মানসিক স্বাস্থ্য সেবার সাথে সম্পর্কিত পেশাসমূহ
যেসব পেশাদার চিকিৎসক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য সনদ বা অনুমতি পান তাদের একাডেমিক ডিসিপ্লিন ও প্রশিক্ষণ বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। একাডেমিক ডিসিপ্লিন ও প্রশিক্ষণের ভিন্নতার কারণে তাদের দক্ষতাও ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার হয়ে থাকে। দক্ষতা ও কাজের ক্ষেত্র বিবেচনায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী চিকিৎসকদের বিভিন্ন নামে ডাকা হয়ে থাকে। মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সাথে সম্পর্কিত পেশাসমূহ:
১. সাইকিয়াট্রিস্ট (Psychiatrist)
২. চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী (Clinical Psychologist)
৩. কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট (Couseling Psychologist)
৪. সাইকোলজিস্ট (Psychologist)
৫. সাইকোএনালিস্ট বা মনঃসমীক্ষক (Psychoanalyst)
৬. সাইকোথেরাপিস্ট (Psychotherapist)
৭. সমাজকর্মী (Social Worker)
নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-
১. সাইকিয়াট্রিস্ট (Psychiatrist):
চিকিৎসা বিজ্ঞানের যে শাখায় রোগ নির্ণয়, চিকিৎসায় শারীরিক লক্ষণ ও চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক, আবেগীয় ও আচরণগত বৈকল্য ও তার চিকিৎসার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে তাকে সাইকিয়াট্রি বা মনোরোগ বিদ্যা বলে। মনোরোগ নির্ণয় ও নিরাময়কে কেন্দ্র করেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের (Medical Science)-এর এই শাখার উদ্ভব হয়েছে। মূলত প্রথম দিকে সাইকিয়াট্রিস্টরাই মনোরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা করতেন।
সাইকিয়াট্রিস্টরা একাডেমিক ধারায় প্রথমে মেডিসিনের উপর ইন্টার্নসহ এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। এমবিবিএস ডিগ্রির পর সাইকিয়াট্রিতে এমডি ডিগ্রির এর প্রয়োজন হয়। এছাড়াও সাইকিয়াট্রিতে আরো উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করতে পারে: যেমন-ডিপিএম, এফসিপিএস, USMLE প্রভৃতি। বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষাগুলোর একটি হচ্ছে USMLE। এটাতে উচ্চ স্কোর নিয়ে পাস করার পর চার বছর ধরে Residency ট্রেনিং করতে হয়, যার প্রথম দুই বছর যায় বিভিন্ন ওষুধ সম্পর্কে জানতে। এই ডিগ্রিটা দেয় আমেরিকান বোর্ড অফ সাইকিয়াট্রি এ্যান্ড নিউরোলজি। কারণ এটি মনোরোগবিদ্যা এবং স্নায়ুবিদ্যা দুটোর সমন্বয়। সাইকিয়াট্রিস্টরা জটিল ও গুরুতর মানসিক সমস্যা, বাই-পোলার বৈকল্য এবং সিজোফ্রেনিয়ার ইত্যাদির ক্ষেত্রে চিকিৎসা প্রদান পর্যালোচনা করে।
সাইকিয়াট্রি রোগ নির্ণয়ের জন্য প্যাথলোজিক্যাল টেস্ট, ব্রেইন ইমেজিং, স্নায়ু-রাসায়নিক টেস্ট এবং মনোবৈজ্ঞানিক অভীক্ষা প্রভৃতির উপর গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
সাইকিয়াট্রিস্টরা ঔষধ তথা মেডিসিনার চিকিৎসা ও মনোবৈজ্ঞানিক থেরাপি প্রদানের মাধ্যমে মানসিক রোগীদের চিকিৎসা প্রদান করেন।
২. চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী (Clinical Psychologist):
যিনি মনোবিজ্ঞানী বিশেষ ডিগ্রি ও প্রশিক্ষণ নিয়ে মনোবিজ্ঞানের নীতি, পদ্ধতি ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে মানসিক রোগ বা আচরণগত বৈকল্যের মূল্যায়ন, নির্ণয়, চিকিৎসা প্রদান ও প্রতিরোধ করার জন্য বৈজ্ঞানিকভাবে প্রয়োগ করে তাকে চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী বলে। চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীগণ একাডেমিক ধারায় প্রথমে মনোবিজ্ঞানে গ্র্যাজুয়েশন বা স্নাতক সম্পন্ন করতে হয়। এরপর ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিতে এমএসসি/এমএস এবং এম ফিল ডিগ্রি এবং ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন; সাথে সাথে একাডেমিক ও ক্লিনিক্যাল ট্রেনিংয়ে পাস করতে হবে বা সনদধারী হতে হবে। চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীরা এমএস (MS) থাকা অবস্থায় ১ বছর বিভিন্ন মানসিক হসপিটালে (Psychiatry Departmem) এ ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিস করেন।
চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান জটিল মানসিক সমস্যা নিয়ে কাজ করেন; যেমন তীব্র মানসিক দুশ্চিন্তা (anxiety), তীব্র ডিপ্রেশন (severe depression), OCD, ড্রাগ এডিকশন, Conduc disorder, ADHD, Complex Phobia ইত্যাদি।
চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী রোগ নির্ণয়ে মনোবৈজ্ঞানিক অভীক্ষা, চিকিৎসামূলক সাক্ষাৎকার, চিকিৎসামূলক পর্যবেক্ষণ ও কেস হিস্ট্রি প্রভৃতির উপর গুরুত্ব দিয়ে থাকে। চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানিগণ মনোবৈজ্ঞানিক থেরাপি, আচরণ থেরাপি, দলগত থেরাপি, সিবিটি ও Couple Therapy প্রভৃতির প্রদান করেন। কিন্তু ঔষধ প্রদান করতে পারেন না।
যারা শুধু এমএস (MS) করেন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির উপর কিন্তু PhD/ MPhil করেন না তাদের Assistance Clinical Psychologis: বলা হয়। আর যারা PhD/MPhil সম্পন্ন করে সাথে সাথে একাডেমিক ও ক্লিনিক্যাল ট্রেনিংয়ে পাস করে সনদপ্রাপ্ত হন তদের Clinical Psychologist স্বীকৃতি দেয়া হয়।
৩. কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট (Couseling Psychologist):
কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট তারা যারা মনোবিজ্ঞানে বিএসসি (সম্মান) ও কাউন্সেলিং সাইকোলজিতে এমএসসি/এমএস এবং এমফিল ডিগ্রি অর্জন করেন এবং এর পাশাপাশি এমএস থাকা অবস্থায় ৬ মাসের বিভিন্ন স্কুল বা হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ বা কাউন্সেলিং প্র্যাক্টিস করেন with supervision এবং এমফিল থাকা অবস্থায় কাউন্সেলিং প্র্যাক্টিস করেন।
কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্টরা মূলত কম/মৃদু গুরুতর মানসিক সমস্যা নিয়ে কাজ করে থাকেন; যেমন- relationships problem, Normal Anxiety Grief, normal depression, Self-esteem issues, conflic issues, Stress, significan life events stress, educational and vocational counseling, job stress ইত্যাদি। যারা শুধু এমএস (MS) করেন কাউন্সেলিং সাইকোলজির উপর কিন্তু MPhil করেন না তাদের Assistance Counseling Psychologist বলা হয়। যারা PhD/MPhil সম্পন্ন করে সাথে সাথে একাডেমিক ও ক্লিনিক্যাল ট্রেনিংয়ে পাস করে সনদপ্রাপ্ত হন তদের Counseling Psychologist স্বীকৃতি দেয়া হয়।
৪. সাইকোলজিস্ট (Psychologist):
সাইকোলজিস্ট তারা যারা মনোবিজ্ঞানে বিএসসি (সম্মান) ও মনোবিজ্ঞানে এমএসসি/এমএস এবং এম ফিল ডিগ্রি অর্জন করেন। সাইকোলজিস্টরা বিভিন্ন একাডেমিক কার্যক্রমের সাথে যুক্ত থাকেন ও এর পাশাপাশি গবেষণা করেন। সাইকোলজিস্টের গবেষণার জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টরা ও কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্টরা সাইকোথেরাপি ও কাউন্সেলিং সেবা প্রদান করে থাকেন। সাইকোলজিস্টরা সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং প্রদান করেন না। তবে কাউন্সেলিংয়ের উপর প্রফেশনাল প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে স্বল্প পরিসরে কম গুরুতর ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং অনুশীলন করতে পারেন। একজন মনোবিজ্ঞানী মূলত সংবেদনশীল সমস্যাগুলি নিয়ে কাজ করেন। সাইবার বুলিং, শিশুশ্রম, শিশুনির্যাতন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে কাজ করে থাকেন।
৫. সাইকোএনালিস্ট বা মনঃসমীক্ষক (Psychoanalyst):
সাইকোএনালিস্ট থেরাপির জন্য ফ্রয়েডিয়ান তত্ত্বগুলি অনুসরণ করেন যা অবচেতন মন, স্বপ্ন, শিশুতোষ যৌনতা, কামনা, দমন, প্রতিস্থাপন এবং শৈশবস্মৃতি অন্তর্ভুক্ত করে। মনঃসমীক্ষক হলেন মানসিক রোগবিশেষজ্ঞের মতো যিনি গুরুতর সমস্যাগুলি নিয়ে কাজ করেন। তবে তারা ওষুধগুলি লিখতে পারে না এবং তাদের পরামর্শ দেওয়ার পদ্ধতিটি মনোবিজ্ঞানীদের চেয়ে কিছুটা আলাদা। বর্তমান সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতে তারা রোগীর অবচেতন স্মৃতিতে মনোনিবেশ করে। এবং মনোবিজ্ঞানীদের সপ্তাহে একবার; না হয় দুই/তিন সপ্তাহে একবার রোগীর সেশন পরিচালনা করতে হয়।
মনোবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী ও সাইকিয়াট্রিস্টরা মনঃসমীক্ষণের উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে মানসিক রোগীদের চিকিৎসা করে থাকেন। তবে বর্তমানে আমেরিকার মনঃসমীক্ষণ ইনস্টিটিউটে শিক্ষা গ্রহণ করতে হলে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ডিগ্রি নিতে হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে মনোবিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে মনঃসমীক্ষণে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকে মনঃসমীক্ষক হিসেবে কাজ করছেন।
৬. সাইকোথেরাপিস্ট (Psychotherapist):
সাইকোথেরাপিস্ট তারা যারা মনোবিজ্ঞানে বিএসসি (সম্মান) ও মনোবিজ্ঞানে এমএসসি/এমএস ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ৬ মাসের সাইকোথেরাপির উপর কোর্স করেন। সাইকোথেরাপিস্টরা মূলত সাইকো-সোশ্যাল কাউন্সেলিং করে থাকেন।
৭. সমাজকর্মী (Social Worker):
সমাজকর্মে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন এবং মানসিক হাসপাতালে প্রশিক্ষণ নিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় অবদান রাখেন। রোগের পারিবারিক তথ্য সংগ্রহ, পেশাগত তথ্যসংগ্রহ ও পুনর্বাসনে সাহায্য করা তাদের বিশেষ দ্বায়িত্ব।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, শুধু সাইকিয়াট্রিস্টরা মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় ওষুধ প্রেসক্রাইব করার ক্ষমতা রাখেন। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট, সাইকোলজিস্টদের মেডিসিনের উপর কোনো ডিগ্রি নেই। তাই তারা ওষুধ প্রেসক্রাইব করতে পারবেন না। ডিগ্রি না থাকা সত্ত্বেও কেউ যদি ঔষুধ প্রদান করে থাকে তাহলে সেটা, গুরুতর অপরাধ ও আইনত দণ্ডনীয়।