দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশার সুবিধা ও অসুবিধাসহ
নকশা হলো কিছু সাধারণ নির্দেশনার সমাবেশ, যার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাথে সংগতিপূর্ণ কোনো গবেষণা কাজ পরিচালিত হয়। যেকোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিচালনা করার ক্ষেত্রে নকশা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অধিকাংশ গবেষণাতেই নকশা ব্যতীত গবেষণা পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তাই অনেক ক্ষেত্রে নকশাকে গবেষণার পূর্বশর্ত হিসেবেও গণ্য করা হয়। গবেষণা পরিচালনার সময় বিভিন্ন রকম নকশার উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়, যার মধ্যে দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশা অন্যতম।
দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশা
যে নকশায় দুই বা ততোধিক দল ব্যবহৃত হয় তাকে দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশা বলে। অন্যভাবে বলা যায়, যে নকশায় পারীক্ষদের দৈবচয়িতভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে একাধিক দল গঠনপূর্বক পরীক্ষণ পরিচালনা করা হয় তাকে দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশা বলে। সাধারণত দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশায় ৩টি, ৪টি, ৫টি বা তার বেশি দল গঠন করা হয়। এ ধরনের নকশায় একটি নির্ভরশীল চল থাকে। অতঃপর এই দলগুলোর উপর অনির্ভরশীল চল প্রয়োগ করে তার প্রভাব লক্ষ করা হয়।
উদাহরণ: দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশার উদাহরণ হিসেবে কাজের উপর আলোর প্রভাব আছে কি-না তা উল্লেখ করা যায়। এখানে আলো হলো অনির্ভরশীল চল এবং কাজের হার হলো নির্ভরশীল চল। 'এক্ষেত্রে পরীক্ষদের দৈবচয়িত পন্থায় নির্বাচন করে বিভিন্ন দলে ভাগ করে দেওয়া হয়। এরপর দলগুলোকে আলোর মাত্রা হ্রাস-বৃদ্ধি করে কাজ করতে দেওয়া হয়। অর্থাৎ ১ম দলকে 40w আলোতে, ২য় দলকে 60w আলোতে, ৩য় দলকে 80w আলোতে, ৪র্থ দলকে 100w আলোতে এভাবে পর্যায়ক্রমে কাজ করতে দিয়ে তাদের। কাজের দক্ষতা পরিমাপ করা হয়। এভাবে তাদের কাজের দক্ষতার পরিমাপ করার মাধ্যমে বুঝা যায়, কোন ধরনের আলো কাজটির জন্য বেশি উপযাগী। এখানে এ ধরনের পরীক্ষণের জন্য মূলত দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশা অবলম্বন করা হয়।
গাণিতিক বিশ্লেষণ:
দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশায় দুইয়ের অধিক দল থাকে এবং এদের উপর অনির্ভরশীল চলের বিভিন্ন মাত্রা প্রয়োগ করা হয়। এক্ষেত্রে নির্ভরশীল চলে বিভিন্ন দলের মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য আছে কি-না তা যাচাই করা এবং নির্ণায়ক সাফল্যাঙ্কে গড় পার্থক্যের বিচারে দলগুলোর মধ্যে তুলনা করার জন্য দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশায় প্রাপ্ত তথ্যগুলোকে গাণিতিক বিশ্লেষণের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা হয়। এ নকশায় তথ্যগুলোর গাণিতিক বিশ্লেষণের জন্য ভেদাঙ্কের বিশ্লেষণ ও ডানকান'স রেঞ্জ অভীক্ষা উভয় তথ্যই গাণিতিক বিশ্লেষণের জন্য উপযাগেী। এছাড়া এ নকশার তথ্য গাণিতিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে প্রথাগতভাবে f-অভীক্ষা অনুসরণ করা হয়।
এই f-অভীক্ষা থেকে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। যথা:
১. f-অভীক্ষার মান তাৎপর্যপূর্ণ না হলে এ সিদ্ধান্তে আসা হয় যে, দলগুলোর প্রতি জোড়া গড়ের মধ্যে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য নেই।
২. যদি f-অভীক্ষার মান তাৎপর্যপূর্ণ হয় তাহলে নাস্তি প্রকল্প বাতিল বলে বিবেচিত হয় এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, দলগুলোর মধ্যে। বিশ্বাসযাগ্যে পার্থক্য বিরাজ করছে।
f-অভীক্ষার মান পাওয়ার পর তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্যের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য f-অভীক্ষা পরিচালনা করা হয়। এছাড়া এ নকশায় তথ্যের গাণিতিক বিশ্লেষণের জন্য ডানকান'স রেঞ্জ অভীক্ষা করা হয়। এর কতকগুলো বিশেষ দিক আছে। যথা-
- এ-অভীক্ষা দলগুলোর বিভিন্ন জোড়ার মধ্যে সকল সম্ভাব্য তুলনায় সাহায্য করে।
- অভীক্ষা বহুসংখ্যক অভীক্ষা পরিচালনার চেয়ে সহজ।
- সকল সম্ভাব্য-অভীক্ষার চেয়ে অধিক যুক্তিসঙ্গত সম্ভাব্যতার মাত্রা পাওয়া যায়।
দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশার সুবিধাসমূহ
দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশার বহুবিধ সুবিধা রয়েছে। নিম্নে এর সুবিধাসমূহ আলোচনা করা হলো:
১. বহু উপাত্ত প্রাপ্তি: দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশার মাধ্যমে অনেক বেশি উপাত্ত পাওয়া যায়। কারণ এ নকশায় অনেকগুলো দল ব্যবহার করা হয়। এসব দলের উপর চল প্রয়োগ করায় এদের কাছে বিপুল পরিমাণে তথ্য পাওয়া যায়, যা অন্যান্য নকশা ব্যবহারে পাওয়া যায় না।
২. কম পরীক্ষণপাত্রের ব্যবহার: বহুদলীয় নকশার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা হলো এ নকশায় কম পরীক্ষণপাত্র প্রয়োজন হয়। যদিও এ নকশায় অনেকগুলো দল ব্যবহার করা হয় তথাপি প্রত্যেকটি দলে পরীক্ষণপাত্রের সংখ্যা অনেক কম হয়। ফলে উপাত্ত বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়।
৩. চলের মূল্যায়নে: দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশায় অনির্ভরশীল চলের মূল্যায়ন অনেক ভালো হয়। কারণ এ নকশাটিতে অনেকগুলো দলের উপর চল প্রয়োগ করা হয়। ফলে অনেকগুলো দলের কাছ থেকে প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণ করে চলের প্রভাব বুঝা যায়, যা চলের মূল্যায়নে সহায়তা করে।
৪. পূর্বোক্তিকরণ: দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশা ব্যবহারে গবেষণা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পূর্বোক্তি করা যায়। কারণ এ নকশা ব্যবহারে যেকোনো সমস্যাকে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে পরিমাপ করা যায়। ফলে সমস্যার প্রত্যেকটি বিষয় সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়, যা পূর্বোক্তিকরণে সহায়তা করে।
৫. চলের প্রভাব পরিমাপ: যেকোনো গবেষণায় নির্ভরশীল চলের উপর অনির্ভরশীল চলের প্রভাব নিরূপণ করা হয়। কিন্তু অনির্ভরশীল চল নির্ভরশীল চলকে কতটুকু প্রভাবিত করে তা অন্যান্য নকশা ব্যবহারে পরিমাপ করা যায় না। কিন্তু দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশা ব্যবহারে তা জানা যায়। অর্থাৎ অনির্ভরশীল চলের পরিবর্তনের সাথে সাথে নির্ভরশীল চলের কতটুকু পরিবর্তন সাধিত হয় তা এ নকশা ব্যবহারে বুঝা যায়।
৬. বিশ্বাসযাগ্যে ফলাফল প্রাপ্তি: দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশা ব্যবহারে যে ফলাফল পাওয়া যায় তা অত্যন্ত বিশ্বাসযাগ্যে হয়। কারণ এ নকশায় বহু দলের উপর অনির্ভরশীল চল প্রয়োগ করা হয়। এরপর তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত ফলাফলগুলোকে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ ও তুলনা করে ফলাফল তৈরি করা হয়। এজন্য ফলাফল অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য হয়।
৭. সিদ্ধান্ত গ্রহণ: দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশা ব্যবহারে যে তথ্য পাওয়া যায় তা অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়। আর এ বিশ্বাসযোগ্য ফলাফল দ্বারা সমস্যা সম্পর্কে সহজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। একই সাথে এটি বিভিন্ন চলের মধ্যকার রৈখিক সম্পর্কও আবিষ্কার করে।
দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশার অসুবিধাসমূহ
দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশার যেমন অনেক সুবিধা রয়েছে তেমনি কিছু কিছু অসুবিধাও রয়েছে। নিম্নে এর অসুবিধাসমূহ আলোচনা করা হলো:
১. ফলাফল বিশ্লেষণ কষ্টসাধ্য ও দুরুহ: দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশায় ফলাফল বিশ্লেষণ করার জন্য ভেদাঙ্ক বিশ্লেষণের সহায়তা গ্রহণ করা হয়। আর ভেদাঙ্ক বিশ্লেষণ একটি জটিল কাজ। এ জন্য দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশায় ফলাফল বিশ্লেষণ করা অনেক সময় কষ্টসাধ্য ও দুরূহ হয়ে পড়ে।
২. অনেকগুলো পরীক্ষণ দলের ব্যবহার: দৈবচয়িত বহু দলীয় নকশার আরেকটি অসুবিধা হলো- এই নকশায় অনেকগুলো পরীক্ষণ দলের ব্যবহার হয়। যদিও প্রত্যেকটি দলে পরীক্ষণপাত্রের সংখ্যা কম হয়। তবুও পরীক্ষণ দলের সংখ্যা বেশি হওয়ায় অনেক অপ্রয়োজনীয় তথ্য আসে, যা গবেষণায় ব্যাঘাত ঘটায়।
৩. সময়সাপেক্ষ: দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অসুবিধা হলো এ নকশা অনুযায়ী গবেষণা পরিচালনা করতে অনেক সময় লাগে। কারণ এ নকশায় অনেকগুলো পরীক্ষণ দল ব্যবহার করা হয়। এরপর তাদের কাছ থেকে অনেক তথ্য পাওয়া যায়, যা বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
৪. অপ্রয়োজনীয় তথ্য: দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশার অনেক দলের উপর অনির্ভরশীল চল প্রয়োগ করা হয়। এরপর সবগুলো দলের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। আর এসব তথ্যের সাথে অনেক অপ্রয়োজনীয় তথ্যও আসতে পারে, যা পরীক্ষণের ফলাফলকে প্রভাবিত করে।
৫. ভ্রান্তির পরিমাপ: দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশার আরেকটি অসুবিধা হলো এই নকশার দ্বারা বিভিন্ন ধরনের ভ্রান্তির পরিমাপ করা যায় না। যেমন- নমুনাগত ভ্রান্তি, আদর্শ ভ্রান্তি ইত্যাদি পরিমাপ করা যায় না।
উপসংহার:
দৈবচয়িত বহুদলীয় নশমায় দৈবচয়নের মাধ্যমে দল গঠন করে দলগুলোর উপর অনির্ভরশীল দলের বিভিন্ন মান ব্যবহার করে নির্ভরশীল চলের মান পরিমাপ করা হয়। এখানে অনেক বেশি উপায় পাওয়া যায়, যেগুলো একদিকে যেমন বিশ্বাসযোগ্য, অন্যদিকে তেমনি গ্রহণযোগ্য। কারণ এ নকশায় যেকোনো বিষয়কে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে পরিমাপ করা যায়, যা কোনো বিষয় সম্পর্কে পূর্বোক্তি করতে সহায়তা করে। এ কারণে মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশার গুরুত্ব অপরিসীম।