বৈজ্ঞানিক গবেষণার ধাপসমূহ
গবেষণা হলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সত্য উদঘাটনের একটি কৌশল: কোন নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সুসংবদ্ধ অনুসন্ধানকে গবেষণা বলা যায়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে একজন গবেষককে সুনির্দিষ্ট কতকগুলো ধাপ অনুসরণ করতে হয়। সেগুলো হলোঃ-
- বিস্তারিত গবেষণা সাহিত্য পর্যালোচনা (Extensive Review of literature)
- গবেষণার সমস্যা সংজ্ঞায়ন (Defining the research problem)
- প্রকল্প গঠন (Forming Hypothesis)
- গবেষণা নকশা প্রণয়ন (Determining Research Design)
- নমুনায়ন ও নমুনা আকার (Sampling and Sample size)
- পরিমাপন ও স্কেল (Measurement and Scale)
- উপাত্ত সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ (Collection and analysis of data)
- সাধারণীকরণ (Generalization)
- প্রতিবেদন লিখন এবং উপস্থাপন (Research Report Writing and Presentation)
বৈজ্ঞানিক গবেষণার ধাপসমূহ
বৈজ্ঞানিক গবেষণার ধাপসমূহ নিম্নরূপ:
১) বিস্তারিত গবেষণা সাহিত্য পর্যালোচনা:
কোন গবেষণার শুরুতেই সংশ্লিষ্ট কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম কাজ হলো গবেষণার জন্য একটি উপযুক্ত সমস্যা নির্বাচন করা। এই সমস্যা নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে গবেষকের বিস্তারিত জ্ঞান এবং বুৎপত্তি। তাই প্রাসঙ্গিক বই, জার্নাল, পত্র-পত্রিকা, পাঠ এবং পর্যালোচনা ইত্যাদির মাধ্যমে নির্দিষ্ট বিষয়ে গবেষকের পক্ষে জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব। গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট সাহিত্য পর্যালোচনার মূলে কয়েকটি উদ্দেশ্য কাজ করে। যেমনঃ
- প্রাসঙ্গিক বই প্রবন্ধ বা গবেষণা প্রতিবেদন পাঠের মাধ্যমে গবেষণার সমস্যা সম্বন্ধে গবেষকের অস্পষ্টতা দূর হয় এবং সমস্যা সম্বন্ধে গবেষক সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারেন।
- সংশ্লিষ্ট গবেষণার সাহিত্য পর্যালোচনা করে গবেষক জানতে পারেন এই বিষয়ে পূর্বে গবেষণা করেছে কিনা এবং নির্দিষ্ট গবেষণাটির পরিচালনা আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কিনা।
- গবেষণা সাহিত্য পর্যালোচনা গবেষককে গবেষণার কাজের ক্ষেত্রে ভুল ভ্রান্তি পরিহারে সহায়তা করে।
- গবেষণা সাহিত্য পর্যালোচনা সম্পূর্ণ গবেষণার একটি প্রাথমিক খসড়া তৈরিতে সাহায্য করে।
২) গবেষণার সমস্যা সংজ্ঞায়ন:
যে কোন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান শুরু হয় একটি সমস্যাকে কেন্দ্র করে। তবে সমস্যার একটি বিশেষ শর্ত হচ্ছে এটিকে সমাধানযোগ্য হতে হবে। সমাধানযোগ্য কথাটির দুটো দিক আছে। যেমন-
- বর্তমান সমাধানযোগ্য
- ভবিষ্যতে সমাধানযোগ্য
যে কোন গবেষকই সমাধানযোগ্য সমস্যা ভবিষ্যতের জন্য রেখে দিয়ে বর্তমানে সমাধানযোগ্য সমস্যা নিয়ে কাজ করতে অধিক আগ্রহী। কয়েকটি সুনির্দিষ্ট কারণে গবেষণার সমস্যার উদ্ভব হয়। কোন বিষয়ে কিছু পরিমাণে জ্ঞান লাভের পর যখন উপলব্ধি হয়।
যে এ বিষয়ে অনেক কিছু এখনও অজানা রয়েছে। তখনই উহা একটি সমস্যা আকারে চিহ্নিত হতে পারে। গবেষণার সমস্যার মূলকথা হল কোন বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব। এই জ্ঞানের অভাব ৩ ভাবে অভিব্যক্ত হতে পারে। যেমনঃ
ক) জ্ঞানের ঘাটতি: সমস্যা সম্পর্কে আমরা তখনই সচেতন হই যখন আমরা বুঝতে পারি যে, কোন বিষয় বা ঘটনা সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান সম্পূর্ণ নয়।
খ) পরস্পর বিরোধী ফলাফল: কোন সমস্যার সমাধানে যদি পরস্পর বিরোধী ফলাফল পাওয়া যায় তাহলে কোন একটি ফলাফলের উপরই আমরা আস্থাশীল হতে পারি না। ফলে সেটা একটা সমস্যা বলে বিবেচিত হয়।
গ) কোন ঘটনার ব্যাখ্যা: আমরা যখন নতুন কোন ঘটনা বা বিষয়ের সম্মুখীন হই এবং আামাদের ইতোপূর্বে অর্জিত জ্ঞান দ্বারা ঐ ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে চাই তখন সেটি একটি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়। গবেষণার জন্য সমস্যা নির্বাচনের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় আনতে হয়। যেমনঃ-
- গবেষণাটি কোন তাত্ত্বিক বা ব্যবহারিক সমস্যা সমাধানে সহায়ক হবে কি না। তাত্ত্বিক বা ব্যবহারিক সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হলে ঐ ধরণের সমস্যা নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করা নিতান্তই অর্থহীন।
- সমস্যাটি সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহে যাবতীয় উপকরণাদি বর্তমান আছে কিনা। সমস্যা সমাধানে আনুসাঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া সহজ সাধ্য না হলে বিকল্প সমস্যার কথা বিবেচনা করতে হয়।
- যে সমস্যা নিয়ে গবেষণা করা হবে তা কতটা সময় ও অর্থ সাশ্রয়ী হবে তা বিবেচনায় আনতে হয়।
- গবেষকের নিজস্ব যোগ্যতা ও দক্ষতার বিষয়টি বিবেচনা করে গবেষণার জন্য সমস্যা নির্বাচন করতে হয়।
৩) প্রকল্প গঠন:
গবেষণার জন্য একটি উপযুক্ত সমস্যা নির্বাচনের পর গবেষকের কাজ হলো সমস্যার বিশেষ দিক বা দিকসমূহ চিহ্নিত করা এবং সমস্যার এক বা একাধিক আপাততঃ সমাধা প্রস্তাব করা। এই আপাত সমাধানযোগ্য প্রস্তাবই হলো প্রকল্প (Hypothesis)। গবেষকের অতীত অভিজ্ঞতা এবং সমস্যা সমাধানের কৌশল সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় জ্ঞান প্রকল্প গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। গবেষণার যে সমস্যাটি নির্বাচন করা হয় উহার মধ্যে দুই বা ততোধিক ঘটনা বা চলের পারস্পরিক সম্পর্ক যাচাইয়ের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকে। একটা ঘটনা বা চলের সাথে অন্য একটি ঘটনা চলের সম্ভাব্য সম্পর্ক ব্যক্তিগত করার ক্ষেত্রে প্রকল্পকে ব্যবহার করা হয়।
৪) গবেষণা নকশা প্রণয়ন:
গবেষণার সমস্যা নির্বাচনের পর ঐ সমস্যাটির সাথে যে সকল চল অর্থাৎ বিশেষ অর্থবোধক পদ বা শব্দ ব্যবহৃত হয় সেগুলোর কার্যকর সংজ্ঞা স্থির করা অপরিহার্য। এরপর গবেষণা প্রকল্পের যথার্থতা প্রতিপ্রাদনের জন্য কোন ধরনের গবেষণা নকশা ব্যবহার করা হবে তা নির্দিষ্ট করতে হয়। মনোবিজ্ঞানে ব্যবহৃত পরীক্ষণ নকশাসমূহকে ব্যাপক অর্থে তিনভাগে ভাগ করা হয়। যথা-
- পরীক্ষণমূলক নকশা
- আপাত-পরীক্ষণমূলক নকশা
- অপরীক্ষণমূলক নকশা
৫) নমুনায়ন ও নমুনা আকার:
মানব বিজ্ঞানের যে কোন গবেষণাই মানব আচরণ সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। এই উদ্দেশ্যে সাধনের জন্য সমগ্রক হতে কিছু সংখ্যক নমুনা বাছাই করে তাদের ওপর গবেষণা পরিচালনা করতে হয়। এক্ষেত্রে গবেষককে আগে থেকে ঠিক করে নিতে হয় কি ধরনের Sample নির্বাচন করা হবে। তাদেরকে কিভাবে বাছাই করা হবে। একাধিক দল নির্বাচন করতে হলে কি কি বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে দল গঠন করা হবে, প্রতিটি দলে কতটি নমুনা অন্তর্ভুক্ত হবে এবং নমুনা যাতে সমগ্রকের যথার্থ প্রতিনিধিত্বমূলক হয় সেদিকে গবেষককে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হয়। গবেষণার নমুনা নির্বাচনের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ স্বল্প সংখ্যক নমুনার ফলাফরের উপর ভিত্তি করে সমগ্রক সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বানী করা হয়। সেজন্য যথাযথ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে গবেষণার জন্য নমুনায়ন করতে হবে।
৬) পরিমাপন ও স্কেল:
পরিমাপন মনোবিজ্ঞান গবেষণার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। গবেষণার সমস্যা সংজ্ঞায়ন, প্রকল্প নির্ধারণ ও নকশায়ন সম্পন্ন হলে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো স্কেল গঠন। মনোবৈজ্ঞানিক গবেষক বিভিন্ন সামাজিক আচার ও অবস্থা বিশ্লেষণে প্রয়াসী হয়। কিন্তু এই আচরণ ও অবস্থা পরিমাপের হাতিয়ার হলো বিভিন্ন প্রকার স্কেল। মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীদের ক্রমাগত প্রচেষ্টায় এই স্কেলের আবিষ্কার ও সংশোধন মনোবজ্ঞানের গবেষণার ভিত্তিকে শক্তিশালী করেছে। আচরণ গবেষণায় বহুল ব্যবহৃত কয়েকটি স্কেল হলো- লিকার্ট স্কেল, থার্সটোন স্কেল ও বোগারডাস স্কেল প্রভৃতি। উপাত্ত সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন স্কেল প্রয়োজন। এই তথ্যসমূহ যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করার জন্য উত্তম স্কেল প্রয়োজন। এইসব স্কেল নির্ভরযোগ্য, যথার্থ এবং সঠিক হতে হবে।
কোন স্কেলের নির্ভরযোগ্যতা বলতে বুঝায় ঐ যন্ত্র বা প্রশ্নমালার সাহায্যে স্বাধীন ও পুণ: পুণ: পরিমাপে একই ফলাফল পাওয়া যায়। স্কেলের যথার্থতা বলতে বুঝায় যে আচরণ বা বৈশিষ্ট্য পরিমাপের জন্য প্রশ্নমালা তৈরি হয়েছে সেটা শুধু উহাই পরিমাপ করে। তথ্য যন্ত্রপাতি বা প্রশ্নমালার সঠিকতা বলতে বুঝায় পরিমাপকৃত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে মানুষের সূক্ষ্ণতম পার্থক্য নির্ণয়ে সেটি সক্ষম।
৭) উপাত্ত সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ:
গবেষণার ক্ষেত্রে Sample থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। যন্ত্রপাতি বা প্রশ্নমালার সাহায্যে মানুষের আচরণের যে তথ্য সংগ্রহ করা হয় অর্থাৎ Sample থেকে Response পাওয়া যায় সেগুলো হল তথ্য বা উপাত্ত। এই তথ্য বা উপাত্তের প্রধান দুটো উৎস হলোঃ-
- প্রাথমিক উপাত্ত: পরীক্ষণ, পর্যবেক্ষণ, সাক্ষাৎকার ও জরিপ থেকে সরাসরি প্রাপ্ত উপাত্তই হলো প্রাথমিক উপাত্ত।
- মাধ্যমিক উপাত্ত: বই-পত্র, সাময়িকী বা জার্নাল, পত্র-পত্রিকা, গবেষণা প্রতিবেদন ইত্যাদি থেকে প্রাপ্ত উপাত্তই হলো মাধ্যমিক উপাত্ত।
তথ্য বা উপাত্ত সংগ্রহের পর সেগুলো বিশ্লেষণের জন্য যথোপযুক্ত পরিসংখ্যান পদ্ধতির ব্যবহার করা হয়। কোন ধরণের পরিসংখ্যান পদ্ধতি ব্যবহৃত হবে তা নির্ভর করে উপাত্ত সংগ্রহের ধরণের উপর। এ জন্য গবেষণার শুরুতেই সংগৃহীত উপাত্ত বিশ্লেষণে কোন পরিসংখ্যান পদ্ধতি ব্যবহৃত হবে তা ঠিক করে নেয়া হয়।
৮) সাধারণীকরণ:
গবেষণায় নির্বাচিত নমুনা থেকে প্রাপ্ত উপাত্ত বিশ্লেষণ করে প্রকল্পের সাথে উহার সম্পর্ক যাচাই করা হয়। অতঃপর গবেষক একটি সাধারণ সূত্রে উপনীত হতে পারে। গবেষক সাধারণত যে সমগ্রক থেকে নমুনা নির্বাচন করে থাকেন সেই নমুনার সাপেক্ষে ঐ সমগ্রকের উপর গবেষণার ফলাফল সাধারণীকরণ করে থাকেন।
১) প্রতিবেদন লিখন এবং উপস্থাপন:
যে কোন গবেষণার প্রতিবেদন লেখার প্রধান উদ্দেশ্য হল গবেষণার ফলাফল সকলের সামনে উপস্থাপন করা। গবেষক কোন একটি গবেষণা পরিচালনা করার পর যদি তা প্রকাশ না করেন তবে সম্পূর্ণ রূপে ব্যর্থতা নির্দেশ করে। তাই একজন গবেষককে অবশ্যই সুসামঞ্জস্যভাবে এবং ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন লিখার কৌশল অর্জন করতে হবে। যাতে করে পাঠকের কাছে গবেষণা কার্যক্রম সহজে ও পরিষ্কারভাবে বোধগম্য হয়। এর জন্য অবশ্যই একজন গবেষককে প্রচুর অনুশীলন করতে হবে।
উপসংহার:
পরিশেষে বলা যায় যে, মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ধাপসমূহ যথাযথভাবে ব্যবহৃত হয়। এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ধাপসমূহ অনুসরণ করার ফলেই মনোবিজ্ঞানের গবেষণা নির্ভুল ও সঠিক হয়ে উঠেছে।