গবেষণা নকশা কি? একটি উত্তম গবেষণা নকশার বৈশিষ্ট্যসমূহ

গবেষণার নকশা বা পরীক্ষণের নকশা একটি পরিকল্পনা যাতে গবেষণার প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার লক্ষ্যে পর্যবেক্ষণের শর্তাবলি উপাত্ত সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণের কৌশল ইত্যাদি নির্দেশিত হয়। সুতরাং নকশার গুরুত্ব মনোবিজ্ঞানে অনস্বীকার্য।

মনোবিজ্ঞানী সেলটিজ (Seltiz) বলেন, 

গবেষণার নকশা বলতে বোঝায় তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের জন্য পরিস্থিতি বা শর্তাবলির এমন একটি বিন্যাস যাতে পদ্ধতিগত মিতব্যয়িতার সাথে গবেষণার উদ্দেশ্যের সমন্বয় ঘটে।

মনোবিজ্ঞানী কার্লিঙ্গার (Karlingar) বলেন, 

কোনো গবেষণার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য এবং ভেদাঙ্ক নিয়ন্ত্রণের জন্য যে অনুসন্ধান কার্য পরিচালনা করা হয়, তার পরিকল্পনা কাঠামো এবং কৌশলসমূহকে গবেষণার নকশা বলা হয়।

মনোবিজ্ঞানী ব্লাক ও ব্লাকের (Black & Black) বলেন, 

নকশা হলো কিছু সাধারণ নিদের্শনার সমাবেশ যার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাথে সংগতিপূর্ণ কোনো গবেষণা কাজ পরিচালিত হয়।

ভালো পরীক্ষণ নকশার বৈশিষ্ট্যসমূহ: 

বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিচালনার জন্য নকশা অপরিহার্য। তবে যেকোনো ধরনের নকশা দ্বারা পরীক্ষণ পরিচালনা করা উচিত নয়। কারণ নকশার আলোকে পরীক্ষণ পরিচালিত হয়। এজন্য বৈজ্ঞানিক গবেষণায় পরীক্ষণ পরিচালনার জন্য প্রণীত নকশাকে ভালো ও সুস্পষ্ট হতে হয়। তাই নকশা প্রণয়নের কতকগুলো বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানা আবশ্যক। নিম্নে একটি ভালো পরীক্ষণ নকশার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো:

১. ছকাকারে বর্ণিত: 

একটি ভালো পরীক্ষণ নকশার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো একে ছকাকারে বর্ণিত হতে হয়। অর্থাৎ নকশার কতকগুলো ধাপ রয়েছে যেগুলো এলোমেলোভাবে না হয়ে ছকের মাধ্যমে ক্রমানুসারে বর্ণনা করতে হয়। তাহলেই নকশাটি অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়।

২. ভাষার ব্যবহার: 

একটি ভালো নকশায় সাধারণত বর্ণনামূলক কোনো অংশ থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। অর্থাৎ নকশা সর্বদা ছকের মাধ্যমে উপস্থাপন করা আবশ্যক। তবে নকশাকে আরো স্পষ্ট করে তোলার জন্য অতি সংক্ষেপে ভাষার ব্যবহার করা যেতে পারে।

৩. উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের প্রতিফলন: 

একটি ভালো নকশায় গবেষণার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতিফলন থাকা আবশ্যক। অর্থাৎ নকশাটি এমনভাবে তৈরি করতে হয় যাতে গবেষণার লক্ষ্যে ও উদ্দেশ্যগুলো যথাযথভাবে পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

৪. চলগুলোর প্রতিফলন: 

একটি ভালো নকশা এমন হতে হয় যাতে তা থেকে সহজেই চলগুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায়। অর্থাৎ নকশার সাপেক্ষ ও নিরপেক্ষ চলের অবস্থান ও অস্তিত্বের ধারণা স্পষ্ট করা আবশ্যক। একই সাথে নকশায় ক্ষতিকর চল হিসেবে বাহ্যিক চলের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা প্রদান করতে হয়।

৫. প্রকল্পের প্রমাণযোগ্যতা: 

একটি ভালো পরীক্ষণের নকশা দ্বারা সহজেই প্রকল্পকে প্রমাণ করা যায়। কারণ নকশা অনুসরণ করেই উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। এজন্য নকশায় এমন গুণাবলি থাকতে হয় যা দ্বারা গবেষণার প্রকল্পটি ধনাত্মক বা ঋণাত্মকভাবে প্রমাণ করার সুযোগ থাকে।

৬. প্রয়োজনীয় তথ্যের উপস্থিতি: 

একটি ভালো নকশায় গবেষণার প্রয়োজনীয় তথ্যেও উপস্থিতি থাকা আবশ্যক। অর্থাৎ ভালো নকশায় গবেষণায় অংশগ্রহণকারী পারীক্ষ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা প্রদান করতে হয় যাতে তা থেকে গবেষণা সম্পর্কে ধারণা গঠন করা যায়। 

৭. ভুল এড়ানোর পদ্ধতি: 

একটি নকশার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এর ভুল এড়ানোর পদ্ধতি। গবেষণায় বিভিন্ন ধরনের ভুল হতে পারে। তবে এখানে ভুল বলতে ব্যক্তিগত ভুল ও পদ্ধতিগত ভুলকে বুঝানো হয়েছে। এসব ভুলকে কিভাবে এড়িয়ে যাওয়া যায়, অথবা কি করলে ভুল কম হয় তা নকশায় উল্লেখ করতে হয়।

৮. দৈব ভুল ও ভুলের পরিমাণ নির্ণয়: 

একটি ভালো নকশায় সব সময় দৈব ভুল কম হয় এবং ভুলের পরিমাণ নির্ণয় করা যায়। এর মাধ্যমে কোন কোন অনুধ্যানে দৈব ভুল সৃষ্টি হয়, পরীক্ষণপাত্রদের ব্যক্তিগত প্রভাব ও বিভিন্ন রকম অজ্ঞাত শর্তের প্রভাব জানা যায়। এ ভুল সম্পর্কে পরিহার করা যায় না। তবে গবেষণার নকশা সঠিক হলে এর পরিমাণ হ্রাস পায় এবং পরিমাপ করা যায়।

৯. সংক্ষিপ্ততা: 

একটি ভালো নকশাকে অবশ্যই সংক্ষিপ্ত হতে হয়। এটি নকশার আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। একটি ভালো নকশা সংক্ষিপ্ত হলেও এতে পুরো গবেষণাটির চিত্রের প্রতিপলন হওয়া আবশ্যক। অর্থাৎ একটি ভালো নকশাকে এমন হতে হয় যাতে এতে সমস্ত গবেষণা কর্মটি সংক্ষিপ্তাকারে উপস্থাপিত হয়।

১০. মূল্যায়ন: 

একটি ভালো নকশাকে অবশ্যই মূল্যায়নযোগ্য হতে হয়। এজন্য একটি ভালো নকশা ব্যবহার করে গবেষণা পরিচালনা করার পর পরবর্তীতে গবেষণাটি মূল্যায়ন করা হয়। এ ধরনের মূল্যায়নের মাধ্যমে যদি নকশাটির পরিবর্তন করার প্রয়োজন না হয় তাহলে নকশাটিকে ভালো ও কার্যকর হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

১১. ফলাফল তৈরি: 

সাধারণত গবেষণার জন্য যে নকশা প্রণয়ন করা হয়, তার আলোকেই তথ্য গ্রহণ করা হয়। আর এই তথ্যের আলোকে ফলাফল তৈরি করা হয়। এজন্য নকশার প্রত্যাশিত রূপটি এমন হতে হয় যাতে অনুসন্ধানে প্রাপ্ত উপাত্তগুলোকে নকশা অনুযায়ী বিশ্লেষণ করে ফলাফল তৈরি করা সম্ভব হয়।

১২. পুনরুৎপাদনশীলতা: 

একটি ভালো নকশার 'মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো পুনরুৎপাদনশীলতা। কোন নকশাকে ভালো নকশা হিসেবে বিবেচনায় আনতে হলে সেটির পুনরুৎপাদনশীলতা গুণটি থাকা আবশ্যক। অর্থাৎ নকশাটি এমন হতে হয় যেন সহজেই তার পুনরাবৃত্তি বা পুনরুৎপাদন করা যায়। এর ফলে পরীক্ষণের ফলাফল বার বার যাচাইয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়, স্থানীয় প্রভাব লক্ষ এবং ভুলের পরিমাণ নিরূপণ করা যায়।

১৩. মিতব্যয়িতা: 

একটি ভালো নকশায় অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মিতব্যয়িতা। অর্থাৎ নকশাটির মাধ্যমে পরীক্ষণ পরিচালনায় যেন কম খরচে ও কম সময়ে গবেষণাটি সম্পন্ন করা যায়। যে নকশায় সবসময় অধিক ব্যয় ও বেশি সময় লাগে সে নকশাটি পরিহার করতে হয়।

১৪. গবেষণার উদ্দেশ্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত: 

একটি ভালো নকশা সবসময় গবেষণার উদ্দেশ্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়। কারণ নকশা সঠিক না হলে গবেষণায় উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। একটি নকশা যদি গবেষণায় উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পূরণ করতে না পারে তবে সে নকশা কখনোই ভালো নকশা হতে পারে না। তাই গবেষণায় উদ্দেশ্যের সাথে নকশা সম্পর্কযুক্ত হওয়া একান্ত অপরিহার্য।

১৫. প্রকল্পের সত্যতা: 

একটি ভালো নকশার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো প্রকল্পের সত্যতা নিরূপণ করা। নকশাকে এমন হতে হয় যেন সত্যিকারের প্রভাব সম্বন্ধে যেকোনো বিশেষ প্রকল্পের সত্যতা প্রমাণ করা যায়। নকশাটি এমন হবে যেন পরীক্ষণের প্রকল্পকে গ্রহণ বা বর্জন করতে পারে। অর্থাৎ প্রকল্পকে বস্তুনিষ্ঠভাবে পরীক্ষা করতে হবে।

উপসংহার

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্রায় সব ধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য গবেষণামূলক নকশার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। তবে যেকোনো ধরনের নকশা দ্বারা গবেষণা পরিচালনা করতে প্রকৃত উদ্দেশ্য অর্জন সম্ভব হয় না। এজন্য একটি সঠিক গবেষণা পরিচালনা করার জন্য প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সঠিক গবেষণা নকশা অনুসরণ করতে হয়। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো গবেষণা নকশায় যেন উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান থাকে। তাহলেই গবেষণা কার্যটি সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url