ব্যক্তিত্ব বিকৃতি ও প্রকারভেদ
ব্যক্তিত্বের বৈকল্য হলো কতগুলো ভিন্নধর্মী বৈশিষ্ট্যের সমষ্টি; অর্থাৎ ব্যক্তিত্বের বিকৃতি বেশ কয়েক ধরনের হয়ে থাকে এবং প্রত্যেক ধরনের বিকৃতির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। নিম্নে ব্যক্তিত্বের বৈকল্য আলোচনা করা হলো-
ব্যক্তিত্বের বৈকল্য:
ব্যক্তিত্বের বৈকল্য বা বিকৃতি বলতে আচরণের অপেক্ষাকৃত দীর্ঘস্থায়ী, ব্যাপক ও অনমনীয় সংলক্ষণের সমাবেশ যা সাংস্কৃতিক ধারা অনুযায়ী প্রত্যাশিত নয় এবং যা ব্যক্তির সামাজিক ও বৃত্তিমূলক কার্যাবলিকে ব্যাহত করে।
DSM IV অনুসারে,
ব্যক্তিত্বের বৈকল্য হলো ব্যক্তির কতকগুলো বৈশিষ্ট্যের একটি সমষ্টিগত প্যাটার্নকে বোঝায়, যা সর্বক্ষেত্রে ব্যক্তির চিন্তন অনুভূতি ও আচরণকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যে, ব্যক্তি তার পরিবেশের সাথে সন্তোষজনক উপযোগ স্থাপনে ব্যর্থ হয়।
অর্থাৎ, ব্যক্তিত্বের বৈকল্যের ফলে ব্যক্তির অভিযোজন-প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। তরুণকাল বা যৌবনের প্রারম্ভ কালেই এরূপ ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে এবং তা মোটামুটি অনমনীয় ও স্থায়ী হয়ে পড়ে। এ ধরনের ব্যক্তিত্ব তার কৃষ্টি ও সামাজিক পরিবেশের সাথে সংগতিপূর্ণ হয় না। এর ফলে ব্যক্তি নিজেও অসুখী হয় এবং তার চারপাশের অন্য ব্যক্তিরাও অসুখী হয়ে ওঠে।
বিভিন্ন প্রকার ব্যক্তিত্বের বৈকল্য বা বিকৃতি:
আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন DSM IV শ্রেণি বিভাগে দশ প্রকার ব্যক্তিত্বের গোলযোগ উল্লেখ করেছে এবং কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে এই দশ প্রকার গোলযোগকে আবার তিনটি গুচ্ছ বা Cluster এ বিভক্ত করে দেখানো হয়েছে। তিনটি গুচ্ছে বিভক্ত দশ প্রকার ব্যক্তিত্বের গোলযোগ নিম্নরূপ:
ক. খামখেয়ালি গুচ্ছ (Ecentric or odd cluster):
এই গুচ্ছে তিন ধরনের ব্যক্তিত্বের বিকৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেগুলো হলো-
- প্যারানয়েড ব্যক্তিত্ব (Paranoid personality)
- সিজোয়েড ব্যক্তিত্ব (Schizoid personality)
- সিজোটাইপ্যাল ব্যক্তিত্ব (Schizolypal personality)
খ. নাটকীয় গুচ্ছ (Dramatic cluster):
- এই গুচ্ছে চার ধরনের ব্যক্তিত্বের বিকৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেগুলো হল-
- প্রাণবন্তী ব্যক্তিত্ব (Borderlinc personality)
- নাটকীয় ব্যক্তিত্ব (Histrionic personality)
- আত্মপ্রেমিক ব্যক্তিত্ব (Ivancissistic personality)
- সমাজবিরোধী ও সাইকোপ্যাথিক ব্যক্তিত্ব (Anti Social and Psychopathic personality)
গ. ভীত বা উদ্বিগ্নগুচ্ছ (Fearful or Auxious cluster):
এই গুচ্ছে তিন ধরনের ব্যক্তিত্ব-বিকৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেগুলো হলো:
- পরিহারমূলক ব্যক্তিত্ব (Avoidant personality)
- নির্ভরশীল ব্যক্তিত্ব (Dependent personality)
- বাধ্যতাধর্মী ক্রিয়ামূলক ব্যক্তিত্ব (Obsessive compulsive personality)
নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
ক. খামখেয়ালি গুচ্ছ:
এর ধরনগুলো আলোচনা করা হলো:
১. প্যারানয়েড ব্যক্তিত্ব (Paranoid Personality):
যৌবনের শুরুতেই প্যারানয়েড ব্যক্তিত্বের উৎপত্তি ঘটে। অহেতুক অন্যের প্রতি অবিশ্বাস ও সন্দেহ পোষণ করাই এই গোলযোগের মূল লক্ষণ। অন্যদের উদ্দেশ্যাবলি সব সময়ই এদের কাছে ক্ষতিকারক বলে মনে হয়। অন্যেরা তাকে শোষণ করছে তাকে ঠকাচ্ছে বা তার ক্ষতি সাধন করছে বলে এরা মনে করে। নিজের সামান্যতম অপমান অবমাননা বা ক্ষতি সাধনের বিরুদ্ধেও এরূপ ব্যক্তি ক্ষমাহীন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে না এবং কোনো দিক দিয়েই এরা কারো সাথে সমঝোতা বা আপোশ করতে পারে না। শিশুর উপর পিতামাতার প্রচণ্ড চাপ ও অযৌক্তিক শাসন পীড়নের ফলে এরূপ ব্যক্তিত্বের গোলযোগ সৃষ্টি হতে পারে। পিতামাতার এরূপ অযৌক্তিক আচরণ শিশুর মধ্যে যে আত্মবিশ্বাসহীনতা, লাঞ্ছনাবোধ ও অসহায়ত্ববোধ সৃষ্টি করে তা পরবর্তীকালে এরূপ ব্যক্তিত্বের উৎপত্তি ঘটতে পারে।
২. সিজোয়েড ব্যক্তিত্ব (Schizoid Personality):
সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিস্পৃহ হয়ে পড়া এবং সামাজিক সম্পর্ক ও ক্রিয়াকর্ম থেকে নিজেকে ব্যাপকভাবে নির্লিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন করে রাখাই এরূপ ব্যক্তিত্বের মূল বৈশিষ্ট্য। খুব কম সংখ্যক কাজের মধ্যে এরা আনন্দ লাভ করে এবং যেসব কাজ একাকী সম্পন্ন করা যায় সেগুলোই এরা বেশি পছন্দ করে। অন্যের প্রশংসা বা সমালোচনার প্রতি এরা কোনোরূপ ভ্রূক্ষেপ করে না। অপরকে অবিশ্বাস করা ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনে অস্বস্তিবোধ করা। একাকিত্ব পছন্দ করা, নিজেকে চরমভাবে অপদার্থ ভাবা, পাগল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বোধ করা প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যসমূহ এদের মধ্যে দেখা যায়।
সন্তানের প্রতি মাতাপিতার অপর্যাপ্ত মনোযোগ বা সন্তানের প্রতি শীতল ও অবহেলাপূর্ণ আচরণ শিশুদের ওপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। মানবিক সম্পর্ক সংক্রান্ত উপযুক্ত মূল্যবোধ সৃষ্টি না হওয়ার জন্যেই এরূপ ব্যক্তিত্ব উৎপত্তি হয়।
৩. সিজোটাইপ্যাল ব্যক্তিত্ব:
এ ধরনের ব্যক্তিত্ব যাদের আছে তাদের কথাবার্তা, চিন্তন, প্রত্যক্ষণ ও আচরণ বিকৃত হয়ে পড়ে। তবে তাদের এরূপ বিকৃতি সিজোফ্রেনিয়ার মতো গুরুতর হয় না। এরা উদ্ভট বিশ্বাস পোষণ করে এবং ঐন্দ্রজালিক ধ্যান-ধারণার দ্বারা পরিচলিত হয়। অন্ধ, কুসংস্কার, অলীক দৃষ্টি, টেলিপ্যাথি, ষষ্ঠেন্দ্রিয় প্রভৃতিতে বিশ্বাস করে এবং অদ্ভুত কল্পচিন্তা নিয়ে আত্মমগ্ন থাকে। এরা সন্দেহবাতিক হয়। ফলে এদের মধ্যে প্যারানয়ার মতো ভাব পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। এরূপ ব্যক্তিদের সাথে র্যাপোর্ট বা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপন করা কঠিন হয় এবং এদের সাথে অর্থপূর্ণ কথাবার্তা চালানো দুষ্কর।
খ. নাটকীয় গুচ্ছ বা খেপাটে:
এর ধরনগুলো নিম্নে বর্ণনা করা হলো-
৪. সীমান্তবর্তী ব্যক্তিত্ব:
আবেগ-অনুভূতি, বুদ্ধি-বিবেচনা ও সামাজিক পরিপক্বতার অভাবে এরা আবেগতাড়িত হয়ে আচরণ করে। ফলে এদের আচরণ প্রদর্শন করে। এদের আবেগ-অনুভূতিও দ্রুত পরিবর্তিত হয়। এদের ব্যক্তি পারস্পরিক সম্পর্ক ও আত্মধারণা ও অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। আবেগ-উত্তেজনা দমন করতে এরা ব্যর্থ হয়। ফলে তাৎক্ষণিক তাড়নার বশে হটকারী আচরণে লিপ্ত হওয়া এদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়। এ ধরনের ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যসমূহ যৌবনকালের শুরুতেই প্রকট হয়ে ওঠে।
৫. নাটকীয় ব্যক্তিত্ব:
অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হওয়া ও আবেগতাড়িত আচরণ করা এবং অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা ও সকলের মনোযোগের কেন্দ্রস্থলে থাকার চেষ্টা করাই এরূপ ব্যক্তিত্বের মূল বৈশিষ্ট্য। এদের প্রকাশিত আবেগ তীব্র ধরনের হলেও এদের আবেগে কোনোরূপ গভীরতা থাকে না। এছাড়া এদের আবেগের রূপ দ্রুত পরিবর্তনশীল হয়; যেমন- এদের তীব্র ক্রোধ দ্রুত কান্নায় পর্যবসিত হতে পারে। ব্যক্তিত্বের এরূপ গোলযোগ যৌবনকালের শুরুতেই উৎপত্তি লাভ করে।
৬. আত্মপ্রেমিক ব্যক্তিত্ব:
নিজের সম্পর্কে অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণ ধারণা পোষণ করা নিজের উচ্চ গুণ সম্পর্কিত কল্পনায় আত্মমগ্ন থাকা, নিজেকে অতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদান করা ও অন্যের নিকট থেকে সর্বদা অকুণ্ঠ প্রশংসা লাভের প্রত্যাশা করা এরূপ ব্যক্তিত্বের মূল বৈশিষ্ট্য এরা নিজেদেরকেই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি রূপে মনে করে এবং সেজন্যই এরা অন্যদের সাথে উদ্ধত ও দুর্বিনীত আচরণ করে। ব্যক্তিত্বের এই বৈশিষ্ট্যসমূহ যৌবনের প্রারম্ভকালেই প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে।
৭. সমাজবিরোধ ও সাইকোপ্যাথিক ব্যক্তিত্ব:
সাইকোপ্যাথিক ব্যক্তিত্ব-বিকৃতির কারণ অনুসন্ধান করার জন্য যেসব গবেষণা হয়েছে, যেসব অপরাধীর সাজা হয়েছে তাদের নিয়ে।
গ. উদ্বিগ্ন গুচ্ছ:
এই ধরনেরগুলো বর্ণনা নিম্নে দেওয়া হলো-
৮. পরিহারমূলক ব্যক্তিত্ব:
নিজেকে অপটুভাষা, অন্যদের উপস্থিতিতে কুণ্ঠাবোধ করা, অন্যের সম্ভাব্য সমালোচনা ও নঞর্থক মনোভাবের কথা চিন্তা করে সব সময় সঙ্কুচিত হয়ে থাকা, অন্যের সংস্পর্শ ও সাহচর্য এড়িয়ে চলা এদের ব্যক্তিত্বের মূল বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। ফলে এরা সামাজিক পরিবেশকে সর্বতোভাবে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। ব্যক্তিত্বের এরূপে বৈশিষ্ট্যসমূহ যৌবনের প্রারম্ভকালেই পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।
৯. নির্ভরশীল ব্যক্তিত্ব:
এ ধরনের ব্যক্তিরা সব সময় অন্য কারো তত্ত্বাবধানের অধীনে থেকে বেঁচে থাকতে চায়। এরা সব সময় অন্য কারো পক্ষ ছায়ায় জীবনধারণ করে। অন্যের সাহায্যে বা সহায়তা ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব নয় বলে এদের মনে হয়। সুতরাং, সব ধরনের দায়দায়িত্ব অন্য কারো ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে এরা সম্পূর্ণ নির্ভরশীল জীবনযাপন করে। এরূপ ব্যক্তি অন্য কাউকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকে এবং এই অবলম্বন হারাবার ভয়ে এরা অত্যন্ত অনুগত ও অবনত ভাব ধারণ করে। এদের মধ্যে এই পরজীবী জীবনযাপনের বৈশিষ্ট্যসমূহ যৌবনকালের শুরুতেই পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।
১০. বাধ্যতাধর্মী ক্রিয়ামূলক ব্যক্তিত্ব:
কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা অনুসরণ সব কাজেই চরম উৎকর্ষ সাধন, মানসিক প্রক্রিয়া ও ব্যক্তি পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ স্থাপন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে এরা সব সময় আত্মমগ্ন থাকে। খুঁটিনাটি কাজও এরা নির্দিষ্ট ক্রম অনুসারে নিখুঁতভাবে করতে চায়। এরূপ খুঁতখুঁতে স্বভাবের জন্যই এদের মন অত্যন্ত সংকীর্ণ ও অনুদার এবং এদের আচার-আচরণ অনমনীয় হয়ে পড়ে। ব্যক্তিত্বের এরূপ বৈশিষ্ট্য যৌবনের শুরুতেই প্রকট হয়ে ওঠে।
উপসংহার:
এছাড়াও DSM-IV শ্রেণিবিভাগে চতুর্থ আর একটি গুচ্ছ সম্ভাবতার ভিত্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এই গুচ্ছে নিষ্ক্রিয়-আগ্রাসী ব্যক্তিত্ব বৈকল্য (passive-aggressive) ও বিমর্ষ ব্যক্তিত্ব-বৈকল্য (depressive) ব্যক্তিত্ব নামে আলাদা দুটো বৈকল্যের কথা বলা হয়েছে। তবে এ দুধরনের ব্যক্তিত্বকে মূল গুচ্ছে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এ সম্পর্কে অধিকতর তথ্য সংগ্রহ করে এগুলো যাচাই করার প্রয়োজন আছে বলে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে।