নমুনায়ন সংশ্লিষ্ট ধারণাসমূহ
পরিসংখ্যানিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্র বড় হলে এর সকল একক হতে তথ্য সংগ্রহ করা যেমন কষ্টকর ও সময়সাপেক্ষ তেমনি ব্যয়বহুল। এজন্য আদমশুমারি ধরনের অনুসন্ধান ছাড়া প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তথ্যবিশ্বের সকল একক হতে তথ্য সংগ্রহ না করে সমগ্রকের একটি বিশেষ অংশ বা প্রতিনিধিত্বমূলক অংশ নির্বাচন করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এভাবে তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতিই হচ্ছে নমুনায়ন।
একটি বৃহৎ অংশ সম্পর্কে মন্তব্য করার জন্য তার অন্তর্ভুক্ত সামান্য একটি অংশ বিবেচনা করে ঐ বৃহৎ পরিমাণটির উপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। নমুনায়নের মাধ্যমে তথাবিশ্বের একটি প্রতিনিধিত্বমূলক নমুনা নির্বাচন করা হয় এবং সেই নির্বাচিত নমুনা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
নমুনায়ন সংশ্লিষ্ট ধারণাসমূহ
নমুনায়ন এবং নমুনাজ নিবেশন সম্পর্কে ভালো জ্ঞান লাভ করতে হলে শুরুতেই নিম্নোক্ত বিষয় সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকা প্রয়োজন।
১. সমগ্রক বা তথ্যবিশ্ব (Population):
কোন বিষয়ে গবেষণার কাজে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যধারী সকল উপাদানের সেটকে সমগ্রক বা তথ্যবিশ্ব (Population or, Universe) বলা হয়। অথবা, যে বৃহত্তর ক্ষেত্র থেকে গবেষণা' বা পরিসংখ্যানিক অনুসন্ধানের জন্য একটি ক্ষুদ্র অংশ বাছাই করা হয়, সে বৃহত্তর ক্ষেত্রের সমস্ত উপাদানকে একত্রে সমগ্রক বা তথ্যবিশ্ব বলা হয়। সমগ্রককে 'N' দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
উদাহরণ- ঢাকা কলেজের মনোবিজ্ঞানের ১০০ জন ছাত্র থেকে ছাত্রদের মান যাচাইয়ের লক্ষ্যে ১০ জন ছাত্রকে নতুন হিসেবে বাছাই করা হলে সমগ্রহক হবে ১০০ ছাত্র। আবার বাংলাদেশের লোকদের গড় আয় নির্ণয়য়ের জরিপে দেশের সকল লোক হবে উক্ত জরিপের সমগ্রক।
সমগ্রক প্রধান দুধরনের হয়ে থাকে। যথা:
ক) সসীম সমগ্রক (Finite Population): সমগ্রকের মোট এককের সংখ্যা গণনাযোগ্য হলে তাকে সসীম সমগ্রহ বলে। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে তথ্যবিশ্বের উপাদান সংখ্যা গণনার সীমার মধ্যে থাকে। যেমন- কোন একটি নির্দিষ্ট এলাকার লোকসংখ্যার সমগ্রক।
খ) অসীম সমগ্রক (Infinite Population): সমগ্রকের মোট এলাকার সংখ্যা সীমাহীন হলে তাকে অসীম সমগ্রক বলে। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে তথ্যবিশ্বের উপাদানসংখ্যা বা এককগুলো গণনার সীমার মধ্যে থাকে না। যেমন- কোন এলাকার বাতাসে ধূলিকণার সংখ্যা, পদ্মা নদীতে ইলিশ মাছের সংখ্যা ইত্যাদি।
২. নমুনা (Sample):
সমগ্রকের কিছু অংশ যা পরিসাংখ্যিক অনুসন্ধানের জন্য নির্বাচন করা করা হয়ে থাকে। অন্য কথায় বলা যায় সমগ্রক (Population) হতে যদি কিছু অংশ নির্বাচন করা হয়, তবে উক্ত অংশকে নমুনা (Sample) বলে। নমুনায় সমগ্রকের যতগুলো একক অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাদেরকে নমুনা একক বলা হয় এবং নমুনা মোট একক সংখ্যাকে নমুনার আকার বলা হয়।
৩. শুমারি জরিপ (Census):
পরিসাংখিক তথ্য সংগ্রহে জরিপ কার্য পরিচালনা করা হয়। এক্ষেত্রে শুমারি জরিপকে অন্যতম একটি জরিপ কার্য হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। যে জরিপ বা পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়ায় সমগ্রক (Population) এর প্রতিটি একক হতে তথ্য সংগ্রহ করা হয় সে জরিপ কার্যই শুমারি জরিপ (census survey) অর্থাৎ শুমারি জরিপে সমগ্রকের প্রতিটি উপাদানকেই তথ্য সংগ্রহের আওতায় আনা হয়ে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ: আদম শুমারি, কৃষি শুমারি ইত্যাদি।
৪. নমুনা জরিপ (Sample Survey):
যে জরিপ বা পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়ায় সমগ্রকের এর প্রতিনিধিত্বকারী একটি অংশ বা একক হতে তথ্য সংগ্রহ করা হয়, সে জরিপ কার্যই নমুনা জরিপ (sample survey) অর্থাৎ নমুনা জরিপে সমগ্রকের একটি ক্ষুদ্র অংশকে তথ্য সংগ্রহের আওতায় আনা হয়ে থাকে।
৫. নমুনায়ন বা নমুনা পদ্ধতি (Sampling):
নমুনায়ন এমন এক প্রকার পদ্ধতি বা কৌশল যা কোন তথ্য সমগ্রকের একটা অংশ পরীক্ষা দ্বারা সম্পূর্ণ তথ্য সম্পর্কে মোটামুটি একটি ধারণা বা সিদ্ধান্ত প্রদান করে। কোন কোন সময় যে কোন অনুসন্ধান সংক্রান্ত সমস্ত তথ্যাবলী বিবেচনা করার বা সংগ্রহ করার জন্য প্রচুর সময়ের প্রয়োজন হয় এবং তা ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে পড়ে। এই অসুবিধা দূর করার জন্য সমস্ত তথ্যাবলী থেকে কিছু কিছু তথ্যকে সমস্ত তথ্যের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রহণ করে; সেটা হতে নির্দিষ্ট কোন ঘটনা সম্পর্কে ধারণা করা যায়। যে পদ্ধতি এই প্রকার ধারণা দিতে পারে তাকে নমুনায়ন বলে।
উদাহরণ: কোন গৃহকর্ত্রী ভাত রান্না করার সময় হাঁড়ি হতে দু'একটি ভাত পরীক্ষা করেই সমস্ত চাল সিদ্ধ হয়েছে কিনা তা বুঝতে পারেন ইত্যাদি।
৬. নমুনা বা নমুনায়ন একক (Sampling Unit):
নমুনায়ন অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেকটি একককে নমুনা একক বলা হয়। তথ্য বিশ্ব যে সমস্ত উপাদান নিয়ে গঠিত হয় তাদের প্রত্যেকটিকে নমুনায়ন একক বলা হয়। যাদের নিকট থেকে অনুসন্ধানের জন্য তথ্য সংগ্রহ করা হবে তাদের প্রত্যেকেই নমুনা একক হিসেবে বিবেচিত হবে। প্রত্যেকটি নমুনায়ন একক তথ্য বিশ্বে কেবলমাত্র একবার থাকে। উদাহরণ স্বরূপ কোন একটি জরিপে ৫০০ জন শ্রমিককে নমুনার অন্তর্ভুক্ত করা হলে ৫০০ জন শ্রমিকের প্রত্যেকেই এক একটি নমুনা একক।
৭. নমুনা কাঠামো (Sampling Frame):
সমগ্রকের প্রতিনিধিত্বকারী নমুনা একসমূহের তালিকাকে নমুনা কাঠামো বলে। ব্যাপকভাবে বলা যায় যে, কোন গবেষণার জন্য জরিপ কাজ পরিচালনা করতে গিয়ে যেসব একক হতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের তথ্য পাওয়া যায়, সেই একক সমূহে সমষ্টিগত কাঠামোকে নমুনা কাঠামো বলে।
যেমন- বাংলাদেশের উপজাতিদের উপর গবেষণা পরিচালনা করতে গিয়ে উপজাতিদের নামের তালিকা তৈরি করা হয়। এই তালিকা হলো নমুনা কাঠামো।
৮. নমুনা আকার (Sample Size):
নমুনা একক বা নমুনা উপাদানের মোট সংখ্যাকে নমুনা আকার বলা হয়। যেমন-কোন একটি নমুনার ২০টি একক থাকলে ঐ নমুনার আকার হবে ২০। নমুনা আকারকে 'n' দ্বারা প্রকাশ করা হয়। নমুনা আকার সর্বদাই সসীম। হয়। আকারের ভিত্তিতে নমুনাকে দু'ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
ক) ছোট নমুনা (Sample): নমুনা এককের সংখ্যা 30 এর চেয়ে ছোট হলে (n <30) নমুনাটিকে ছোট বা ক্ষুদ্রানমুনা বলা হয়।
খ) বড় নমুনা (Large Sample): নমুনা এককের সংখ্যা ৩০ বা ৩০ এর চেয়ে বড় হলে (n > 30) নমুনাটিকে বড় বা বৃহৎ নমুনা বলে।
বৃহৎ নমুনার জন্য অধিক শ্রম, অর্থ ও সময় ব্যয় করতে হয়। আবার ক্ষুদ্র বা ছোট নমুনা সমগ্রকের প্রতিনিধিত্ব নাও করতে পারে। সুতরাং নমুনার প্রকৃত উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য নমুনার আকার পরিমিত হওয়া প্রয়োজন। নমুনা জরিপের জন্য বরাদ্দকৃত সময়, অর্থ, কর্মীর সংখ্যা, সমগ্রক এলাকা ও আকার ইত্যাদির উপর নমুনার আকার নির্ভর করে।
৯. পরামিতি বা তথ্যজমান (Parameter):
সমগ্রকের কোন বৈশিষ্ট্য পরিমাপ করার জন্য যদি সমগ্রকের সব একক পরিগণনায় আনা হয় অর্থাৎ সমগ্রকের সব এককের ভিত্তিতে যদি কোন বৈশিষ্ট্যের পরিমাপ করা হয় তাকে পরামিতি বলে। পরামিতি তথ্যবিশ্বকে পরিপূর্ণরূপে পরিচিতি দান করে। একটি তথ্যবিশ্বকে সাধারণত পরামিতি দ্বারা প্রকাশ করা হয়ে থাকে। পরামিতি সব সময় ধ্রুবক হয় এবং অজানা থাকে। ইহা তথ্যের বিন্যাসের পরিচায়ক।
যেমন-দ্বিপদী বিন্যাসের পরামিতি n ও p, পরিমিত বিন্যাসের পরামিতি μ ও σ²। সাধারণত গড়, ভেদাংক, সংশ্লেষাংক ইত্যাদি নির্ণয় করে পরামিতি পাওয়া যায়।
১০. নমুনাজমান (Statistic):
নমুনার কোন বৈশিষ্ট্যের পরিমাপ যা নমুনার প্রতিটি এককের উপর ভিত্তি করে নির্ণীত হয় তাকে নমুনাজমান বলে। কোন নির্বাচিত নমুনা হতে যে সব বৈশিষ্ট্য গণনা করা হয় তাদেরকে নমুনাজমান বলে। যেমন-ঢাকা কলেজের ছাত্রদের গড় উচ্চতা পরিমাপ করতে যদি নমুনায়ন পদ্ধতিতে অল্প কিছু ছাত্রের একটি নমুনা সংগ্রহ করে তাদের উচ্চতার গড় উচ্চতা পরিমাপ করা হয় তবে ঐ উচ্চতা পরিমাপকে বলা হবে নমুনাজমান। নমুনাজমান হলো নমুনা বৈশিষ্ট্যের গাণিতিক পরিমাপ। ইহা কোন অজানা পরামিতি বহন করে না। এই মান যথার্থতা যাচাইয়ে (Test of hypothesis) ব্যবহৃত হয়। ইহা একটি দৈব চলক।
যেমন- ∑x₁,X অথবা ∑(x, X)' ইত্যাদি নমুনাজমান।