স্বাভাবিক ও অস্বভাবী আচরণের পার্থক্য

লৌকিক ব্যাখ্যায় যেসব আচরণ সাধারণ মানুষের আচরণ থেকে দর্শনীয়ভাবে পৃথক সেগুলো হলো অস্বভাবী আচরণ। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা স্বভাবী আচরণের একটি মানদণ্ড ঠিক করে নিয়ে থাকি এবং সে মানদণ্ডের সাথে তুলনা করে যে আচরণগুলোকে পৃথক মনে করি সেগুলোকেই আমরা অস্বভাবী আচরণ বলে থাকি।

স্বাভাবিক ও অস্বভাবী আচরণের মধ্যে কোনো গুণগত পার্থক্য নেই, যা কিছু পার্থক্য তা কেবল পরিমাণগত। ব্যক্তিমাত্রই মনের মধ্যে সব ধরনের মানসিক অসুস্থতা ও বিকৃতির অঙ্কুরই সুপ্তভাবে বর্তমান। পরিবেশ ও অবস্থার বদৌলতে কেউ হয় স্বাভাবিক, কেউ হয় অস্বভাবী।

স্বাভাবিক ও অস্বভাবী আচরণের পার্থক্য

স্বাভাবিক ও অস্বভাবী আচরণের পার্থক্য নিচে নির্দেশ করা হলো:

১. ব্যক্তির চাহিদা

স্বাভাবিক আচরণ ব্যক্তিকে তার জৈবিক ও সামাজিক প্রেষণাগুলো চরিতার্থ করে তার পরিবেশের সাথে সংগতি স্থাপন করে চলতে সাহায্য করে।

অস্বভাবী আচরণ ব্যক্তির চাহিদাসমূহ পূরণ করতে এবং ব্যক্তিকে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে সাহায্য করে না। ফলে ব্যক্তির চাহিদাসমূহ অপূর্ণ থেকে যায় এবং ব্যক্তি অসুখী বোধ করে।

২. বাস্তবের সাথে সংযোগ

স্বাভাবিক ব্যক্তি বাস্তবের সাথে কার্যকর সংযোগ বজায় রাখতে সমর্থ হবে।

অস্বভাবী ব্যক্তি বাস্তবের সাথে কার্যকর সংযোগ বজায় রাখতে অসমর্থ।

৩. হতাশা বা দ্বন্দ্ব

স্বাভাবিক ব্যক্তি হতাশা বা দ্বন্দ্বের জন্য বাস্তব থেকে নিজেকে অপসারণ করে না।

অস্বভাবী ব্যক্তি হতাশা বা দ্বন্দ্বের জন্য বাস্তব থেকে নিজেকে অপসারণ করে রাখে।

৪. চিন্তাধারা

স্বাভাবিক ব্যক্তির চিন্তাধারা স্বাভাবিক ও স্বচ্ছন্দ।

অস্বভাবী ব্যক্তির চিন্তাধারায় অযৌক্তিকতা, চিন্তাশক্তির অভাব, এমনকি স্তব্ধতা বা অতিরিক্ত কল্পনাপ্রবণতা থাকতে পারে।

৫. নিরাপত্তা 

স্বাভাবিক ব্যক্তির মধ্যে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাবোধ থাকে।

অস্বভাবী ব্যক্তির মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়।

৬. বাস্তবানুগ 

প্রাকৃতিক বা সামাজিক পরিবেশে স্বাভাবিক ব্যক্তির আচরণ হয় বাস্তবানুগ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ।

প্রাকৃতিক বা সামাজিক পরিবেশে অস্বভাবী ব্যক্তির আচরণ সামঞ্জস্যহীন হয়। ব্যক্তির মধ্যে বাস্তবকে অস্বীকার করার চেষ্টা থাকে।

৭. দল বা সমাজের চাহিদা 

স্বাভাবিক ব্যক্তির দল বা সমাজের চাহিদা মেটাবার ক্ষমতা থাকে। নিজেকে সে দল পরিত্যক্ত বলে মনে করে না এবং কোনো রকম হীনম্মন্যতাতেও ভোগে না।

অস্বভাবী ব্যক্তি দল বা সমাজের চাহিদা মেটাতে অক্ষম এবং ব্যক্তি সবসময় এক ধরনের হীনম্মন্যতায় ভোগে।

৮. ব্যক্তিত্বের সমন্বয় 

স্বাভাবিক আচরণসম্পন্ন ব্যক্তিদের ব্যক্তিত্বের সুষ্ঠু সমন্বয় থাকে এবং তাতে সুসামঞ্জস্য থাকে।

অস্বভাবী আচরণসম্পন্ন ব্যক্তিদের সুষ্ঠু সমন্বয় থাকে না।

৯. নিজেকে পরিমাপ

স্বাভাবিক ব্যক্তি নিজেকে যথাযথ পরিমাপ করতে সক্ষম। তার দুর্বলতা ও অক্ষমতাগুলোকে সে গ্রহণ করতে সমর্থ।

অস্বভাবী ব্যক্তি নিজেকে পরিমাপ করতে অক্ষম এবং তার দুর্বলতা ও অক্ষমতাগুলোকে সে গ্রহণ করতে অক্ষম।

১০. আবেগের বহিঃপ্রকাশ

স্বাভাবিক ব্যক্তির আবেগের বহিঃপ্রকাশ পরিমিত ও সুসংগত।

অস্বভাবী ব্যক্তির আবেগের বহিঃপ্রকাশ অসংগত।

১১. স্বতঃস্ফূর্ততা

এ ধরনের ব্যক্তির মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে স্বতঃস্ফূর্ততা থাকে।

এদের আচরণের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ততা থাকে না।

১২. জীবনের লক্ষ্য ও দ্বন্দ্ব

স্বাভাবিক ব্যক্তির জীবনের লক্ষ্যগুলো বাস্তবধর্মী হবে। এসব ব্যক্তি অবাস্তব লক্ষ্য বা চাহিদার পোষণ করে নিজের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে না।

অস্বভাবী ব্যক্তির জীবনের লক্ষ্যগুলো অবাস্তব এবং কল্পনাপ্রসূত। এসব ব্যক্তিরা অবাস্তব লক্ষ্য বা চাহিদার পোষণ করে নিজের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে।

১৩. অলীক ও ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ

স্বাভাবিক ব্যক্তিদের মধ্যে অলীক প্রত্যক্ষণ এবং ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ থাকে না।

অস্বভাবী ব্যক্তিদের সাধারণ লক্ষণের মধ্যে অলীক। প্রত্যক্ষণ ও ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ দেখা যায়।

১৪. নিরাপদ

এরা নিজের ও সমাজের জন্য নিরাপদ।

অস্বভাবী ব্যক্তি নিজের ও সমাজের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। এজন্য এদের অনেক সময় মানসিক হাসপাতালে বা ক্লিনিকে আবদ্ধ রাখতে হয়।

১৫. যৌনজীবন

এদের মানস যৌনজীবনের গতিপথে কোনো স্তব্ধতা পশ্চাদ্গমন থাকে না।

এদের মানস-যৌনজীবনের গতিপথে স্বব্ধতা বা পশ্চাদ্গমন দেখা যায়।

উপসংহার: 

স্বাভাবিক ও অস্বভাবী আচরণের মধ্যে কোনো গুণগত পার্থক্য নেই। যা কিছু প্রভেদ তা কেবল পরিমাণগত। ব্যক্তি মাত্রেরই মনের মধ্যে সবরকম মানসিক অসুস্থতা ও বিকৃতির অঙ্কুরই সুপ্তভাবে বর্তমান। পরিবেশ ও পরিস্থিতির বৈগুণ্যে কেউ হয় স্বাভাবিক আবার কেউ হয় অস্বভাবী।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url