সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসা পদ্ধতি

সিজোফ্রেনিয়া একটি জটিল মানসিক ব্যাধি, যার লক্ষণগুলো অদ্ভুত ও ভীতিজনক। তাই এর চিকিৎসা বেশ কঠিন। অতীতে এ রোগের কোনো কার্যকর চিকিৎসাব্যবস্থা ছিল না। তবে সাম্প্রতিককালে এ রোগের উল্লেখযোগ্য চিকিৎসা-পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসা করা যায়; যেমন—

১. জৈবিক চিকিৎসা-পদ্ধতি: 

জৈবিক চিকিৎসা-পদ্ধতির মাধ্যমে সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসা করা যায়। এ পদ্ধতিতে দুভাবে চিকিৎসা করা যায; যথা:

ক. আঘাতমূলক চিকিৎসা: বর্তমান শতকের প্রথমদিকে আঘাতমূলক চিকিৎসা-ব্যবস্থার উদ্ভব হয়। ১৯৩০-এর দশকের প্রথমদিকে মনোবিজ্ঞানী সেকেল সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের লক্ষণগুলো দূর করার জন্য বেশি মাত্রায় ইনস্যুলিন ইঞ্জেকশন দিয়ে রোগীকে অজ্ঞান করতেন। এ চিকিৎসার নাম ছিল ইনস্যুলিন কমা থেরাপি বা আঘাতমূলক চিকিৎসা। এ পদ্ধতির মাধ্যমে মনোবিদ সেকেল প্রায় তিন-চতুর্থাংশ সিজোফ্রেনিয়ার রোগীকে নিরাময় করতে সক্ষম হন। কিন্তু পরবর্তীকালে অন্য গবেষকগণ এ চিকিৎসায় এত ভালো ফলাফল লক্ষ করেননি। এছাড়া আঘাতমূলক চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরনের মারাত্মক স্বাস্থ্যসমস্যার ঝুঁকি থাকত বলে এ পদ্ধতির প্রয়োগ দিন দিন হ্রাস পেতে থাকে।

খ. সাইকোসার্জারি: প্রখ্যাত পর্তুগিজ সাইকিয়াট্রিস্ট মোনিজ ১৯৩৫ সালে সর্বপ্রথম সম্মুখ মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করে সিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের চিকিৎসা শুরু করেন। এ পদ্ধতিকে প্রি-ফ্রন্টাল লোবোটমি বলে। এ পদ্ধতিতে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মস্তিষ্কের সম্মুখভাগ থেকে হাইপোথ্যালামাস পর্যন্ত স্নায়বিক পথটিকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ফলে মস্তিষ্কের সম্মুখভাগে উদ্ভূত বিপজ্জনক চিন্তার বিনাশ ঘটে। এ পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে মোনিজ উচ্চ সাফল্যের দাবি করেছিলেন। এরপর এ পদ্ধতির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয় এবং অনেক রোগী এ চিকিৎসায় আরোগ্য লাভ করে। কিন্তু ১৯৫০ সালের দিকে এ চিকিৎসার বেশ কিছু কুফল মানুষের নজরে আসতে শুরু করে; যেমন- অস্ত্রোপচারের ফলে অনেক রোগী আবেগীয়ভাবে ভোঁতা হয়ে যেত এবং অস্থির আচরণ করত। এছাড়া তাদের জ্ঞানীয় প্রক্রিয়ারও অবনতি ঘটত। এসব কুফলের কারণে এ চিকিৎসাব্যবস্থার জনপ্রিয়তা দিন দিন কমতে থাকে।

২. ভেষজ চিকিৎসা-পদ্ধতি: 

ভেষজ চিকিৎসা-পদ্ধতির মাধ্যমে সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসা করা যায়। ১৯৫০ সালের দিকে এ রোগের চিকিৎসায় কতকগুলো ওষুধ আবিষ্কৃত হয় যেগুলোকে এন্টিসাইকোটিক ওষুধ বা সাইকোসিস বিরোধী ওষুধ বলা হয়। এসব ওষুধ হলো ফেনোথিয়াজিন, কার্পোন্টিয়ার, ক্লোজারিল, রিসপেরিডাল প্রভৃতি। ১৯৫৪ সালে আমেরিকায় সর্বপ্রথম এ রোগের চিকিৎসায় ক্লোরপ্রোমাজিন নামক ওষুধ আবিষ্কৃত হয়। ১৯৭০ সালে আমেরিকান হাসপাতালগুলোতে ৮৫%-এর বেশি মানসিক রোগীকে ক্লোরপ্রোমাজিন বা অন্য কোনো ফেনোথিয়াজিনের সাহায্যে চিকিৎসা করা হয়েছিল। এরপরে আরো সাইকোসিস বিরোধী ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। এদের মধ্যে বিউটাইরোফেনোন যা হেলোপেরিডল বা হেলডল নামে বাজারজাত করা হয়েছে। আরেকটি ওষুধ হলো থাইওজেনথিন যা নাভানে বা টারাকটান নামে বাজারজাত করা হয়। এ দুটি ওষুধ ফেনোথিয়াজিনের মতো কার্যকর। তবে এ শ্রেণির ওষুধগুলো সিজোফ্রেনিয়ার ইতিবাচক লক্ষণগুলো কমাতে পারলেও নেতিবাচক লক্ষণগুলো দূরীকরণে ততটা কার্যকর নয়।

সাম্প্রতিককালে আবিষ্কৃত ক্লোজপিন যা ক্লোজারিল নামে এবং রিসপেরিডোন যা রিসপেরিডাল নামে বাজারজাত করা হচ্ছে-এ দুটি ওষুধ সিজোফ্রেনিয়ার খুব কার্যকরী বলে প্রমাণ হয়েছে। বিশেষ করে যেসব ক্ষেত্রে ফেনেথিয়াজিন ব্যর্থ হয় সেসব ক্ষেত্রে এ দুটি ওষুধের যেকোনো একটি প্রয়োগ করা হয়। এ ওষুধ দুটি অন্যান্য ওষুধের তুলনায় কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং বেশি সংখ্যক নেতিবাচক লক্ষণ দূর করে। সম্প্রতি আমেরিকায় ওলানজাপিন নামে একটি ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে যা জাইপ্লেক্সা নামে বাজারজাত করা হয়েছে। এ ওষুধটি অনেকগুলো বার্তাবাহকের উপর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে ক্রিয়া প্রদর্শন করে এবং এর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার পরিমাণও কম। মানসিক রোগবিশেষজ্ঞদের মতে, সাইকোসিস বিরোধী ওষুধগুলোর পার্শ্ব- প্রতিক্রিয়া থাকা সত্ত্বেও আরো দীর্ঘদিন পর্যন্ত চিকিৎসকগণকে এগুলোর উপর নির্ভরশীল থাকতে হবে। তবে আশা করা হচ্ছে অচিরেই আরো উন্নতমানের ওষুধ আবিষ্কৃত হবে। আর নতুন ওষুধ আবিষ্কৃত হলে সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসা আরো সহজতর হয়ে উঠবে।

৩. মনঃসমীক্ষণ চিকিৎসা-পদ্ধতি: 

মনঃসমীক্ষণতত্ত্বের সমর্থকরা সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসায় মনঃসমীক্ষণ-পদ্ধতির কথা বলেছেন। প্রখ্যাত আমেরিকান সাইকিয়াট্রিস্ট হ্যারি স্ট্যাক সুলিভান সর্বপ্রথম হাসপাতালে সিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের উপর মনঃসমীক্ষণ পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। তিনি ১৯২৩ সালে মেরিল্যান্ডের টাইসন শহরের এক হাসপাতালে সিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের জন্য একটি ওয়ার্ড প্রতিষ্ঠা করেন এবং মনঃসমীক্ষণ-পদ্ধতির বিকাশ সাধন করেন। তিনি সিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের সম্পর্কে বলেন যে, এদের আচরণ হলো শৈশবের কথাবার্তায় ফিরে যাওয়ার প্রতিফলন। এরা ভঙ্গুর অহংসত্তা, সামাজিক সম্পর্কের কঠিন সমস্যাগুলো সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে না পেরে শৈশবের জীবনে প্রত্যাবর্তন করেন। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সুলিভান মনঃসমীক্ষণ-পদ্ধতির সাহায্যে রোগীকে প্রাপ্তবয়স্কদের উপযোগী পারস্পরিক যোগাযোগ প্রক্রিয়ার কৌশল শিখিয়ে দেন এবং অতীত জীবনের যেসব সমস্যা তার বর্তমান সমস্যা সৃষ্টির কারণ হয়েছে সেগুলো সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি লাভে সহায়তা করা। এছাড়া রোগীর সাথে চিকিৎসকের বিশ্বস্ত সম্পর্ক গড়ে তোলার উপর তিনি অধিক গুরুত্বারোপ করেন। এতে রোগীর সাথে চিকিৎসকের পারস্পরিক আস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে চিকিৎসক তার সামাজিক বা পারস্পরিক সম্পর্কগুলো পরীক্ষা করতে উৎসাহ দেন। এভাবে সুলিভান সিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের উপর মনঃসমীক্ষণ-পদ্ধতি সফলভাবে প্রয়োগ করেন এবং এতে তিনি যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেন।

আরেকজন জার্মান সাইকিয়াট্রিক ফ্রেইডা-ফ্রম রাইখম্যান মনঃসমীক্ষণমূলক পদ্ধতির সাহায্যে সিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের চিকিৎসা করেন। রাইখম্যান আচরণের অবচেতন ও প্রতীকী অর্থ সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। তিনি মনে করতেন শিশুরা শৈশবে যে শাস্তি বা সমালোচনার শিকার হয় পরবর্তীকালে সেসব কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি করে। এসব অভিজ্ঞতা যাতে শিশুর জীবনে পুনরাবৃত্তি না ঘটে তিনি সেই চেষ্টাই করেন। তিনি সিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের অতিশয় ধৈর্য ও আশাবাদের মাধ্যমে চিকিৎসা করতেন। সুলিভানের সহযোগিতায় ফ্রম রাইখম্যান একটি নতুন ধরনের মনঃসমীক্ষণ পদ্ধতি প্রণয়নে সক্ষম হন যা সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসায় প্রয়োগ করা যায়। তবে মনঃসমীক্ষণ পদ্ধতির সফলতা সম্পর্কে অনেক গবেষক ভিন্নমত পোষণ করেন; যেমন- মনোবিদ ফেইনসিলভার ও গুন্ডারসন এবং স্টান্টন ও অন্যরা এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসায় সামগ্রিকভাবে মনঃসমীক্ষণ পদ্ধতি খুব বেমি সফল নয়। ১৯৬৩-'৭৬ সাল পর্যন্ত এ পদ্ধতিতে যাদের চিকিৎসা করা হয়েছিল তাদের উপর গবেষণা করে মনোবিদ স্টোন বলেন, এসব রোগী ভালো হয় নি। তিনি মনে করেন যে, নিজ সমস্যাগুলোর প্রতি মনঃসমীক্ষণমূলক অন্তর্দৃষ্টির উদয় হলে সিজোফ্রেনিয়কদের সমস্যার অবনতি ঘটে।

৪. পারিবারিক চিকিৎসা-পদ্ধতি: 

পারিবারিক চিকিৎসা-পদ্ধতির মাধ্যমেও সিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের চিকিৎসা করা যায়। সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোচিকিৎসকবৃন্দ সর্বপ্রথম এ ধরনের চিকিৎসা-পদ্ধতির কথা বলেন। এ পদ্ধতিতে চিকিৎসকগণ পরিবারের সকল সদস্যকে নিয়ে বসতেন এ উদ্দেশ্যে যে, তারা যাতে তাদের ধনাত্মক ও ঋণাত্মক অনুভূতিগুলোকে কারো প্রতি আঘাত ও সমালোচনা না করে, অতি রক্ষণ না করে এবং জোরালোভাবে কোনো বক্তব্য কারো প্রতি দাবি না করে প্রকাশ করতে পারে। এছাড়া তারা যাতে শিখতে পারে, কীভাবে দ্বন্দ্বের ফলে সৃষ্ট উত্তেজনাকে শনাক্ত করা যায়, ব্যক্তিগত সমস্যাকে সকলে মিলে কীভাবে সমাধান করা যায়। চিকিৎসকবৃন্দ পরিবারের সদস্যদের বোঝাতেন যে সিজোফ্রেনিয়া এমন একটি রোগ যা ঠিকমতো ওষুধ খেলে এবং চিকিৎসকদের নির্দেশমতো আচরণ করলে, রোগী সুস্থ হতে পারে। এভাবে সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসায় পারিবারিক চিকিৎসা-পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে ব্যাপক সাফল্য লক্ষ করা যায়। 

৫. আচরণ চিকিৎসা-পদ্ধতি: 

সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসায় এ পদ্ধতির কার্যকর ভূমিকা রয়েছে। সাইকোসিস বিরোধী ওষুধগুলোর ব্যাপক ব্যবহারের ফলে অনেক রোগী হাসপাতাল থেকে বাড়িতে চলে আসে। কিন্তু বাড়িতে এসে এসব রোগীর বাইরের জগতের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে যথেষ্ট কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়। এরূপ ক্ষেত্রে আচরণ কৌশলগুলো অর্জনের জন্য আচরণ চিকিৎসা-পদ্ধতি কার্যকরী। আচরণ চিকিৎসা-পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হয়-বিভিন্ন ধরনের সামাজিক পরিস্থিতিতে কীভাবে আচরণ করতে হবে এবং দৈনন্দিন সামাজিক পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ায় কীভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত যেসব রোগী সামাজিক অভিযোজনের সমস্যায় ভোগে তাদের সামাজিক অভিযোজনের উন্নতিতে আচরণ চিকিৎসা-পদ্ধতি অনেক বেশি কার্যকরী।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সিজোফ্রেনিয়া একটি জটিল মানসিক রোগ। এ রোগের চিকিৎসায় উল্লিখিত ৫টি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি চিকিৎসা-পদ্ধতির কিছু ইতিবাচক ও কিছু নেতিবাচক দিক রয়েছে। তবে কোনো পদ্ধতিই এ রোগের চিকিৎসায় পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য নয়। তাই সিজোফ্রেনিয়ার আধুনিক চিকিৎসায় ভেষজ পদ্ধতি ও মানসিক পদ্ধতি যৌথভাবে ব্যবহার করা হয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url