গবেষণা কী? গবেষণার বৈশিষ্ট্য বর্ণনা

যে কোন বিষয় সম্বন্ধে যথাযথ ও সুসংবদ্ধ জ্ঞানকে বলা হয় বিজ্ঞান। অজানাকে জানার ইচ্ছা মানুষের জন্মগত। সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই মানুষ অজানাকে জানার বা অচেনাকে চেনার কৌতূহল মানবমনের এক চিরন্তন প্রবৃত্তি। সে কারণেই মানুষ তার পারিপার্শ্বিক জীবন-জগৎ সম্পর্কে অনুসন্ধান চালাতে এত আগ্রহী। আর পদ্ধতিগত অনুসন্ধানই গবেষণা।

গবেষণা পদ্ধতি: 

আজকের একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা প্রত্যক্ষ করছি একটি বিরাট জ্ঞান ভান্ডার। যা সারা পৃথিবীর মানুষকে দিনে দিনে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যাচ্ছে। জ্ঞান বিজ্ঞানের এই যে বিশাল বিকাশ তা সম্ভব হয়েছে কেবলমাত্র বহু মানুষের সৃজনশীল আবিষ্কার ও গবেষণার দ্বারা। এসব গবেষণা পরিচালিত হয় কতকগুলো নিয়মের মাধ্যমে। এই নিয়মগুলো বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। এসব নিয়মগুলোকে বলে গবেষণা পদ্ধতি।

গবেষণা পদ্ধতি হচ্ছে এমন কতকগুলো কৌশলগত ব্যবস্থা যা উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবহার করে নির্দিষ্ট সমস্যা সমাধান বা কোন কার্যের কারণ উদ্ভাবন করা হয়। মানব মনে যেসব বহুমুখী প্রশ্নের উদ্রেক ঘটে তার যথাযথ উত্তর লাভের আকাঙ্ক্ষায় গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি অবলম্বনে ধারাবাহিকভাবে অনুসন্ধানের মাধ্যমে লব্ধ তথ্যসমূহকে যাচাই বাছাই করে নতুন জ্ঞান আহরণ করা ও প্রচলিত জ্ঞানের উন্নতি সাধনই গবেষণার কাজ।

গবেষণা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যসমূহ

গবেষণা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ:

১. বিজ্ঞানভিত্তিক: 

সামাজিক গবেষণা বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি হিসেবে পরীক্ষণ ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের কলাকৌশল প্রয়োগ করা হয়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা বা অনুকল্প (Hypothesis) গঠন ও সে প্রেক্ষিতে অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সামাজিক গবেষণা পরিচালিত হয়ে থাকে।

২. তথ্যভিত্তিক ও বাস্তবভিত্তিক: 

সামাজিক গবেষণা বাস্তবভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ বা পর্যবেক্ষণ (Observation)-এর মাধ্যমে সামাজিক গবেষণা পরিচালিত হয়ে থাকে। বাস্তবতার সাথে সংগতিহীন কোন বিষয়ে সাধারণত সামাজিক গবেষণা পরিচালিত হয় না।

৩. তত্ত্বনির্ভর: 

সামাজিক গবেষণা তত্ত্বের ভিত্তিতে (Theory-based) পরিচালিত হয়ে থাকে। কেননা তত্ত্বের মাধ্যমে গবেষণার বিষয়বস্তুর সঠিক ও যথা ব্যাখ্যা প্রদান করা যায়। এজন্য সামাজিক গবেষণায় কোনো প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বকে গ্রহণ করা হয় কিংবা গবেষণার প্রয়োজনে কার্যকর নতুন তত্ত্ব গঠন করা হয় ।

৪. লক্ষ্যকেন্দ্রিক: 

সাধারণত লক্ষ্য-কেন্দ্রিক (goal-oriented) সামাজিক কোন বিষয়ের জিজ্ঞাসা থেকে সামাজিক গবেষণা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ এবং এ সব তথ্যের বিশ্লেষণ করা হয়। গবেষণায় নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করা বা জিজ্ঞাসার উত্তর পাওয়ার জন্য বা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সামাজিক কল্যাণসাধনের গবেষণা পরিচালিত হয়ে থাকে।

৫. পর্যায়ক্রমিক (Systematic): 

সামাজিক গবেষণার সকল কার্যকে পর্যায়ক্রমিকভাবে (Systematically) গবেষণার বিষয়বস্তুর সাধারণ বর্ণনা থেকে শুরু করে অনুমান গঠন পদ্ধতি নির্ধারণ, তথ্য সংগ্রহ, তথ্য বিন্যস্তকরণ ও তথ্য বিশ্লেষণ এবং রিপোর্ট প্রণয়ন প্রভৃতি কার্যাদি পর্যায়ক্রমিকভাবে সম্পাদিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ সামাজিক গবেষণায় সুশৃঙ্খল নিয়ম-নীতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে।

৬. সাধারণীকরণ: 

সামাজিক গবেষণায় বিভিন্ন চলকের (variable) মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা হয় এবং ঘটনার সাধারণীকরণ (generalization) করা হয়। পরবর্তীতে সাধারণীকৃত বিষয়গুলোকে (statement) নিয়ম-নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিয়ম-নীতিকরণ সামাজিক গবেষণার অন্যতম একটি লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।

৭. ভবিষ্যদ্বাণীকরণ: 

সামাজিক গবেষণায় সমস্যা সমাধানে সুপারিশমালা প্রণয়নও ভবিষ্যদ্বাণী (prediction) করার চেষ্টা করা হয়। এরূপ গবেষণায় বাস্তবতাকে শুধু তুলে ধরা হয় না বরং প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে সতর্ক করে থাকে। তবে সামাজিক বিজ্ঞানের ভবিষ্যদ্বাণী প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ভবিষ্যদ্বাণীর ন্যায় ততটা বাস্তবসম্মত হয় না। 

৮. নতুন জ্ঞনের সন্ধান ও সমস্যা সমাধান: 

নতুন জ্ঞানের অন্বেষণ করাই গবেষণার প্রথম কাজ। গবেষকগণ পুরাতন সত্য ও সূত্রের স্থলে নতুন জ্ঞান ও সূত্র সন্ধান করে থাকে। এতে প্রাথমিক উৎস হতে তথ্য সংগ্রহ করে জ্ঞান লাভ করা যায়। গবেষক সর্বদা কোন না কোন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে। গবেষণার বিষয়কে সমস্যা আকারে বিবেচনা করা হয়। উক্ত সমস্যা সমাধানের জন্যই গবেষণা করা হয়।

৯. চলকগুলোর মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয়: 

গবেষণা দুই বা ততোধিক চলকের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করে কোন সমস্যার সমাধান করে থাকে। এই চলকগুলোর মধ্যে ধনাত্মক বা ঋণাত্মক সম্পর্ক নির্ণয় করাই গবেষণার একটি অন্যতম প্রধান কাজ। 

১০. প্রচলিত সমস্যাদির বিশ্লেষণ ও প্রচলিত তত্ত্বের প্রসার: 

গবেষণায় কঠোর যুক্তি প্রয়োগ করে সমস্যাদির ব্যাখ্যা করা হয়। যুক্তিনির্ভর উপায়েই সমস্যার বিশ্লেষণ করা উচিত। গবেষণা তত্ত্বের প্রসার ঘটায়। গবেষণার ফলাফলের সার্বিকীকরণের মাধ্যমে তত্ত্বকে প্রসারিত করা যেতে পারে। ক্ষুদ্র গবেষণা থেকে বৃহৎ তত্ত্ব এভাবে বেরিয়ে আসতে পারে।

১১. নিরপেক্ষতা, যথার্থতা ও নৈর্ব্যক্তিকতা: 

গবেষককে নিরপেক্ষ ব্যক্তি হতে হবে। কঠোর পদ্ধতি অনুসরণ করে গবেষণার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন হয়ে গবেষক গবেষণার তথ্যাদি সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও ফলাফল তৈরি করবেন। এক্ষেত্রে অনুমিত সিদ্ধান্তকে শুধুমাত্র প্রমাণ করার দিকে অবিচল না থেকে যুক্তি, তথ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের উপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। গবেষণা হবে যথার্থ ও নৈব্যক্তিক। সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে গবেষণা করা হয় বলে এতে প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষতা থাকে এবং গবেষণাটি যথার্থ ও নৈর্ব্যক্তিক হয়।

১২. সাধারণ সূত্র আবিষ্কার ও ভবিষ্যৎবাণী: 

গবেষণার মাধ্যমে যুক্তিসম্মত তত্ত্ব বা সাধারণ সূত্র আবিস্কার করা হয়। প্রতিটি গবেষণার প্রাপ্ত সিদ্ধান্তসমূহ বা ফলাফল তার সাধারণ সূত্র প্রদান করে থাকে। সঠিক গবেষণার মাধ্যমে ভবিষ্যতের ঘটনাপুঞ্জ সম্পর্কে ভবিষ্যৎ বাণী করা সম্ভব। ভবিষ্যতে কি ঘটতে পারে বা পরিস্থিতির কিরূপ পরিবর্তন হতে পারে তা বর্তমানে গবেষণা করে অনেকটাই নির্ণয় করা সম্ভব।

১৩. সুনিপুণ, ধারবাহিক ও সঠিক অনুসন্ধান সংখ্যায় প্রকাশ: 

অতি সতর্কতার সাথে গবেষণা পরিকল্পনার পর গবেষণা করা হয়ে থাকে। এতে সঠিকভাবে তথ্য সংগ্রহ, লিপিবদ্ধ ও বিশ্লেষণ করা হয়। ভুলত্রুটি এড়িয়ে সুনিপুণ, ধারবাহিক ও সঠিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে গবেষণা কর্মটি করা হয়। গবেষণার প্রাপ্ত পরিমানগত ও গুণগত তথ্যাদি যতদূর সম্ভব সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়। সংখ্যায় প্রকাশিত তথ্যাদি অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য, গ্রহণযোগ্য, নির্ভরযোগ্য ও সহজে বোধগম্য হয়।

১৪. সময়সাপেক্ষ, শ্রমসাপেক্ষ, ব্যয় বহুল ও কষ্টকর কাজ: 

গবেষণা অধিক সময় ও পরিশ্রমের কাজ। অক্লান্ত পরিশ্রম করে সত্যের অনুসন্ধান গবেষণার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। গবেষণা করতে অর্থের প্রয়োজন হয়। অভিজ্ঞ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, সুদক্ষ গবেষক দ্বারা গবেষণাকর্ম করলে কাংঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যায়, কিন্তু এতে ব্যয় হয় প্রচুর।

১৫. ধৈর্য্যশীল, ধীরস্থির ও সাহসিকতাপূর্ণ কার্যক্রম: 

গবেষণার জন্য প্রচুর সময়, শ্রম ও কষ্ট করতে হয়। তাই গবেষককে ধৈর্য্যশীল ও ধীরস্থির থাকতে হবে। গবেষককে হতে হবে খুবই সাহসী। কোন কোন গবেষণা করতে ও ফলাফল প্রকাশ করতে গবেষককে অপ্রিয় পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। সাহসিকতার সাথে এসব-মোকাবেলা করে সত্যের অনুসন্ধান ও প্রকাশ করা গবেষকের উচিত।

১৬. তথ্য রেকর্ড ও রিপোর্ট প্রকাশ: 

গবেষককে একজন জ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞ হতে হয়। যে বিষয়ে তিনি গবেষণা করতে ইচ্ছুক ঐ বিষয়ে তার প্রচুর জ্ঞান, দক্ষতা থাকা উচিত। গবেষণার তথ্যাদি অতি সতর্কতার সাথে রেকর্ড করতে হয়। এসব তথ্যাদির ভিত্তিতে প্রাপ্ত ফলাফল রিপোর্ট করার জন্য আরো বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।

উপসংহার: 

পরিশেষে বলা যায় যে, নতুন জ্ঞান আহরণের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণা চালান হয়। যে কলাকৌশল ব্যবহার করে গবেষণা পরিচালনা করা হচ্ছে তা হলো গবেষণা পদ্ধতি।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url