বিজ্ঞান হিসেবে মনোবিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য
মনোবিজ্ঞান হলো আচরণ ও মানসিক প্রক্রিয়ার একটি বিশ্লেষণধর্মী বিজ্ঞান। মনোবিজ্ঞান শুধু আচরণ সম্বন্ধে মৌলিক গবেষণায় সীমাবদ্ধ থাকে না বরং এর ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক দিক সম্পর্কেও আলোচনা করে থাকে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্র উন্মোচিত হয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা পদ্ধতির মাধ্যমে মনোবিজ্ঞান আজ বিজ্ঞান হিসেবে আত্মপ্রকাশ লাভ করেছে।
বিজ্ঞান
'বিজ্ঞান' শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো বিশেষ জ্ঞান। প্রকৃতির কোনো বিশেষ বিভাগ নিয়ে সুষ্ঠু, যথাযথ, বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ আলোচনাই হলো বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের বিষয়বস্তুকে পরীক্ষণযোগ্য ও পর্যবেক্ষণযোগ্য হতে হবে। বিজ্ঞান হচ্ছে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণায় যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত সুসংগঠিত ও সংঘবদ্ধ জ্ঞান। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পরীক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহারের প্রাধান্য থাকে। মূলত এটি বিজ্ঞানের সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য গবেষণা পদ্ধতি।
পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এরূপ একটি সমীকরণ হচ্ছে E=mc²। বিজ্ঞান যে কেবল পরীক্ষালব্ধ জ্ঞানই হবে এমন নয়। অগাণিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যকেও বিজ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞান বর্ণনামূলকও হতে পারে। যেমন- ডারউইন-এর বিবর্তনবাদ। এক্ষেত্রে পরীক্ষালব্ধ ফলাফল বা গাণিতিক বিশ্লেষণ কিছুই নেই, কিন্তু বিজ্ঞানভিত্তিক ও যৌক্তিক বিশ্লেষণ ব্যবহার করা হয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে সৃজনশীল এবং বস্তুনিষ্ঠ অনুমানও বিজ্ঞানের মর্যাদা লাভ করতে পারে। তবে একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, বিজ্ঞান হচ্ছে এক ধরনের শর্তসাপেক্ষে অনুসন্ধান।
বিজ্ঞান হিসেবে মনোবিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য
মনোবিজ্ঞান কি বিজ্ঞান, নাকি জৈব সামাজিক বিজ্ঞান, নাকি মানবিক শাখায় অন্তর্ভুক্ত তা একটি অনির্ধারিত বিষয়। বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্যগুলোকে মনোবিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্যের সাথে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যেতে পারে মনোবিজ্ঞান বিজ্ঞান কি-না। কোনো বিষয় বিজ্ঞান কি-না তা নির্ভর করে মূলত চারটি ঘটনা বা বিষয়ের ওপর। বিজ্ঞান হিসেবে মনোবিজ্ঞানের স্থান কতটুকু তা নিম্নে আলোচনার মাধ্যমে তুলে ধরা হলো:
ক. বিষয়বস্তু:
বিজ্ঞান যে বস্তু বা ঘটনার অনুধ্যান করে তা নিয়ম সাপেক্ষ। বিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর কতকগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যথা:
- বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু পর্যবেক্ষণযোগ্য হবে।
- বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু সম্পর্কে ভাষার সাহায্যে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হবে।
- বিজ্ঞানের বিষয়বস্তুকে প্রমাণসাপেক্ষ হতে হবে।
মনোবিজ্ঞানের মূল বিষয়বস্তু হলো মানুষ ও প্রাণীদের আচরণ বিশ্লেষণ। মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু বিজ্ঞানের উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো খুব ভালোভাবে পূর্ণ করে। তাই বিষয়বস্তুর দিক থেকে মনোবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলা যায়।
খ. বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি:
বিজ্ঞানের বড় পরিচয় হলো তার গবেষণা পদ্ধতি, বিষয়বস্তু নয়। বিজ্ঞানের নিজস্ব কিছু পদ্ধতি রয়েছে। দেখা যাক মনোবিজ্ঞান গবেষণায় এ পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করা হয় কি-না।
- কার্যকরী সংজ্ঞা: বিজ্ঞানী বা গবেষক যে বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন তার প্রতিটি পদের সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদানই হলো কার্যকরী সংজ্ঞা। গবেষক তার গবেষণার বিষয় সম্পর্কে একটি কার্যকরী সংজ্ঞা প্রদান করেন। কারণ কার্যকরী সংজ্ঞা প্রদান ছাড়া বিষয়টির দ্ব্যর্থহীন সিদ্ধান্ত পাওয়া যায় না। মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণা পরিচালনার সময় বিষয়বস্তুকে স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে বর্ণনা করে থাকে।
- বস্তুনিষ্ঠতা: বস্তুনিষ্ঠতা বলতে বুঝায় কোনো বিষয় সবার কাছে একইভাবে অর্থপূর্ণ হওয়া। ব্যক্তিনিষ্ঠ কোনো বিষয় বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হতে পারে না। তাই 'মন'কে বাদ দিয়ে 'আচরণ'কে মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। কারণ একটি বিশেষ আচরণ স্থান-কাল-পাত্রভেদে সবার কাছে একই অর্থপূর্ণ মনে হয়।
- নিয়ন্ত্রণ: বিজ্ঞানসম্মত পর্যবেক্ষণ কে অবশ্যই সুনিয়ন্ত্রিত হতে হবে। বিজ্ঞানী যখন কোনো আচরণ পর্যবেক্ষণ করেন, তখন তিনি গবেষণাগারে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশেই করে থাকেন। মনোবিজ্ঞানীর উদ্দেশ্য হলো আচরণের "কার্যকর সম্পর্ক খুঁজে বের করা" কিন্তু কোনো আচরণের কার্যকরণ সম্পর্কে আবিষ্কার করতে গেলে পারিপার্শ্বিক উদ্দীপকসমূহকে নিয়ন্ত্রিত করতে হবে।
- পুনরাবৃত্তি: পুনরাবৃত্তি বিজ্ঞানের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কোনো একটি বিষয় নিয়ে বারবার গবেষণা করাকে পুনরাবৃত্তি বলে। মনোবিজ্ঞানের গবেষণায়ও কোনো গবেষণার ফলাফলকে যাচাই করার জন্যে ঐ গবেষণার পুনরাবৃত্তি করা যায়।
- যথার্থতা প্রমাণ: বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো যথার্থতা প্রমাণ। বিজ্ঞানের গবেষণায় লব্ধ জ্ঞান যথার্থ ও বস্তুনিষ্ঠ। একটি গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলটিকে স্থান, কাল ও পাত্রভেদে বার বার পুনরাবৃত্তি করার পর যদি সকল ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে গ্রহণযোগ্য সহ সম্পর্ক থাকে। তবে উক্ত ফলাফলটিকে যথার্থ বলা যাবে।
- সাধারণীকরণ: সাধারণীকরণ এর অর্থ হলো অল্প সংখ্যক দৃষ্টান্ত থেকে সাধারণ সত্যে উপনীত হওয়া। সাধারণত অনেকগুলো পর্যবেক্ষণ লব্ধ তথ্যের উপর ভিক্তি করে একটি সাধারণ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াকেই বলে সাধারণীকরণ। সাধারণীকরণ থেকে পরবর্তীতে তত্ত্ব এবং সূত্র প্রকাশ করার চেষ্টা করা হয়। যা বিজ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
- সামঞ্জস্যকরণ: সামঞ্জস্যকরণের মূল বক্তব্য হলো দুটি পরস্পর বিরোধী উক্তির মধ্যে যে অসামঞ্জস্যতা থাকবে তা দূর করা। বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক সময় পরস্পর বিরোধী বক্তব্য পাওয়া যায়। তবে এসব বক্তব্যের একটি সত্য এবং অন্যটি মিথ্যা প্রমাণিত হবে। মনোবিজ্ঞানীগণ ব্যাখ্যাধর্মী পরস্পরবিরোধিতা দূর করার জন্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।
গ. বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি:
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি বলতে বোঝায় পুরোনোকে আঁকড়ে ধরে না থেকে নতুনকে স্বাগত জানানো। বিজ্ঞান সর্বদা গতিশীল। তথ্য ও তত্ত্বের পরিবর্তনের সাথে সাথে তাকে গ্রহণ করার মানসিকতা বিজ্ঞানীর থাকতে হবে। মনোবিজ্ঞানীদেরও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তারা মনোবিজ্ঞানে নতুন নতুন তথ্য ও তত্ত্ব আবিষ্কারের সাথে সাথে তা গ্রহণ করছে। যেমন- মনোবিজ্ঞান তার বিষয়বস্তু হিসেবে 'মন' এর পরিবর্তে 'আচরণ'কে গ্রহণ করেছে।
ঘ. প্রয়োগশীলতা:
প্রয়োগশীলতা বিজ্ঞানের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু এমন হবে যাতে বাস্তবে ব্যবহার বা প্রয়োগ করা যায়। বিজ্ঞানের মৌলিক ধারণাগুলোকে বিজ্ঞানী ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে থাকেন। মনোবিজ্ঞানের জ্ঞানকেও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব। মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য, মনোবিজ্ঞানীদের প্রদত্ত মতবাদ ও সূত্রের বহুমুখী ব্যবহার আজ সমগ্র বিশ্বে লক্ষ্য করা যায়। শিক্ষা, সাহিত্য, বীমা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা, শিল্প, ব্যক্তিজীবন, সামাজিক জীবন এমনকি প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও মনোবিজ্ঞানের জ্ঞানকে ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব।
উপসংহার:
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আধুনিক মনোবিজ্ঞান একটি বহুল পরীক্ষিত ও গবেষণা সমৃদ্ধ বিজ্ঞান। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর আচরণ সম্পর্কে অনুধ্যান করতে গিয়ে মনোবিজ্ঞান পরীক্ষণ ও নিরীক্ষণ পদ্ধতিকে ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করে থাকে। তথ্য ও তত্ত্বের পরিবর্তনের সাথে সাথে কোনো বিষয়বস্তুকে গ্রহণ করার দৃষ্টিভঙ্গি এ বিজ্ঞানের আছে। সুতরাং মনোবিজ্ঞান একটি যথার্থ বিজ্ঞান।