দৈবচয়িত দুই দলীয় নকশার ব্যাখ্যা এবং সুবিধা ও অসুবিধাসহ
গবেষণা নকশা হলো এক ধরনের পরিকল্পনা, যাতে গবেষণা প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার লক্ষ্যে পর্যবেক্ষণের শর্তাবলি, উপাত্ত সংগ্রহ ও তথ্য সংগ্রহের যন্ত্রপাতি প্রভৃতি চিহ্নিত করা হয়। নকশা হলো পরীক্ষণের অপরিহার্য ও প্রধান শর্ত। নকশা ছাড়া পরীক্ষণের কথা চিন্তাই করা যায় না। পরীক্ষণের জন্য মনোবিজ্ঞানিগণ বিভিন্ন নকশা ব্যবহার করেন। তারা প্রকৃত গবেষণা পরিচালনার পূর্বেই তার সমস্যার সঠিক জবাব পাওয়ার জন্য উপযুক্ত নকশা নির্বাচন করেন। গবেষণায় যেসব নকশা ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো সরল-দৈবচয়িত/দৈব নমুনাভিত্তিক নকশা।
সরল দৈবচয়িত / দৈব নমুনাভিত্তিক নকশা
যে নকশায় পরীক্ষক কোনো আচরণের উপর কোনো উদ্দীপকের অনির্ভরশীল চলের দুটি মাত্রা প্রয়োগ করতে চান এবং অনির্ভরশীল চলের মাত্রার পার্থক্যের জন্য আচরণের কোনো পার্থক্য ঘটে কি-না তা নির্ণয় করতে চান তাকে সরল দৈবচয়িত/দৈব নমুনাভিত্তিক নকশা বলে। অন্যভাবে বলা যায়, যে নকশায় পারীক্ষদের উপর অনির্ভরশীল চলের পৃথক দুটি মাত্রা প্রয়োগ করে আচরণের পার্থক্য পরিমাপ করেন তখন তাকে সরল দৈব নমুনাভিত্তিক নকশা বলে। এ ধরনের নকশাকে দৈব নমুনাভিত্তিক দ্বি/দুই দলীয় বা দুই দলীয় দৈব নমুনাভিত্তিক নকশাও বলা হয়ে থাকে। এ নকশায় অনির্ভরশীল চলের দুটি মাত্রাকে অনেক সময় দুটি অবস্থা বা দুটি পদ্ধতির প্রয়োগে বা শুধু দুটি উদ্দীপক বলা যায়। এ নকশার প্রধান শর্ত হলো, পরীক্ষণ শুরু করার পূর্বে দুটি দল অন্যান্য। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে সর্বতোভাবে সমান হতে হয়। আর পারীক্ষদের দুটি দলে বিভক্ত করার সময় দৈব নমুনার সাহায্য নিতে হয়।
উদাহরণ: সরল দৈবচয়িত/দৈব নমুনাভিত্তিক নকশার উদাহরণ হিসেবে শিক্ষণের উপর গণ্ডগোলের প্রভাব দেখা প্রয়োজন। অর্থাৎ গবেষকগণ দেখতে চান যে, শিক্ষণের উপর গণ্ডগোল কতটুকু প্রভাব ফেলে। এক্ষেত্রে গবেষক বেশ কিছু পারীক্ষ নেন এবং পারীক্ষদের দৈব নমুনার ভিত্তিতে দুটি দলে বিভক্ত করেন। এরপর গণ্ডগোলে দুটি মাত্রা, যেমন- গণ্ডগোলপূর্ণ পরিবেশ এবং গণ্ডগোলবিহীন পরিবেশ ব্যবহার করেন। অর্থাৎ দুটি দলের একটিকে গণ্ডগোলপূর্ণ পরিবেশে এবং অন্যটিকে গণ্ডগোলবিহীন পরিবেশে শিক্ষণ করতে দেন। এরপর তিনি উভয় দলের শিক্ষণের হার পরিমাপ করেন। এধরনের শিক্ষণের পরিমাপ থেকে তিনি গণ্ডগোল শিক্ষণকে প্রভাবিত করে কি-না তা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারেন। সরল দৈবচয়িত নকশায় ফলাফল বিশ্লেষণের জন্য গাণিতিক প্রক্রিয়ার সাহায্য নেওয়া হয়। আর তথ্যের এরূপ গাণিতিক বিশ্লেষণের জন্য অভীক্ষা ব্যবহার করা হয়।
সরল দৈবচয়িত/দৈব নমুনাভিত্তিক নকশার বৈশিষ্ট্যসমূহ
সরল দৈবচয়িত/দৈব নমুনাভিত্তিক নকশার কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নিম্নে এ নকশার বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ করা হলো:
১. দৈবচয়নের মাধ্যমে দল নির্বাচন: সরল দৈবচয়িত নকশায় দুটি দল সম্পূর্ণ দৈবচয়নের মাধ্যমে নির্বাচন করা হয়। এখানে কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই করার অবকাশ থাকে না।
২. সমানভাবে চলের প্রয়োগ: সরল দৈবচয়িত নকশায় দুটি দলের অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে পার্থক্য বিচার না করে চলের প্রয়োগ করা হয়। যেহেতু দল দুটি দৈবচয়নের মাধ্যমে নির্বাচন করা হয় তাই এ দুটি দলের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য কল্পনা না করে উভয় দলের উপর সমান বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন চলের প্রয়োগ করা হয়।
৩. অনির্ভরশীল চলের দুটি মাত্রা প্রয়োগ: সরল দৈবচয়িত নকশায় অনির্ভরশীল চলের দুটি মাত্রা প্রয়োগ করা হয়। এর ফলে দেখা হয় চল প্রয়োগে দলের মধ্যে কি ধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
৪. ব্যক্তিগত পার্থক্যজনিত ভ্রান্তি: সরল দৈবচয়িত নকশায় পারীক্ষদের ব্যক্তিগত পার্থক্যজনিত ভ্রান্তি পরিমাপ করা হয়।
৫. দুই দলীয় দৈব নমুনাভিত্তিক নকশা: সরল দৈবচয়িত নকশাকে দ্বি/দুই দলীয় দৈব নমুনাভিত্তিক নকশা বা দৈব নমুনাভিত্তিক দ্বি/দুই দলীয় নকশা বলা হয়।
৬. মৌলিক পদ্ধতি ব্যবহার: এ ধরনের নকশায় মূলত দুটি মৌলিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যথা: লটারী পদ্ধতি, দৈবচয়িত সারণী পদ্ধতি।
৭. পরিসংখ্যানিকভাবে এটিমুক্ত: এই নকশাটি পরিসংখ্যানিকভাবে ত্রুটিমুক্ত একটি মৌলিক নকশা।
৮. স্বাধীনতার মাত্রা বেশি: এই নকশায় স্বাধীনতার মাত্রা বেশি থাকায় এটি যথার্থতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে অধিক উপযাগৌ।
সরল দৈবচয়িত/দৈব নমুনাভিত্তিক নকশার সুবিধাসমূহ
সরল দৈব নমুনাভিত্তিক নকশার বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। এগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
১. দৈবচয়িতভাবে নমুনা বণ্টন: সরল দৈবচয়িত নকশার একটি অন্যতম সুবিধা হলো দৈবচয়িতভাবে নমুনা বণ্টন। দৈবচয়িতভাবে নমুনা বণ্টন করার মাধ্যমে নকশার গবেষণামূলক উদ্দেশ্য অর্জন করা যায়। কারণ এ পদ্ধতিতে বহুসংখ্যক সংখ্যা সুন্দরভাবে কলাম ও সারিতে সাজানো থাকে।
২. পারীক্ষকদের পার্থক্য সমানভাবে বণ্টন: সরল দৈবচয়িত নকশার আরেকটি সুবিধা হলো এ নকশায় দৈবচয়িতভাবে নমুনা করা হয় বলে পারীক্ষদের মধ্যে পার্থক্য সমানভাবে বণ্টন করা যায়।
৩. নমুনায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা: সরল দৈবচয়িত নকশায় সমগ্রকের প্রতিটি একক নমুনায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ এ ধরনের নকশা সম্পূর্ণভাবে দৈবচয়িত নকশার উপর নির্ভরশীল।
৪. ব্যক্তিগত পার্থক্য পরিমাপ: সরল দৈবচয়িত নকশার আরেকটি সুবিধা হলো এ নকশার সাহায্যে পারীক্ষদের ব্যক্তিগত পার্থক্য পরিমাপ করা যায়।
৫. জুটিমুক্ত নকশা: সরল দৈবচয়িত নকশার অন্যতম একটি সুবিধা হলো পরিসংখ্যানিকভাবে ত্রুটিমুক্তি থাকা। তাই বলা যায় যে, পরিসংখ্যানিকভাবে এই নকশাটি অপেক্ষাকৃত ত্রুটিমুক্ত একটি মৌলিক নকশা।
৬. যথার্থতা যাচাই: সরল দৈবচয়িত নকশার আরেকটি সুবিধা হলো এই নকশায় স্বাধীনতার মাত্রা বেশি থাকে। আর এই নকশায় স্বাধীনতার মাত্রা বেশি থাকায় এটি যথার্থতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে অধিক উপযাগেী।
সরল দৈবচয়িত/দৈব নমুনাভিত্তিক নকশার অসুবিধাসমূহ
সরল দৈব নমুনাভিত্তিক নকশার সুবিধার পাশাপাশি বেশ কিছু অসুবিধাও রয়েছে। নিম্নে এ নকশার অসুবিধাগুলো উল্লেখ করা হলো:
১. পরীক্ষকদের মধ্যকার পার্থক্য: সরল দৈবচয়িত নকশার অন্যতম একটি অসুবিধা হলো এই নকশার সাহায্যে দুটি দলের পারীক্ষদের মধ্যকার পার্থক্য দূর করা যায় না।
২. ভ্রান্তি পরিমাপ: সরল দৈবচয়িত নকশার আরেকটি অসুবিধা হলো এই নকশার দ্বারা বিভিন্ন ধরনের ভ্রান্তির পরিমাপ করা যায় না। যেমন- নমুনাগত ভ্রান্তি, আদর্শ ভ্রান্তি ইত্যাদি পরিমাপ করা যায় না।
৩. গাণিতিক বিশ্লেষণে সমস্যা: সরল দৈবচয়িত নকশার আরেকটি অসুবিধা হলো এ নকশাটি পরিচালনার জন্য গাণিতিক বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয়। আর গাণিতিক বিশ্লেষণ করা অনেক কঠিন কাজ। তাই সরল দৈব নমুনাভিত্তিক নকশার ফলাফল গাণিতিকভাবে বিশ্লেষণ করতে সমস্যা হয়।
৪. শর্ত প্রয়োগ: সরল দৈবচয়িত নকশাটির সাহায্যে অনির্ভরশীল চলের দুয়ের অধিক শর্ত প্রয়োগ করা যায় না। কারণ এ নকশার সাহায্যে কোনো গবেষণা পরিচালনা করা হলে সেখানে যে পরিমাণ পরীক্ষণপাত্র নেওয়া হয় তাদেরকে শুধু দুটি দলেই ভাগ করতে হয়।
উপসংহার:
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সরল দৈবচয়িত নকশা মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যবহৃত একটি মৌলিক নকশা। এ নকশায় দুটি দল এবং একটি অনির্ভরশীল চল থাকে। তবে অনির্ভরশীল চলের দুটি শর্ত প্রয়োগ করা হয়। এসব শর্তের প্রভাবে নির্ভরশীল চলে কি ধরনের পার্থক্য ঘটে তা নির্ণয় করাই হলো এ নকশার মুখ্য উদ্দেশ্য। পরিসংখ্যানের মানদণ্ডে এটি অপেক্ষাকৃত ত্রুটিমুক্ত নকশা। এসব দিক বিচার করে মনোবিজ্ঞানের গবেষণা পরিচালনার জন্য এ নকশাটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।