অস্বভাবী আচরণের কারণসমূহ

মনোবিজ্ঞানীদের কাছে স্বভাবী ও অস্বভাবী উভয় আচরণই সমানভাবে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু একজন মনোচিকিৎসকের কাছে অস্বভাবী আচরণের গুরুত্ব অনেক বেশি। কেননা সঠিক ও উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য তাকে প্রথমেই অস্বভাবী আচরণের কারণ উদ্‌ঘাটন করতে হয়।

অস্বভাবী আচরণের কারণসমূহ: 

নিম্নে অস্বভাবী আচরণের কারণসমূহ আলোচনা করা হলো:

ক. জৈবিক বা শারীরবৃত্তীয় কারণ: 

নিম্নে অস্বভাবী আচরণের উল্লেখযোগ্য জৈবিক বা শারীরবৃত্তীয় কারণসমূহ আলোচনা করা হলো: 

১. বংশগতি: বংশগতি অস্বভাবী আচরণের অন্যতম শারীরবৃত্তীয় কারণ। বিভিন্ন মানসিক রোগের ক্ষেত্রে বংশগতির ত্রুটিগুলো সুনির্দিষ্টভাবে নির্ণয় করা সম্ভব না-হলেও বংশগতি ত্রুটি থেকে যে নানা প্রকার অস্বাভাবিতার সৃষ্টি হতে পারে এতে কোনো সন্দেহ নেই। গবেষণায় দেখা গেছে যে, মা-বাবার সিজোফ্রেনিয়া হলে সন্তানের ৪০% থেকে ৮০% সিজোফ্রেনিয়া হওয়ার আশঙ্কা থাকে। 

২. দৈহিক গঠনজনিত ত্রুটি: ব্যক্তির দৈহিক গঠনের সাথে অস্বাভাবিকতার একটি সম্পর্ক রয়েছে। জার্মান মনোচিকিৎসক আরনেস্ট ক্রেথসমার মনে করেন, মানুষের মেজাজের সাথে শারীরিক গঠনের একটি যোগসূত্র রয়েছে।

৩. শারীরিক অসুস্থতা: মানুষের শরীরের এমন কতকগুলো শারীরতত্ত্বমূলক যন্ত্রপাতি রয়েছে যেগুলোর মধ্যে কোনো ত্রুটি- বিচ্যুতি দেখা দিলে ব্যক্তির মধ্যে নানা ধরনের অস্বভাবী আচরণের সৃষ্টি হতে পারে।

৪. ক্লান্তি: অধিক পরিশ্রমের পর মানুষ ক্লান্তিবোধ করে। তাই ক্লান্তি অবসানের জন্য উপযুক্ত বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। কিন্তু পরিমিত বিশ্রামের অভাব হলে ব্যক্তির মধ্যে অস্বাভাবিকতা দেখা দিতে পারে।

খ. মনোবৃত্তীয় বা মানসিক কারণ: 

নিম্নে অস্বভাবী আচরণের মনোবৃত্তীয় কারণসমূহ আলোচনা করা হলো:

১. শৈশবে মাতৃস্নেহের বঞ্চনা: শৈশবে শিশু মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হলে তার ব্যক্তিত্বের স্বাভাবিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ বাধা সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে শৈশবে মাতৃস্নেহের বঞ্চনা শিশুর সুস্থ ব্যক্তিত্ব গঠনে বাধা দেয়। ফলে তার আচরণ অস্বভাবী হয়ে ওঠে।

২. পরিবেশগত বঞ্চনা: একটি শিশুর বিকাশের জন্য পরিবেশ থেকে তার প্রাথমিক চাহিদা মেটাতে যেসব উপাদান (অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান) পাওয়া প্রয়োজন সেগুলো থেকে বঞ্চিত হলে শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশে বাধা সৃষ্টি হয় এবং সে অস্বভাবী আচরণ শুরু করে।

৩. ত্রুটিপূর্ণ পারিবারিক কাঠামো: পারিবারিক কাঠামো শিশুর স্বাভাবিক আচরণ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ পারিবারিক কাঠামো; যেমন- প্রত্যাখ্যান, অতিরিক্ত ভালোবাসা বা শাসন, কর্তৃত্ব ও শৃঙ্খলা, ভাই-বোনদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইত্যাদি শিশুর আচরণকে অস্বভাবী করে তোলে। 

৪. ত্রুটিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব বিকাশ: সিগমুন্ড ফ্রয়েড বিশ্বাস করেন যে, একটি শিশু ব্যক্তিত্ব বিকাশের বিভিন্ন পর্যায় সুষ্ঠুভাবে অতিক্রম করতে পারলে তার ব্যক্তিত্ব সাবলীল হয়ে উঠবে। কিন্তু শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে যদি সমস্যা দেখা দেয় তাহলে পরবর্তীকালে তার আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়।

গ. সামাজিক কারণ: 

নিম্নে অস্বভাবী আচরণের সামাজিক কারণসমূহ আলোচনা করা হলো:

১. অর্থনৈতিক বৈষম্য: অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে ব্যক্তির মধ্যে অস্বভাবী আচরণ দেখা দিতে পারে। একটি দেশের সকল স্তরে একই রকম অর্থনেতিক অবস্থা বিরাজ করে না। উঁচু শ্রেণি এবং নীচ শ্রেণির মধ্যে ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্য বিদ্যমান। 

২. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট: একটি দেশের সুস্থ আচরণ বিকাশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদি কোনো কারণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয় তাহলে সংখ্যালঘিষ্ঠদের মধ্যে ভয়ভীতি, দ্বন্দ্ব, অস্থিরতা ও মানসিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। এতে নির্যাতিতদের মধ্যে অস্বভাবী আচরণ গড়ে ওঠে।

৩. বেকারত্ব: দীর্ঘদিনের বেকারত্ব অনেক ব্যক্তির আত্মমর্যাদায় মারাত্মক আঘাত হানে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাদের মধ্যে নানা ধরনের মনোবিকৃতি দেখা যায়।

৪. অসুখী দাম্পত্য জীবন: অসুখী দাম্পত্য জীবন বা দাম্পত্য কলহ মানুষের আচরণকে অস্বভাবী করে তোলে। উপরন্ত তাদের সন্তানদের আচরণও অস্বভাবী হয়।

উপসংহার: 

পরিশেষে বলা যায় যে, বিভিন্ন কারণে অস্বভাবী আচরণ সংঘটিত হয়। তবে এর অন্যতম কারণ হলো ত্রুটিমূলক বিকাশ এবং তীব্র চাপ। অস্বভাবী আচরণ ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনকে করে কলুষিত, মানুষকে ঠেলে দেয় এক অনিশ্চিত জীবনের পথে। তাই অস্বভাবী আচরণের কারণসমূহ চিহ্নিত করে এর প্রতিকার ও প্রতিরোধ করা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের নৈতিক দায়িত্ব।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url