মানসিক প্রতিবন্ধিতার শ্রেণিবিভাগ
সাধারণতভাবে মানসিক প্রতিবন্ধিতা বলতে বোঝায় ব্যক্তির বিলম্বিত মানসিক বিকাশ। সুতরাং সঠিক সময়ে কোনো ব্যক্তির পর্যায়ক্রমিক মানসিক বিকাশ না-ঘটলে তাকে মানসিক প্রতিবন্ধী বলা হয়। আমেরিকার মানসিক প্রতিবন্ধী সমিতির মতে 'মানসিক প্রতিবন্ধিকতা হলো বিঘ্নিত ক্রমবিকাশের জন্য ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তিমূলক কাজে গড়ের চেয়ে কম দক্ষতা, যার ফলে তার উপযোজনমূলক আচরণ ব্যাহত হয়'।
মানসিক প্রতিবন্ধিতার শ্রেণিবিভাগ:
'আমেরিকান এসোসিয়েশন অব মেন্টাল ডেফিসিয়েন্সি' বুদ্ধ্যাঙ্কের ওপর ভিত্তি করে মানসিক প্রতিবন্ধিতার শ্রেণিবিভাগ করেছে। ১০০ বুদ্ধ্যাঙ্ককে সাধারণত একটি জনগোষ্ঠীর মাধ্যম বিন্দু রূপে বিবেচনা করা হয়। এবং ৯০ থেকে ১১০ বুদ্ধ্যাঙ্ককে স্বাভাবিকতার পরিধি রূপে গণ্য করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আমেরিকান সাইক্রিয়াটিক এসোসিয়েশন, আমেরিকান এসোসিয়েশন অন মেন্টাল ডেফিসিয়েন্সি প্রভৃতি সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত মানসিক প্রতিবন্ধতার শ্রেণিবিন্যাসে কিছু গরমিল পরিলক্ষিত হয়। আমেরিকান এসোসিয়েশন অব মেন্টাল ডেফিসিয়েন্সি কর্তৃক মানসিক প্রতিবন্ধিতাকে চার ভাগে ভাগ করা যায়:
১. ক্ষুদ্র মানসিক প্রতিবন্ধিতা (Mild mental retardation) ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের মধ্যে এদের বুদ্ধাঙ্কের স্তরই সর্বোচ্চ। এদের মানসিক বয়স সাধারণত ৮ থেকে ১১ বছরের মধ্যে হয় এবং এদের বুদ্ধ্যঙ্ক সাধারণত ৫২ থেকে ৬৯-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এদের সামাজিক অভিযোজন করার সামর্থ্য কিশোর-কিশোরীদের পর্যায় থেকে যায়। যেহেতু এরা নিজেদের কৃতকর্মের পরিণাম যথার্থভাবে সব সময় উপলব্ধি করতে পারে না, সেহেতু এদের কার্যকলাপ কিছুটা তত্ত্বাবধান করার প্রয়োজন থাকে। এদের মধ্যে মস্তিষ্কের রোগ-ব্যাধি বা শারীরিক কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয় না। এদেরকে 'শিক্ষা লাভের যোগ্য মানসিক প্রতিবন্ধী রূপে আখ্যায়িত করা হয়। বিশেষ পাঠ্যক্রম প্রণয়ন ও বিশেষ শিক্ষাদান পদ্ধতির মাধ্যমে এদেরকে শিক্ষিত করে তোলা যায়। প্রায় শতকরা ৭৫ ভাগ মানসিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিই এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।
২. মধ্যম মানসিক প্রতিবন্ধিতা (Moderate mental retardation) এদের মানসিক বয়স সাধারণত ৪ থেকে ৭ বছরের মধ্যে হয় এবং এদের বুদ্ধ্যাঙ্ক ৩৬ থেকে ৫১ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এদের বাকশক্তি ও শারীরিক দক্ষতার ক্ষেত্রে ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এদের বাকশক্তির কিছু উন্নতি সাধন করা যায় এবং এদেরকে কিছু কিছু পড়তে, লিখতে ও শেখানো যায়। তবে এদের শিক্ষণ প্রক্রিয়া অত্যন্ত শ্লথ ও কষ্টসাধ্য। এদের চেহারাতে কিছুটা বোকা বোকা ভাব থাকে এবং শারীরিক জড়তা ও অপটুত্ব দেখা যায়। এদের অনেকের মধ্যে শারীরিক কিছু বিকলাঙ্গতা থাকে। এদেরকে 'প্রশিক্ষণ লাভের যোগ্য' মানসিক প্রতিবন্ধী রূপে গণ্য করা হয়।
৩. গুরুতর মানসিক প্রতিবন্ধিতা (Severe mental retardation) এদের বুদ্ধ্যাঙ্ক ২০ থেকে ৩৫-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এদের মধ্যে বিকাশমূলক গুরুত্বর অস্বাভাবিক পরিলক্ষিত হয়। শারীরিক দক্ষতা ও বাক বিকাশ গুরুতরভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। অন্যের সহায়তা ব্যতীত এরা নিজেরা নিজেদের যতন নিতে পারে না এবং দৈনন্দিন সাধারণ ক্রিয়া কলাপেও এদেরকে অন্যের সাহায্য নিতে হয়। শব্দ উচ্চারণে অস্পষ্টতা থাকে। এদের মধ্যে শারীরিক বিকলাঙ্গতা ও ইন্দ্রিয়যজ্ঞের ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে। এদেরকে 'পরনির্ভরশীল প্রতিবন্ধী' বলা হয়।
৪. চরম মানসিক প্রতিবন্ধিতা (Profound mental retardation) এদের বুদ্ধ্যাঙ্ক ২০-এর নিচে হয়। জীবনধারণের জন্য নিম্নতম পর্যায়ের কার্যাবলি (যেমন খাওয়া, কাপড়-পরা, মলমূত্র ত্যাগ করা প্রভৃতি) সম্পাদন করতে ও এরা অক্ষম। সেই জন্য এদেরকে আজীবন পরাবলম্বী (Life support) মানসিক প্রতিবন্ধী বলা হয়। এরা অর্থপূর্ণ শব্দ উচ্চারণে অক্ষম হয়। কোনো কোনো সময় এরা সম্পূর্ণ রূপে মূক ও বধির হতে পারে। এদের শারীরিক বিকলাঙ্গতা, কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের রোগ ও অন্যান্য বিকাশমূলক গুরুতর অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। পারিবারিক যত্নের অভাব ও কোনো কোনো সময় এদের অকাল মৃত্যুর জন্য দায়ী হতে পারে।
উপসংহার:
সুতরাং মানসিক প্রতিবন্ধী বলতে তাদেরকেই বোঝায় যাদের বুদ্ধির মাত্রা তাদের সমবয়সি অধিকাংশ মানুষের চেয়ে কম এবং যারা অন্যের সাহায্য ছাড়া নিজেদের অনেক সমস্যাই সমাধান করতে পারে না। কম বুদ্ধির কারণে তারা পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে খাপখাইয়ে চলার জন্য উপযোগী আচরণ করতে পারে না।