অস্বভাবী আচরণের মনোসামাজিক কারণসমূহ

অস্বভাবী আচরণের প্রকৃতি যেমন বিভিন্ন ধরনের হতে পারে তেমনই অস্বভাবী আচরণের কারণও বিভিন্ন প্রকৃতির হতে পারে। অস্বভাবী আচরণকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করার জন্য মনোচিকিৎসকরা অস্বভাবী আচরণকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করেছেন। 

এগুলো হলো—

১) শারীরবৃত্তীয় কারণ, 

২) মনোবৃত্তীয় কারণ এবং 

৩) সামাজিক কারণ। 

নিম্নে অস্বভাবী আচরণের মনোবৈজ্ঞানিক ও সামাজিক কারণসমূহ আলোচনা করা হলো—

মনোবৈজ্ঞানিক কারণ: 

অস্বভাবী আচরণের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো মনোবৃত্তীয় কারণ। যেসব কারণ থাকলে ব্যক্তির মধ্যে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাবোধ থাকে না, স্বাবলম্বী হতে পারে না, আত্মমর্যাদা ও অহংবোধ গড়ে ওঠে না, স্নেহ ও সামাজিক সম্পর্কের অবনতি দেখা যায়, সর্বোপরি মানসিক বিকাশ অপূর্ণ থেকে যায়, সেসব কারণই মনোবৃত্তীয় কারণের অন্তর্ভুক্ত। নিচে মনোবৃত্তীয় কারণসমূহ আলোচনা করা হলো:

১. মাতৃস্নেহের বঞ্চনা: 

মায়ের স্নেহের পরশ শিশুর ব্যক্তিত্বের বিকাশে যথেষ্ট সহায়তা করে থাকে। মায়ের স্নেহে লালিত-পালিত এবং হোস্টেলে বিকাশপ্রাপ্ত শিশুদের ভেতর তুলনা করে ইয়ারো (Yarrow, 1961) দেখেন যে, প্রথম দলের শিশুদের ব্যক্তিদের বিকাশ সুষ্ঠু ও সুন্দর হয়েছে। তাদের আবেগে, প্রত্যক্ষণে, বুদ্ধিবৃত্তীয় ও সামাজিক কাজে উন্নতি দ্রুত এবং কার্যকর হয়েছে। পক্ষান্তরে হোস্টেলের অনেক শিশুদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের বিকাশ নানারকম অস্বভাবিতা দেখা গেছে। তাদের আচরণে অনেকখানি মানসিক বিকাশে মন্দগতি শিশুদের আচরণের মতো।

২. ত্রুটিপূর্ণ পারিবারিক কাঠামো: 

শিশুর উপর পরিবারের প্রভাব সবচেয়ে গভীর ও ব্যাপক। পরিবারের মধ্যে যে মান (norm) নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, সেই মান অনুযায়ী শিশু বিভিন্ন সামাজিক কৌশল ও আচরণ শিখে থাকে। বাবা-মা'র অনুমোদনই তার কাজকর্মের ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রভাবশালী শক্তিরূপে কাজ করে থাকে এবং তার ব্যক্তিত্বের বিকাশের ক্ষেত্রে একটি প্রধান শক্তিশালী নির্ধারক হয়ে দাঁড়ায়। এ সময়ে তার মধ্যে যেসব মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা দেখা দেয় সেগুলো পরবর্তী জীবনে তার সামাজিক সম্পর্ক ও প্রতিক্রিয়াগুলোকে নিয়ন্ত্রিত করে থাকে। অস্বভাবী আচরণের জন্য যেসব মনোবৃত্তীয় কারণ দায়ী এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, পিতামাতার সাথে শিশুর সম্পর্ক, কর্তৃত্ব ও শৃঙ্খলা, যৌনবিকাশ, আক্রমণধর্মিতা ও শত্রুতা, ভাইবোনদের সাথে সম্পর্ক ও অন্যান্য আঘাতাত্মক অভিজ্ঞতা। নিচে এসব সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো:

i. প্রত্যাখ্যান (Rejection): শিশুর সাথে মা-বাবার সম্পর্ক যদি সুসংগত ও আন্তরিক না-হয় তাহলে শিশুর ব্যক্তিত্বের বিকাশ বিশেষভাবে ব্যাহত হতে পারে। মা-বাবার সাথে শিশুর সম্পর্ক নানাদিক দিয়ে বিকৃত হতে পারে, যেমন- প্রত্যাখ্যান, অতিরিক্ত সংরক্ষণ বা শাসন, অতিরিক্ত ভালোবাসা ইত্যাদি। এসবের মধ্যে পিতামাতা কর্তৃক শিশুর প্রত্যাখ্যান খুবই গুরুতর একটি কারণ। মা-বাবা যদি শিশুকে অবহেলা করেন এবং তাদের স্নেহ-ভালোবাসা থেকে তাকে বঞ্চিত করে তাহলে তার মধ্যে নিরাপত্তার অভাব ও অপসংগতি দেখা দেয় এবং পরবর্তী জীবনে তার মধ্যে অস্বভাবী আচরণের সৃষ্টি করে। মা-বাবার প্রত্যাখ্যান থেকে শিশুর মধ্যে অতিরিক্ত আত্মকেন্দ্রিকতা, আক্রমণধর্মিতা ইত্যাদি নানারকম অবাঞ্ছিত ও সমস্যামূলক আচরণ দেখা দিয়ে থাকে।

ii. অতিরিক্ত সংরক্ষণ বা অতিরিক্ত ভালোবাসা: অতিরিক্ত সংরক্ষণ বা অতিরিক্ত ভালোবাসা শিশুর মধ্যে অস্বভাবী আচরণের কারণ হতে পারে। যদি শিশুর সব আবদার বা চাহিদা নির্বিচারে মেনে নেওয়া হয় বা তাকে অতিরিক্ত নিয়মকানুনের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আগলে রাখা হয় তাহলে শিশুর ব্যক্তিত্বের বিকাশও স্বাস্থ্যসম্মত হয়ে ওঠে না। শিশুকে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দিলে বা সবসময় সংরক্ষিত করে রাখলে শিশু বাস্তব জগতের বিভিন্ন জটিল শক্তির সাথে সংগতিবিধান করতে সক্ষম হয় না এবং বাস্তবের সম্মুখীন হবার জন্য তৈরি হয়ে ওঠে না। অতিরিক্ত সংরক্ষিত ছেলেমেয়ে বশ্যতাধর্মী কিংবা আক্রমণধর্মী, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও নিরাপত্তাহীন ব্যক্তি হয়ে বড় হয়ে ওঠে।

iii. ভাইবোনদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা: নিজের ভাইবোনদের মধ্যে সম্পর্কের উপরও শিশুর আচরণের স্বাভাবিকতা নির্ভর করে। ভাইবোনদের সাথে শিশুর সম্পর্ক নির্ভর করছে মা-বাবার ভালোবাসাকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার ব্যাপারে শিশু কতটা মানিয়ে নিতে সমর্থ হয়েছে তার উপর। যদি এক্ষেত্রে শিশু অতিরিক্ত মাত্রায় ঈর্ষাপরায়ণ ও শত্রুভাবাপন্ন হয়ে ওঠে তাহলে তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ বিকৃত হয় এবং তার মধ্যে নানারকম অস্বভাবী আচরণের সৃষ্টি হয়।

iv. দাম্পত্য কলহ: দাম্পত্য কলহ বা বিপর্যস্ত পরিবার (Broken home) শিশুর অস্বভাবী আচরণ সৃষ্টির একটি বড়ো কারণ। শিশু যে পরিবারে মানুষ হয় সে পরিবার যদি সুসংহত না-হয় তাহলে শিশুর ব্যক্তিত্বের বিকাশও সুষ্ঠু ও সুষম হয়ে উঠতে পারে না। মা-বাবার স্নেহ ও মনোযোগ শিশুর সুষ্ঠু মানসিক সংগঠনের জন্য বিশেষ দরকার। যে পরিবারে বাবা ও মায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা বিচ্ছেদ দেখা দেয় সে পরিবারে শিশুর আবেগমূলক বিকাশ বিশেষভাবে ব্যাহত হয় এবং পরবর্তী জীবনে নানারকম অস্বভাবী আচরণ সৃষ্টি করে।

V. কর্তৃত্ব ও শৃঙ্খলা : কর্তৃত্ব ও শৃঙ্খলাকে মানতে শেখা শিশুর সামাজিক বিকাশের একটি বড়ো অঙ্গ। প্রথম জীবনে শিশু নিতান্ত আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর থাকে। সে নিজের প্রয়োজন ও তার পরিতৃপ্তি ছাড়া আর কিছুই জানে না। কিন্তু একটু বড়ো হলেই তাকে পরিবেশের দাবি অনুযায়ী তার ইচ্ছা প্রয়োজনকে কিছু কিছু মাত্রায় ত্যাগ করতে হয়। এ থেকেই সে কর্তৃত্ব ও শৃঙ্খলা মানতে শেখে এবং তার সামাজিকরণের শিক্ষা শুরু হয়। শিশুর উপর এই কর্তৃত্ব ও শৃঙ্খলার আরোপ খুব বিবেচনার সাথে করা দরকার।  যদি শৃঙ্খলার মান শিশুর আয়ত্তাতীত হয় অথবা কর্তৃত্ব অতিরিক্ত কঠোর হয়ে ওঠে তাহলে শিশুর মধ্যে অতিরিক্ত বশ্যতা বা বিদ্রোহের মনোভাব দেখা যায়। আবার যদি কর্তৃত্ব অত্যন্ত দুর্বল হয় বা শৃঙ্খলার মান যদি খুব নিচু হয় তাহলে শিশু ব্যর্থতাকে সহ্য করতে বা মেনে নিতে শেখে না এবং পরবর্তীকালে পরিবেশের সাথে সংগতিবিধান করতে সক্ষম হবে না।

৩. শৈশবের মানসিক আঘাত (Psychic traumas):  

বাল্যকালে শিশু নানাভাবে এমন সব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারে যেগুলো তার ব্যক্তিত্বের বিকাশকে বিশেষভাবে ব্যাহত করতে পারে। দৈনন্দিন ব্যাপারে মা-বাবা বা অন্যান্য বয়স্ক ব্যক্তির আচরণ, স্কুলে বা অন্য কোনো পরিবেশে শিশু যদি এমন কোনো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয় যা তার মনে কোনো গভীর আবেগধর্মী ছাপ রেখে যায়, তাহলে সে অভিজ্ঞতা তার ব্যক্তিত্বের বিকাশকে গুরুতরভাবে ব্যাহত করে তোলে এবং পরিণত বয়সে তার মধ্যে নানা ধরনের বিকৃতি দেখা দেয়।

৪. যৌনবিকাশ (Sexual development): 

যৌনবিকাশও শিশুর ব্যক্তিত্বের বিকাশকে প্রভাবিত করে থাকে। এসময় শিশু তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চিনতে শেখে এবং তা থেকেই তার মধ্যে বিভিন্ন যৌনবিষয় সম্বন্ধে সচেতনতার সৃষ্টি হয়। শিশুদের এই যৌন-সচেতনতার উন্মেষকে মা-বাবারা কীভাবে নেন এবং তার প্রতি এ ব্যাপারে কী ধরনের আচরণ করেন তার দ্বারা শিশুর ভবিষ্যৎ যৌনবিকাশের প্রকৃত স্বরূপ নির্ধারণ হয়ে থাকে। শিশুর যৌন-কৌতূহল সম্পর্কে মা-বাবার প্রতিক্রিয়া যদি উদার ও প্রগতিশীল হয় তাহলে শিশু যৌন-বিষয় সম্পর্কে বলিষ্ঠ মনোভাব গড়ে তুলতে পারে এবং নির্ভুল জ্ঞান সঞ্চয় করতে পারে। পক্ষান্তরে, মা-বাবার প্রতিক্রিয়া এক্ষেত্রে যদি অনুদার ও সংকীর্ণ হয় তাহলে যৌনবিষয় সম্পর্কে শিশুরও মনোভাব গোপনতাধর্মী ও বিকৃত হয়ে ওঠে এবং এ সম্বন্ধে তার অর্জিত জ্ঞানও ত্রুটিপূর্ণ এং অসম্পূর্ণ থেকে যায়

৫. জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যর্থতা: 

শিক্ষায়তনে, সমাজজীবনে, যৌনজীবনে, কর্মজীবনে, ধর্মজীবনে ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যর্থতাও অস্বভাবী আচরণের কারণ হতে পারে। শিক্ষায়তনে অসফলতার কারণ বুদ্ধির হ্রস্বতা, বিষয় নির্বাচনের ভ্রান্তি, পড়াশোনার অবহেলা বা অসুবিধা। সমাজজীবনে অসফলতা অর্থাৎ নিজের পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের কাছে নিজেকে ভালোভাবে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে না-পারা বা আকাঙ্ক্ষিত পদমর্যাদা লাভের অভাব।

যৌনজীবনের অসফলতা দেখা দেয় স্বামী বা স্ত্রীর যৌন-অক্ষমতায়, অর্থাৎ কামশীতলতা বা পুরুষত্বহানিতে অথবা বন্ধ্যাত্বে। কর্মজীবনের অসফলতা আসতে পারে নানাদিক থেকে। কর্ম, বৃত্তি বা পেশা নির্বাচনের ত্রুটিতে, কর্মস্থলে বা বৃত্তিতে উন্নতির সুবিধার অভাবে, কর্মের নিরাপত্তাবোধের অভাবে, অথবা কর্মসন্তুষ্টির (Job-satisfaction) অভাব হলে।

মানুষ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাফল্য আকাঙ্ক্ষা করে। সফলতাই এনে দেয় মানুষের মনে আনন্দ, আত্মবিশ্বাস ও পূর্ণতা। অসফলতা সৃষ্টি করে সমাজজীবনের তাচ্ছিল্য, উপহাস, অপমানবোধ ও মানসিক আঘাত। ব্যক্তিগত জীবনে আনে হীনম্মন্যতা, দুঃখবোধ, ব্যথা, আত্মবিশ্বাসের অভাব। এদের শেষ ফল হলো মনোবিকৃতি।

৬. অন্তর্দ্বন্দ (Conflict): 

যখন দুটি বিপরীতমুখী ইচ্ছা, কামনা বা আকাঙ্ক্ষা একই সময়ে সমভাবে পূর্ণতা পাবার চেষ্টা পায় তখনই ৬ মনের ভেতর দেখা দেয় অন্তর্দ্বন্দ্ব। এই অন্তর্দ্বন্দ্বের যেখানে সমাধান সম্ভব হয় না, সেখানে দেখা দেয় মানসিক অসংগতি বা মানসিক রোগ। যে পার্থিব লাভের ইচ্ছার সাথে অধিসত্তার (Super Ego) অন্তর্দ্বন্দ্ব। যেমন দেখা যায় কালোবাজারি ঘুসখোরদের জীবনের অন্তর্দ্বন্দ্ব, পাপবোধ ও মানসিক অশান্তি।

সামাজিক কারণ (Social Cause): 

সুস্থ বহমান সামাজিক পরিবেশের সাথে অসংগতি ও অসামঞ্জস্য দেখা যায় নিম্নবিত্ত মানুষদের মধ্যে যারা বাস্তুহারা, যারা বস্তিতে মানুষ হয়। এরা স্বাভাবিকভাবে সমাজ ও কৃষ্টির সাধারণ যে স্রোত বয়ে যায় তার থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হয়। শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে এদের সুযোগ-সুবিধাও সীমিত। এদের জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনাও কম। সমাজে যারা সুপ্রতিষ্ঠিত এরা তাদের হিংসা করে, তাদের অকল্যাণ কামনা করে। জীবনের অনেক সুখ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত, এরা হয়ে দাঁড়ায় সমাজবিরোধী বা মানসিক রোগী। সমাজে অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা, অনিশ্চয়তা বা বিপ্লব দেখা দিলে জনজীবনে মানসিক অশান্তি, দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা দেখা যায়, যার ফলে মানসিক অসংগতি ও অসামঞ্জস্য বেড়ে চলে।

সমাজজীবনে ব্যক্তিত্বের বিকাশে কীরূপ বাধা সৃষ্টি হতে পারে এবং কী ধরনের অস্বভাবী আচরণের উদ্ভব হতে পারে তা নিচে আলোচনা করা হলো:

১. দারিদ্র্য: 

দারিদ্র্যের সংসারে মানুষ হওয়া এক অভিশাপ, তার কারণ বাবা বেকার হলে, তার নিজের যেমন আত্মসম্মানের অভাব হয়, তেমন তার প্রতিফলন হয় সমস্ত পরিবারে। সমস্ত পারিবারিক পরিবেশকে এ বিষয় বিষিয়ে তোলে। জীবনের মান আস্তে আস্তে নেমে যেতে থাকে, তার ফলে এসব পরিবারের ছেলেমেয়েদের মানসিক প্রসার ব্যাহত হয়। তারা নিজেদে ভেতর নিজেরা গুটিয়ে যেতে থাকে, আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। পরে এরা হয়ত সিজোফ্রেনিয়া রোগে ভোগে। দরিদ্র পিতামাতার পক্ষে বেড়ে ওঠা সন্তানদের দৈহিক সবরকম চাহিদা মেটানো যেমন কষ্টসাধ্য, তেমনি তাদের মানসিক চাহিদা

মেটানোও অসম্ভব হয়ে পড়ে। জীবনযুদ্ধে এরা স্বাবাবিকভাবে পিছিয়ে পড়ে এবং ভবিষ্যতে মানসিক রোগের শিকার হয়।

২. উপজাতি (Race):

 প্রত্যেক জাতির মধ্যে কমবেশি মানসিক রোগ দেখা যায়। তবে বিশেষ কোনো উপজাতির সদস্যদের মধ্যে অস্বভাবী আচরণের সম্ভাবনা বেশি দেখা যায়; যেমন, আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে নিগ্রোদের ভেতরই বেশি মনোবিকৃতি দেখা যায়। তেমনি পশ্চিম এশিয়ায় মুসলমানদের চেয়ে ইহুদিদের মধ্যে মনোবিকৃতির প্রাবল্য বেশি। পাশ্চাত্য দেশগুলোতে মানসিক রোগ অপেক্ষাকৃত বেশি। সম্ভবত তাদের দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থা, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক জীবন, মূল্যবোধের ক্ষয়িষ্ণুতা ও বস্তুকেন্দ্রিক দর্শন (Materialistic Philosophy) এর জন্য দায়ী। ধীরে ধীরে উন্নতশীল ও উন্নয়নকামী দেশগুলো পাশ্চাত্যের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হওয়ার ফলে এসব দেশেও মানসিক রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। জন্মগতভাবে সব দেশের মানুষই সমান, তবে পরিবেশ ও কৃষ্টির বিভিন্নতাই এই তারতম্যের মূলে আছে বলে মনে করা হয়।

৩. যুদ্ধ: 

যুদ্ধমূলক পরিবেশে মানসিক অসুস্থতা ঘটার সবচেয়ে বড়ো কারণ হলো যে সাধারণ অসামরিক জীবনে যে ধরনের নিরাপত্তা ও স্বস্তির বোধ মানুষ ভোগ করে থাকে, যুদ্ধক্ষেত্রে তা একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। তার উপর মৃত্যু বা আঘাত প্রাপ্তির প্রতিনিয়ত ভয়, ক্রমবর্ধমান দুশ্চিন্তা ইত্যাদি মিলে ব্যক্তির আবেগমূলক সংগঠনটিকে একেবারে বিপর্যস্ত করে দেয় এবং তার মধ্যে অসহায়তা, অনিয়মতা, নিরাপত্তাহীনতার তীব্র অনুভূতির সৃষ্টি করে। দুশ্চিন্তার ফলে তার মানসিক সংগঠনের সমন্বয় নষ্ট হয়ে যায় এবং অতিরিক্ত অনুভূতিপ্রবণতা, শরীরকম্পন, আকস্মিক চমকে ওঠা ইত্যাদি লক্ষণের সৃষ্টি হয়। এই দুশ্চিন্তা থেকে ব্যক্তি নিজেকে রক্ষা করার জন্য বিস্মৃতি, আচ্ছন্নভাব ইত্যাদি অচেতন প্রক্রিয়ার আশ্রয় গ্রহণ করে। এসব মানসিক বৈশিষ্ট্য থেকে ব্যক্তির মধ্যে সৃষ্টি হয় চরম ক্লান্তি বা অবসন্নতা।

৪. বেকারত্ব (Unemployment): 

যারা দীর্ঘদিন ধরে বেকার, সেসব ব্যক্তির আত্মমর্যাদায় বেকারত্ব আঘাত হানে, যার পরিপ্রেক্ষিতে নানাধরনের মনোবিকৃতি দেখা যায়; যেমন, কাজের প্রতি অনীহা দেখা দেয়, অল্পতেই অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে, হঠাৎ রেগে ওঠে এবং কারও কারও মধ্যে দায়িত্ব এড়ানোর প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এছাড়া অনেক ব্যক্তি বেকারত্বের দুঃখকে ভুলতে নানারকম নেশার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। বেকারত্বের ফলে ব্যক্তির পারিবারিক জীবন নানা দুর্যোগের সম্মুখীন হয় এবং এর ফলে তারা নানা ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

৫. আদিবাস বনাম মোহাজের: 

নানা কারণে এক দেশের লোক অন্যদেশে দেশান্তর হওয়ার ফলে পারিবারিক স্থিতিশীলতা গুরুতরভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। নিজেদের আদিবাস ত্যাগ করে অন্যদেশের লোকদের সাথে সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে খাপ খাইয়ে চলা তাদের পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। খুব কম ক্ষেত্রেই তারা তাদের অতীতের নিরাপত্তা ও সুখশান্তি ফিরে পেয়েছে। অধিকাংশ পরিবারেরই মৌলিক স্থায়ী সংগঠনটি বিকৃত, শিথিল ও দুর্বল হয়ে পড়েছে। তার ফলে এসব পরিবারের ব্যক্তিদের আবেগমূলক সংগতিবিধান বিপর্যস্ত হয়ে যায় এবং তাদের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে গুরুতর প্রকৃতির অপসংগতি দেখা দেয়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, উপর্যুক্ত কারণ ছাড়াও সাম্প্রদায়িকতা, ভাষাভিত্তিক, জাতিবর্ণকেন্দ্রিক বিচ্ছিন্নতাবোধের কুফল হিসেবে দেখা দেয় ভয়, মানসিক অস্থিরতা, হিংসা, অশান্তি ও নিরাপত্তাবোধের অভাব এবং মানসিক রোগ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url