পীড়ন হ্রাসের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রতিক্রিয়াগুলো আলোচনা

মানসিক স্বাস্থ্যের অস্বাভাবিক আচরণের সাথে সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয় হলো পীড়ন। মানুষের জীবন সরল এবং স্বাভাবিক হতো যদি তার দৈহিক ও মানসিক চাহিদা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পূরণ হয়ে যেত। কিন্তু আমরা জানি যে, এই চাহিদাসমূহ পূরণের ক্ষেত্রে পরিবেশগত, ব্যক্তিগত ও বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয় যা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে দেয় না। এই বাধা ব্যক্তির মধ্যে অভিযোজনমূলক চাহিদা সৃষ্টি করে। এই অভিযোজনমূলক চাহিদার অপর নামই পীড়ন। 

পীড়ন (Stress): পীড়ন হলো মনোবৈজ্ঞানিক পরিভাষা যা মানুষের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্যহীন অবস্থাকে বোঝায়। যে অবস্থা বা পরিস্থিতি ব্যক্তির জন্য নতুন অভিযোজনের প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করে সেগুলোকে পীড়ন বলে। আবার অন্য কথায় বলা যায়, এ ধরনের পরিস্থিতি ব্যক্তির মধ্যে যে মানসিক অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করে, সে মানসিক অবস্থাকে পীড়ন বলে।

অস্বাভাবিক ও ক্ষতিকর মানসিক উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠা হিসেবে মানসিক পীড়ন ব্যক্তির আচরণগত, শারীরিক, আবেগীয় ও বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সৃষ্টি করে। শরীরবিজ্ঞানিগণ মনে করেন যে, শারীরিক রোগের প্রায় ৭৫ ভাগই মানসিক পীড়ন-সংশ্লিষ্ট। দীর্ঘমেয়াদি মানসিক পীড়ন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় আচরণগত বিচ্যুতি ডেকে আনে।

পীড়নের প্রতি প্রতিক্রিয়া

পীড়নের সম্মুখিন হলে মানুষের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়াগুলোর উৎপত্তি হয়, সেগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়; যথা-

  1. কৃত্যমুখী প্রতিক্রিয়া বা প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া
  2. প্রতিরক্ষামুখী প্রতিক্রিয়া বা পরোক্ষ প্রতিক্রিয়া

কৃত্যমুখী প্রতিক্রিয়া বা প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়াঃ

সমস্যামূলক পরিস্থিতিতে বিভিন্ন কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে পীড়ন দূর করার যে বাস্তবমুখী প্রচেষ্টা করা হয় তাকে কৃত্যমুখী প্রতিক্রিয়া বলে। উপযোগী প্রতিক্রিয়া তিন ধরনের হয়ে থাকে; যেমন- সরাসরি প্রতিক্রিয়া, পশ্চাদপসরণ ও সমঝোতা। এগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. সরাসরি প্রতিক্রিয়া: পীড়ন মোকাবেলায় সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি হলো সরাসারি প্রতিক্রিয়া। সরাসরি প্রতিক্রিয়ায় সক্রিয় কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে পীড়নমূলক পরিস্থিতি নির্মূল করা হয়। এজন্য উপায় হলো- পরিস্থিতি পুনর্মূল্যায়নের জন্য নিখুঁত পর্যবেক্ষণ করে প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত করা; সমস্যা সমাধানের জন্য নিজের মধ্যে প্রয়োজনীয় দক্ষতার উন্নয়ন সাধন করা এবং পরিশেষে নব উদ্যমে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা; যেমন- কোনো ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করে পীড়নমূলক পরিস্থিতির সম্মুখীন হলো। সেক্ষেত্রে সে পরিস্থিতি আমি যথাযথভাবে পুনর্বিবেচনা করে বুঝতে পারল যে অপর্যাপ্ত প্রস্তুতিই তার ব্যর্থতার কারণ। সুতরাং সে নব উদ্যমে পরবর্তী ভর্তি পরীক্ষার জন্য পূর্ণ মাত্রায় প্রস্তুতি নিতে শুরু করবে এবং পরবর্তী ভর্তি পরীক্ষায় সাফল্য অর্জন করে পীড়নের পরিসমাপ্তি ঘটাবে।

২. পশ্চাদপসরণ: সরাসরি প্রতিক্রিয়া দ্বারা পীড়ন সৃষ্টিকারী অবস্থাকে দূরীভূত করা না গেলে নিজেকে তা থেকে সরিয়ে নেয়া অথবা লক্ষ্যবস্তুকে বর্জন করাই ভালো পন্থা; অর্থাৎ যে সমস্যাজনক পরিস্থিতি ব্যক্তির মধ্যে পীড়নের সৃষ্টি করছে; তা যদি সমাধান করা সম্ভব না হয়, তবে নিজেকে সে ঐ পরিস্থিতি থেকে সরিয়ে নিতে পারে; যেমন- বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেল করা শিক্ষার্থী যদি মনে করে যে, পরীক্ষায় পাস করার মতো ক্ষমতা তার নেই, তাহলে তার উচিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি বাদ দিয়ে বিকল্প লক্ষ্য নির্ধারণ করা।

৩. সমঝোতা বা আপোশ: এক্ষেত্রে ব্যক্তি সমস্যাজনক পরিস্থিতির কিছু পরিবর্তন করে ও নিজের চাহিদার কিছু পরিবর্তন করে পরস্পরের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। এক্ষেত্রে ব্যক্তি স্বীয় দক্ষতা ও যোগ্যতা এবং বিরাজমান পরিস্থিতিকে বাস্তব দৃষ্টিতে যাচাই করেই এই সমঝোতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যে ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে বারবার অকৃতকার্য হচ্ছে তার উচিত অন্য কোনো সহজ বিষয়ে পড়াশোনা করা।

উপর্যুক্ত তিনটি পদ্ধতিতে ব্যক্তিকে বাস্তবতার নিরিখে বিভিন্ন সমাধানমূলক কার্যসম্পাদনের মাধ্যমে পীড়ন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয় বলে এগুলোকে কৃত্যমুখী প্রতিক্রিয়া বলে।

প্রতিরক্ষামুখী প্রতিক্রিয়া বা পরোক্ষ প্রতিক্রিয়া: 

পীড়নের ফলে ব্যক্তির মধ্যে উদ্বেগ ও চাপের সৃষ্টি হয়। ব্যক্তি তখন বাস্তবকে বিকৃতকরে কতকগুলি পরোক্ষ প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে নিজের অহংবোধকে অক্ষুণ্ণ রাখতে চায় এবং উদ্বেগ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চায়। ব্যক্তি এগুলি তার অজান্তেই করে থাকে। ফ্রয়েড এসকল প্রতিক্রিয়াকে আত্মরক্ষা কৌশল বলে অভিহিত করেছেন। এই প্রতিক্রিয়াগুলি নিম্নরূপ:

১. যুক্তাভ্যাস: হতাশা বা ব্যর্থতার সপক্ষে যুক্তি দেখানোকে যুক্তাভ্যাস বলে; যেমন- একজন ছাত্র পরীক্ষায় ফেল করে এই যুক্তি দেখান যে, এবার ফেল করায় ভালোই হয়েছে। কেননা এখন সে বর্তমান শ্রেণিতে থেকে দুর্বল বিষয়গুলি ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পারবে।

২. প্রক্ষেপন: প্রক্ষেপণের মাধ্যমে আমরা প্রধানত আমাদের অক্ষমতা, দোষ, ত্রুটি এবং ভুল-ভ্রান্তি নিজে স্বীকার না করে সম্পূর্ণ দোষ অন্যের উপর চাপিয়ে দিই; যেমন- কোনো ছাত্র পরীক্ষায় ফেল করে এইভাবে সান্তনা পায় যে, শিক্ষক তাকে অন্যায়ভাবে যেল করিয়েছে। ভাগ্যের দোষ দেয়া, যন্ত্রের বা পরিবেশের উপর দোষ আরোপ করা হলো প্রক্ষেপণের উদাহরণ।

৩. স্থানচ্যুতি: পীড়ন সৃষ্টিকারী বস্তু বা ব্যক্তি যখন অধিক শক্তিশালী বা তাকে আক্রমণ করা বিপজ্জনক বলে মনে হয়, তখন হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তি কোনো নিরপেক্ষ বা অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী ব্যক্তি বা বস্তুকে আক্রমণ করে থাকে। আবেগের এরূপ ও স্থানান্তরকে স্থানচ্যুতি বলে; যেমন- একজন কর্মচারী তার উর্ধ্বতন কর্মচারী কর্তৃক তিরস্কৃত হয়ে বাড়িতে গিয়ে তার স্ত্রীর উপর ক্রোধ প্রকাশ করতে পারে।

৪. উদগতি: উদ্গতিতে সমাজ অনুমোদিত প্রেষণাগুলি সমাজ অনুমোদিত আচরণের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়; যেমন- ব্যর্থ প্রেমিক প্রেমের কবিতা রচনা করে তার প্রেমের উদ্‌দ্গতি সাধন করতে পারে। কিংবা প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কোনো মহিলা সেবাব্রত গ্রহণ করতে পারে। 

৫. কল্পনাবিলাস: পীড়নের গ্লানি থেকে মুক্তি পাবার জন্য ব্যক্তি বাস্তবকে ভুলে ক্ষণকালের জন্য কল্পনার রাজ্যে বিচরন করে এবং নানারূপ সফলতার কথা ভেবে তৃপ্ত হয়। এর ফলে ব্যক্তি কিছুক্ষণের জন্য উদ্বেগমুক্ত থাকে। 

৬. অবদমন: ফ্রয়েড মনে করেন, মানুষের নির্জান মনের অনেকটাই অবদমিত বিভিন্ন কামনা-বাসনা দ্বারা পরিপূর্ণ। আমাদের প্রেষণা যখন বাধাগ্রস্ত হয় অথবা যখন আদিম সত্তার সাথে বিবেকের দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয় তখন আমাদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। যেহেতু উদ্বেগের অনুভূতি বেদনাদায়ক, সেহেতু আমরা প্রেষণাটিকে অবদমন করে মনের গভীরে নির্ভান স্তরে প্রেরণ করি এবং বেদনাদায়ক অনুভূতিকে ভুলে থাকি।

৭. ক্ষতিপূরণ: ক্ষতিপূরণে কোনো এক ক্ষেত্রের ব্যর্থতাকে অন্য ক্ষেত্রের সফলতা দিয়ে পুষিয়ে নেয়া হয়; যেমন- পড়াশোনায় ব্যর্থ কোনো ছেলে খেলাধুলার পারদর্শিতা দেখিয়ে তার ব্যর্থতার ক্ষতিপূরণ করতে পারে। 

৮. বিপরীত প্রতিক্রিয়া গঠন: কোনো প্রবৃত্তি বা অনুভূতি যদি কোনো মানুষের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করে তাহলে উক্ত প্রবৃত্তি ও অনুভূতিগুলোর বিপরীত মনোভাব সৃষ্টি করে সে নিজেকে উদ্বেগ থেকে রক্ষা করে; যেমন- অনেকে অন্ধকার পথে নির্জন পথ অতিক্রম করার সময় একা একা উচ্চস্বরে গান করে, ভাবখানা এমন যে, তার কোনো ভয় নেই। বলাবাহুল্য বাইরে এই বীরত্বের ঠাঁট বাস্তবিক পক্ষে মনের মধ্যের দুর্ভাবনা ঢাকবার আত্মরক্ষামূলক কৌশল মাত্র। ভয় বা দুশ্চিন্তা গোপন করবার জন্য বাইরে এই যে বিপরীত আচরণ একেই বলা হয় বিপরীত প্রতিক্রিয়া।

৯. একাত্মতা অনুভব: প্রক্ষেপণের বিপরীত প্রতিক্রিয়া হলো একাত্মতা। প্রক্ষেপণে নিজের দোষ-ত্রুটি অপরের উপর চাপাবার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু একাত্মতায় আমরা অন্যের গুণাবলি নিজের বলে গ্রহণ করি। আমরা যাকে ভালোবাসি বা পছন্দ করি; তার সাফল্য বা গৌরবকে নিজের গৌরব বলে মনে করবার দুর্বলতা আমাদের অনেকের মধ্যে দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে আমরা নিজেকে খ্যাতিমান ব্যক্তির আত্মীয় পরিচয় দিয়ে নিজের মান বাড়াতে চাই। 

১০. প্রত্যাবৃত্তি: আত্মরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে অনেকেই শৈশবের আচরণে ফিরে যায়। বয়স্ক লোকেরা পীড়ন থেকে আত্মরক্ষার জন্য শৈশবের আচরণের পুনরাবৃত্তি করলে তাকে বলা হয় প্রত্যাবৃত্তি। দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হলে অনেক সময় প্রথম সন্তান মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার উদ্বেগ বোধ করে। এ অবস্থায় প্রথম সন্তান শৈশবের আচরণে ফিরে যায়; যেমন-সে শিশুসুলভ ভঙ্গিতে কথা বলার চেষ্টা করে। সুতরাং প্রত্যাবৃতিত এক হতাশা চাপের প্রতি একটি প্রতিক্রিয়া বলা হয়।

উপর্যুক্ত প্রতিক্রিয়াগুলি ছাত্র ও অন্যান্য কতকগুলো অনুপযোগী প্রতিক্রিয়া ঘটাতে পারে; যেমন- অনীহা, উদাসীনতা, নিষ্ক্রিয়তা, দিবাস্বপ্ন, সংরক্ষণ, ইত্যাদি।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url