ট্রমা পরবর্তী চাপমূলক বৈকল্য এর লক্ষণ ও চিকিৎসা
পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) হলো একটি মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা যা একটি আঘাতমূলক ঘটনার সম্মুখীন হওয়া বা প্রত্যক্ষ করার প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিকাশিত হয়। আঘাতমূলক ঘটনার উদাহরণগুলির মধ্যে রয়েছে যুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরিস্থিতি, যৌননিপীড়ন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ঘটনা, সন্ত্রাসী হামলা, অগ্নিকাণ্ড, চাকরিচ্যুতি, প্রিয়জনের মৃত্যু, সহিংসতা, আকস্মিক মৃত্যু প্রভৃতি। ট্রমা-পরবর্তী চাপমূলক বৈকল্য পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার হলো শারীরিক এবং মানসিক উপাদানগুলির একটি বিরূপ অবস্থা যা কোনও আঘাতমূলক ঘটনার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর লক্ষণ প্রকাশ করে। এই অবস্থাটি ঘটে যখন একজন ব্যক্তি কোনো একটি ভয়ানক ঘটনার সম্মুখীন হন বা এটি প্রত্যক্ষ করেন। PTSD-এর ফলে, ব্যক্তি সব সময় অসহায় এবং নার্ভাস বোধ করেন। আক্রান্ত ব্যক্তির উদ্বেগের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, এবং ঘুমের সমস্যা হতে পারে। এগুলোকে শেল শক সিন্ড্রোমও বলা হয়। পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের লক্ষণগুলিকে অবহেলা করা উচিত নয়। কারণ এটি স্বাভাবিক জীবন এবং রুটিনকে প্রভাবিত করতে পারে।
পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের কারণ:
PTSD হুমকি বা কোনো শারীরিক আঘাতের কারণে হতে পারে। এই ধরনের শারীরিক বা মানসিক দাগ আপনার মানসিক সুস্থতাকে প্রভাবিত করতে পারে। কিছু ঘটনা যা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার হতে পারে তার মধ্যে রয়েছে:
- যে কোনো ধরনের আঘাত শারীরিক বা মানসিক
- দুর্ঘটনা
- যৌনহয়রানি বা ধর্ষণ
- যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ
- সাইবার ক্রাইম
- যুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরিস্থিতি প্রভৃতি
- প্রিয়জনের মৃত্যু
পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের লক্ষণ:
পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার একজন ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবন এবং সুস্থতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করতে পারে। বিভিন্ন উপসর্গ দ্বারা এটিকে চিহ্নিত করা যায়। এই লক্ষণগুলি সাধারণত একটি আঘাতমূলক ঘটনার পর PTSD-এর লক্ষণগুলি দেখা দেয়। লক্ষণগুলোকে সাধারণত চারটি প্রধান গুচ্ছে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়:
১. অনধিকার প্রবেশ লক্ষণ বা যে কোনো সময় মনে আসা
- আঘাতমূলক ঘটনার স্মৃতি: আঘাতমূলক ঘটনার কষ্টদায়ক স্মৃতি প্রায়ই ফ্ল্যাশব্যাক ফিরে আসে।
- দুঃস্বপ্ন: ট্রমা-সম্পর্কিত কষ্টদায়ক স্বপ্ন বারবার ফিরে আসে।
- পুনরাবৃত্তিমূলক ফ্ল্যাশব্যাক: আঘাতমূলক ঘটনার কষ্টদায়ক স্মৃতির ফ্ল্যাশব্যাক অনেক বেশি পুনরাবৃত্তি হয়। ফলে ব্যক্তির স্বাভাবিক কর্মচাঞ্চল্য ও কর্ম-মনোযোগিতা হ্রাস পায়।
২. পরিহারমূলক লক্ষণ
- ট্রিগার এড়ানো: ব্যক্তি মানুষ, স্থান, কার্যকলাপ বা পরিস্থিতি এড়িয়ে চলে যা তাকে আঘাতমূলক ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়।
- চিন্তা ও অনুভূতি এড়িয়ে চলা: মানসিক আঘাতের সাথে জড়িত চিন্তা, অনুভূতি বা স্মৃতি দমন করার চেষ্টা করে।
- আবেগজনিত অসাড়তা: মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন ও অসাড় বোধ করা অথবা ইতিবাচক আবেগ অনুভব করার ক্ষমতা কমে যাওয়া।
৩. জ্ঞান এবং মেজাজে নেতিবাচক পরিবর্তন
- নেতিবাচক চিন্তাভাবনা: নিজের সম্পর্কে, অন্যদের সম্পর্কে এবং সার্বিক বিষয় সম্পর্কে ক্রমাগতভাবে নেতিবাচক চিন্তাভাবনা করে।
- নিজেকে দোষারোপ: নিজেকে দায়ী করা বা আঘাতমূলক ঘটনার জন্য দোষী বোধ করা, এমনকি দায়ী না-হলেও।
- মনে রাখতে অসুবিধা: বেদনাদায়ক ঘটনার কিছু দিক মনে রাখতে অসুবিধা।
- নেতিবাচক আবেগ: ভয়, রাগ, লজ্জা, অপরাধবোধ বা দুঃখের অবিরাম অনুভূতি।গ্রী - বিচ্ছিন্ন অনুভূতি: অন্যদের থেকে বা বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করা এবং কখনও কখনও স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন থাকতে দেখা যায়।
৪. উত্তেজনা এবং প্রতিক্রিয়ামূলক লক্ষণ
বিক্ষুব্ধতা: ঘন ঘন মেজাজের পরিবর্তন এবং বিরক্তি।
রাগ বিস্ফোরণ: অনিয়ন্ত্রিত রাগ বা আক্রমণাত্মক আচরণ।
মনোসংযোগে অসুবিধা: ফোকাস করতে, সিদ্ধান্ত নিতে বা কাজে মনোনিবেশ করতে সমস্যা হয়।
ঘুমের সমস্যা: অনিদ্রা, দুঃস্বপ্ন বা অন্যান্য ঘুমের ব্যাঘাত।
এই লক্ষণগুলির তীব্রতা এবং সময় পরিবর্তিত হতে পারে। এটাও মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে ট্রমাজনিত ঘটনার সম্মুখীন হওয়া প্রত্যেকের মধ্যেই PTSD বিকাশ করে না। অনেকেই আঘাতের পর তীব্র চাপের প্রতিক্রিয়া অনুভব করে, তবে সময়ের সাথে সাথে তা হ্রাস পায়। কিন্তু, যখন এই লক্ষণগুলি এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকে এবং দৈনন্দিন জীবনে উল্লেখযোগ্যভাবে উৎপাদনশীলতা ও সৃজনশীলতা হ্রাস করে, তখন PTSD-এর উপস্থিতি নির্দেশ করে।
পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের চিকিৎসা:
পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD)-এর চিকিৎসায় সাধারণত সাইকোথেরাপি, ওষুধ এবং বিভিন্ন থেরাপিউটিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। নিম্নে PTSD-এর চিকিৎসার কিছু সাধারণ পদ্ধতি আলোচনা করা হলো-
১. সাইকোথেরাপি
i. কগনিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি (CBT): CBT হলো একটি বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি যা ট্রমা-পরবর্তী নেতিবাচক চিন্তাভাবনা এবং আচরণগুলি শনাক্তকরণ এবং পরিবর্তন করার উপর ফোকাস করে। এক্সপোজার থেরাপি, CBT-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। পরিহার এবং ভয় কমাতে এক্সপোজার পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। তাছাড়া নিরাপদ এবং নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে আঘাতজনিত ঘটনার স্মৃতি প্রকাশ করে চিন্তার ভাবনার যৌক্তিতা পরিবর্তনে সহায়তা করে।
ii. আই মুভমেন্ট ডিসেনসিটাইজেশন অ্যান্ড রিপ্রসেসিং (EMDR): এই থেরাপির লক্ষ্য হলো ট্রমাজনিত স্মৃতিগুলিকে প্রক্রিয়া করা এবং পুনরায় ফ্রেম করা। এই পদ্ধতিতে ব্যক্তি আঘাতজনিত ঘটনা মনে আসলে তা থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেয়ার জন্য নির্দেশিত চোখের নড়াচড়া বা দ্বিপাক্ষিক উদ্দীপনার অন্যান্য রূপ প্রয়োগের কৌশল বর্ণনা করা হয়।
iii. দীর্ঘায়িত এক্সপোজার থেরাপি: এই পদ্ধতিতে ট্রমা-সম্পর্কিত স্মৃতি, চিন্তাভাবনা এবং পরিস্থিতির অযৌক্তিক বিশ্বাস দূর করে চিন্তাভাবনার পুনর্গঠনের চেষ্টা করা হয়।
২ . ঔষধ থেরাপি
i. সিলেকটিভ সেরোটোনিন রিউপটেক ইনহিবিটরস (SSRIs): SSRIs-এর মতো অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ, যেমন sertraline এবং paroxetine, প্রায়ই মেজাজের ব্যাঘাত, উদ্বেগ এবং অনুপ্রবেশকারী চিন্তাসহ PTSD-এর চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
ii. সেরোটোনিন-নোরেপাইনড্রাইন রিউপটেক ইনহিবিটরস (এসএনআরআই): ভেনলাফ্যাক্সিনের মতো এসএনআরআইগুলি উদ্বেগ এবং বিষণ্ণতার লক্ষণগুলিকে মোকাবেলা করতে ব্যবহার করা হয়।
৩. অন্যান্য থেরাপিউটিক পদ্ধতি
i. গ্রুপ থেরাপি: গ্রুপ থেরাপি সেশনগুলি PTSD আক্রান্ত ব্যক্তিদের তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে, মোকাবিলা করার কৌশল শিখতে এবং বিচ্ছিন্নতা অনুভূতি কমাতে একটি সহায়ক পরিবেশ প্রদান করে।
ii. মাইনফুলনেস এবং রিলাক্সেশন টেকনিক: মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস এবং পেশি শিথিলকরণ প্রভৃতি কৌশল ব্যক্তিদের উদ্বেগ এবং চাপ কমাতে সাহায্য করে।
৪. লাইফস্টাইল পরিবর্তন
i. শরীরচর্চা: নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম ব্যক্তির উদ্বেগ, বিষণ্ণতা ও চাপ কমাতে সাহায্য করে।
ii. স্বাস্থ্যকর ডায়েট: পুষ্টি সমৃদ্ধ সুষম খাদ্য মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামগ্রিক সুস্থতায় অবদান রাখতে পারে।
iii. পর্যাপ্ত ঘুম: ভালো ঘুমের অভ্যাস স্থাপন করা মেজাজ নিয়ন্ত্রণের অত্যাবশ্যক যা হাইপাররাউসালের লক্ষণগুলি কমাতে পারে।
উপসংহার: আলোচনা পরিশেষে বলা যায় যে, সমস্ত চিকিৎসা প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য সমানভাবে কার্যকর হবে না। PTSD লক্ষণ প্রকাশ পেলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসাকের শরণাপন্ন হতে হবে; কোনোভাবে অবহেলা করা যাবে না।