতে হবে। পাঠককে প্রতিবেদনের বিষয় সহজে বোধগম্য করে গড়ে তোলার জন্য দ্ব্যর্থহীন ও পরিষ্কারভাবে চিন্তাধারার উল্লেখ করতে হবে। গবেষকের চিন্তাধারায় মৌলিকত্ব থাকতে হবে। এতে গবেষণার নতুনত্ব আসে। নতুন তথ্য ও তত্ত্ব সংযোজনের ফলে জ্ঞানভান্ডার হয় সমৃদ্ধশালী।
৩. সুশৃঙ্খল উপস্থাপন:
প্রতিবেদনে প্রয়োজনীয় বিষয়বস্তু শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সুশৃঙ্খল ও পর্যায়ক্রমে বিবৃতি দিতে হবে। সমগ্র প্রতিবেদনকে প্রয়োজন অনুযায়ী অধ্যায় এবং অধ্যায়কে অনুচ্ছেদে বিন্যস্ত করতে হবে। প্রতিটি অধ্যায়ের বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্য একটি শিরোনাম এবং এর বিভিন্ন অংশ বা উপরিভাগের জন্য একাধিক উপশিরোনাম ব্যবহার করতে হবে।
৪. স্বচ্ছ প্রত্যয় ও পদ:
গবেষণায় ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রত্যয় ও পদসমূহের সুস্পষ্ট এবং কার্যকরী সংজ্ঞা প্রদান করতে হবে এবং প্রতিবেদনে প্রদত্ত সংজ্ঞা ব্যবহারের মধ্যে সংগতি রক্ষা করতে হবে। যেসব প্রত্যয় বা পদ সুস্পষ্ট নয় সেগুলোর প্রয়োগিক সংজ্ঞা দিতে হবে। এতে পাঠকের পদটিকে বস্তুনিষ্ঠুভাবে বোধগম্য এবং প্রমাণ সাপেক্ষ করা হয়। কখনো কখনো দেখা যায় কোনো পদ বা ধারণা গবেষণার ক্ষেত্রে যে অর্থে ব্যবহৃত হয় দৈনন্দিন জীবনে সে অর্থে ব্যবহৃত হয় না। এজন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংজ্ঞা দানের প্রয়োজন হয়। আবার একাডেমিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হলেও ভিন্ন অর্থ জ্ঞাপনের কারণে সংজ্ঞা প্রদান করতে হয়।
৫. প্রতিবেদনের আকার:
প্রতিবেদনের আকার বেশি বড় না হওয়াই ভালো। প্রয়োজন অনুযায়ী এবং যতটা সম্ভব খুব বড় বা ছোট আকার প্রদান না করে প্রতিবেদন তৈরী করতে হবে। অবশ্য প্রতিবেদনের আকার বড় হলে বা ছোট হলে যে ক্ষতি হবে তা নয়। একটি প্রতিবেদনের গুণগত মান এর পরিমাণ বা আকারের ওপর নির্ভর করে। তাই এ ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করাই ভালো। প্রয়োজনীয় বিষয়াদি এবং তথ্যাবলির পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও বিবরণ যাতে প্রতিবেদনে স্থান পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রতিবেদনের আকার অযথা বড় করার জন্য অহেতুক তথ্য উপস্থাপন বা একই বিষয়ের পুনরুক্তি না করাই ভালো। A4 সাইজের কাগজে ১০০-৩৫০ পৃষ্ঠার মধ্যে প্রতিবেদনে তৈরী করা হলে মোটামুটি মাঝারি সাইজ হিসেবে বিবেচ্য হবে।
৬. উদ্ধৃতি ও পাদটীকা ব্যবহার:
প্রতিবেদনে উদ্ধৃতি ও পাদটীকা ব্যবহারের দরকার হয়। কোনো স্বীকৃত বিশেষজ্ঞের অভিমত ব্যক্ত করে গবেষক নিজের মতামতকে আরও সমর্থনযোগ্য বলে দাবি করেন। আবার কখনও গবেষক নিজের মতের বিরোধী উদ্ধৃতিও ব্যবহার করেন। বিখ্যাত বিজ্ঞানী কার্ল মার্কস তাঁর গবেষণা প্রতিবেদন তৈরীতে উদ্ধৃতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সতর্কতা অবলম্বন করতেন। সেরা বিশেষজ্ঞ দ্বারা যে মতামতটি সমর্থিত হতো না তিনি সেটা বর্জন করতেন। তিনি কোনো তথ্যের উৎসস্থলে গেলে পর্যবেক্ষণ করতেন। এর ফলাফল দাঁড়ায় এমন যে, গবেষকের পক্ষে যুক্তিতর্কের ব্যাপকতা থেকে এড়ানো যায়। উদ্ধৃতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরোক্ষ পদ্ধতি ব্যবহার করলে বেশি ভালো ফলের আশা করা যায়। তবে কোনো বক্তব্যের ভাষান্তর বা পরিবর্তন করলে যদি ভুল থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় তাহলে প্রত্যক্ষ উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়। দীর্ঘ বা অধিক পরিমাণে উদ্ধৃতি ব্যবহার করে কখনও ভালো প্রতিবেদন তৈরী করা যায় না। মাত্রাতিরিক্ত বা অতি দীর্ঘ উদ্ধৃতি ব্যবহার করলে পাঠকের একদিকে যেমন মনোনিবেশ বিনষ্ট হয়, তেমনি প্রতিবেদনটি মূল বিষয়বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
উদ্ধৃতির উৎস বোঝানোর জন্য পাদটীকা ব্যবহার করা হয়। উদ্ধৃতি ছাড়া প্রতিবেদন রচনার ক্ষেত্রে কোনো লেখক বা গবেষকের কোনো গ্রন্থ বা গবেষণামূলক প্রবন্ধ থেকে কোনো বক্তব্য, যুক্তি, ধারণা বা ফলাফলের সাহায্য নিলেও পাদটীকার ব্যবহার করা হয়। আবার অনেক সময় একই বিষয়ে বিভিন্ন গবেষক তাঁদের নিজস্ব যে মতামত ব্যক্ত করেন সেগুলোও পাঠককে অবগত করানোর জন্য পাদটীকা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। পাদটীকা ব্যবহারের মূল লক্ষ্য হচ্ছে একই বিষয়ে যদি পাঠক আরও জানতে চান তার পথ উন্মোচন করা। এতে পাঠক ও গবেষক উভয়ের তথ্য সংগ্রহ ও পরিচালনায় সুবিধাজনক হয়।
৭. ত্রুটি স্বীকার:
স্বাভাবিক ভুলত্রুটি স্বীকার গবেষকের পক্ষে যেমন বুদ্ধিমত্তার পরিচয় বহন করে, তেমনি প্রতিবেদন তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। গবেষক তাঁর প্রতিবেদনে ভুলত্রুটির বিষয় সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরবেন। এতে যারা উক্ত গবেষণার ফলাফলের ওপর নির্ভর করবেন তারা উপলব্ধি করতে পারবেন যে, গবেষণা প্রতিবেদনের সীমাবদ্ধতা কিরূপ।
উপসংহার:
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্রতিবেদনের মাধ্যমে কোনো বিষয়ে নতুন তথ্য জানা যায় এবং প্রচলিত ধারণার সংস্কার করা যায়। আবার গবেষককে পাঠকের চাহিদা মোতাবেক প্রতিবেদন তৈরীর প্রতি গুরুত্ব দিতে হয়। পাঠকের ধরনের ওপর প্রতিবেদনের ধরন নির্ভর করে। তাই বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি রেখে প্রতিবেদন তৈরী করতে হয়।