মানসিক প্রতিবন্ধিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য ও প্রতিরোধ
সাধারণভাবে মানসিক প্রতিবন্ধিতা বলতে বোঝায় ব্যক্তির বিলম্বিত মানসিক বিকাশ। সুতরাং সঠিক সময়ে কোনো ব্যক্তির পর্যায়ক্রমিক মানসিক বিকাশ না-ঘটলে তাকে মানসিক প্রতিবন্ধী বলা হয়।
আমেরিকার মানসিক প্রতিবন্ধী সমিতির মতে,
মানসিক প্রতিবন্ধিকতা হলো বিঘ্নিত ক্রমবিকাশের জন্য ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তিমূলক কাজে গড়ের চেয়ে কম দক্ষতা, যার ফলে তার উপযোজনমূলক আচরণ ব্যাহত হয়।
মানসিক প্রতিবন্ধিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য
এমন অনেক লক্ষণ বা উপসর্গ আছে যেগুলো দেখে মানসিক প্রতিবন্ধীদের চিহ্নিত করা যায়। মানসিক প্রতিবন্ধিতার প্রধান উপসর্গ হচ্ছে ব্যক্তির বিলম্বিত ও বিঘ্নিত শারীরিক ও মনোসামাজিক বৈশিষ্ট্যাবলির বিকাশ।
ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে জন্মের পর থেকে ধাপে ধাপে ব্যক্তির দৈহিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্যাবলি এবং আচরণগত দক্ষতা বিকাশ লাভ করে।
কিন্তু মানসিক প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে এইসব বৈশিষ্ট্য ও দক্ষতা নির্দিষ্ট সময় বিকশিত হয় না, বরং কখনো কখনো দেরিতে বিকশিত হয় বা আংশিক বিকশিত হয় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে একেবারেই বিকশিত হয় না।
মানসিক প্রতিবন্ধীদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্যগুলো সম্বন্ধে নিম্নে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো:
শারীরিক বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণসমূহ:
মানসিক প্রতিবন্ধীদের কতকগুলো শারীরিক লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে; যথা-
- মাইক্রোসেফালী (Microcephaly): মাইক্রোসেফালী বলতে অস্বাভাবিকভাবে ছোটো আকৃতির মাথাকে বোঝায়। সাধারণত মানুষের মাথার ব্যাস ৫০ থেকে ৫৫ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। কিন্তু মাইক্রোসেফালীসম্পন্ন ব্যক্তিদের মস্তিস্ক পূর্ণ বিকশিত হয় না বলে তাদের বুদ্ধিও কম হয়। ফলে মানসিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।
- ম্যাক্রোসেফালী (Macrocephaly): এক্ষেত্রে মাথার আকার অস্বাভাবিকভাবে বড়ো হয়ে থাকে। মস্তিষ্কের ভেতরে বিশেষ ধরনের তরল পদার্থ জমা হওয়ার কারণে মাথার আকৃতি এরূপ অস্বাভাবিক রকম বড়ো হয়ে থাকে। ম্যাক্রোসেফালীর ক্ষেত্রেও শিশুর বুদ্ধির বিকাশ বিঘ্নিত হয়। ফলে সে মানসিক প্রতিবন্ধীতে পরিণত হয়।
- ডাউনসিন্ড্রোম (Down's syndrome): ক্রোমোজোম সংমিশ্রণে ত্রুটির কারণে সৃষ্ট জটিলতার নাম ডাউনসিন্ড্রোম, এ সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তির কিছু শারীরিক বৈকল্য দেখা যায়; যেমন, অনেক ভাঁজবিশিষ্ট চওড়া জিহ্বা, খাটো দেহ, ছোটো ও চ্যাপ্টা নাক, হাত ও পায়ের আঙুল ছোটো, কান ও মুখ ছোটো ইত্যাদি। ডাউনসিন্ড্রোমের ক্ষেত্রে ব্যক্তির হরমোন নিঃসরণে জটিলতা সৃষ্টি হয়। ফলে ব্যক্তির জৈবিক প্রক্রিয়ার ত্রুটি দেখা যায় এবং তার বুদ্ধিও কম হয়।
- ক্লিনেফেলটারস্ সিন্ড্রোম (Klinefelter's syndrome): এক্ষেত্রে যৌন ক্রোমোজোম সংমিশ্রণে ত্রুটির কারণে ব্যক্তির মানসিক প্রতিবন্ধিকতা সৃষ্টি হয়। ক্লিনেফেলটারস্ সিন্ড্রোমসম্পন্ন ব্যক্তির শরীরে ফিমেল সেক্স ক্রোমাটিন থাকে যা স্বাভাবিক পুরুষের শরীরে থাকে না।
- টারনারস সিন্ড্রোম (Turner's syndrome): এটাও এক ধরনের ক্রোমোজোম সংমিশ্রণে ত্রুটিজনিত মানসিক প্রতিবন্ধিকতা। এদের শারীরিক বৃদ্ধি কম হয়, যৌনতার বিকাশ ধীরে ধীরে হয় এবং সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা থাকে না।
- ট্রাইসোমি-এক্স (Trisomy-X): এটা ক্রোমোজোম সংমিশ্রণের আরেক ধরনের ত্রুটি। এক্ষেত্রে মায়ের ডিম্ব বা জরায়ুর ত্রুটির কারণে মানসিক প্রতিবন্ধিতা ঘটে।
- এ্যামরোটিক ইডিয়োসী (Amaurotic idiocy): এক্ষেত্রে শিশুর দৃষ্টিহীনতা বা অন্ধত্ব দেখা দেয় অথবা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অবশ হয়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব শিশুর তীব্র মানসিক প্রতিবন্ধিতা ও শারীরিক স্থবিরতা দেখা যায়।
- টিউকেরাস সক্লেরোসিস্ (Tuberous sclerosis): এক্ষেত্রে জন্মগত সিফিলস থেকে শিশুর মস্তিষ্কের কিছু পরিবর্তনের কারণে তার মানসিক প্রতিবন্ধিকতা সৃষ্টি হয়।
- ক্রেটিনিজম (Critinism): আয়োডিনের অভাবে শিশুর থাইরয়েড গ্লান্ডের কার্যক্রম বিঘ্নিত হলে তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে তার মানসিক প্রতিবন্ধিকতা দেখা দিতে পারে।
মনঃসামাজিক লক্ষণ:
মানসিক প্রতিবন্ধীদের শারীরিক লক্ষণের মতো কিছু মানসিক লক্ষণও আছে যেগুলোর ভিত্তিতে তাদেরকে প্রতিবন্ধী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়; যথা-
- বুদ্ধি: আমেরিকার মানসিক প্রতিবন্ধী সমিতির মতে জনসমষ্টির গড় বুদ্ধাঙ্কের কমপক্ষে এক আদর্শবিচ্যুতি নিম্নের ব্যক্তিরাই মানসিক প্রতিবন্ধী। সাধারণত যেসব মানুষের বুদ্ধাঙ্ক ৯০ থেকে ১১০-এর কম তাদেরকে মানসিক প্রতিবন্ধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সুতরাং মানসিক প্রতিবন্ধীদের বুদ্ধাঙ্ক স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকে এবং বুদ্ধান্ত অনুযায়ী এদেরকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়।
- বয়সোপযোগী আচরণের দক্ষতার অভাব: মানসিক প্রতিবন্ধীদের বয়সোপযোগী আচরণ করার ক্ষমতা দেরিতে বিকাশলাভ করে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বয়সোপযোগী আচরণ করার ক্ষমতা একেবারেই বিকাশ লাভ করে না; যেমন প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে ভাষার বিকাশ, চিন্তাশক্তি, যুক্তি ও বিচারক্ষমতা বিদ্যার্জন ক্ষমতা ইত্যাদি দেরিতে বিকাশ লাভ করে বা আংশিকভাবে বিকাশ লাভ করে না। অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মোটেই বিকাশ লাভ করে না।
- বিঘ্নিত সামাজিক মূল্যবোধ: প্রতিবন্ধীদের বয়সোপযোগী সামাজিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে না। সমাজের ন্যায়-অন্যায়, বিধিনিষেধ, রীতিনীতি ও চাল-চলন অনুসারে যে বয়সে যেরকম আচরণ করার কথা সে বয়সে সেই রকম আচরণ করতে পারে না।
মানসিক প্রতিবন্ধিতার প্রতিরোধব্যবস্থা:
মানসিক প্রতিবন্ধতা প্রতিরোধ করার জন্য যেসব ব্যবস্থা অবলম্বন করা দরকার সেগুলো সম্বন্ধে নিম্নে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো:
- বিপাক ক্রিয়ার ত্রুটি দূর করা: যে সমস্ত শিশুর বিপাক ক্রিয়ার ত্রুটি তাদের সমস্যা দ্রুত শনাক্ত করে উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থ। করা হলে, উক্ত সমস্যার কারণে প্রতিবন্ধিতার সম্ভাবনা কমে যায়।
- পুষ্টিহীনতা দূর করা: গর্ভকালীন মায়ের জন্য পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যবস্থা করলে অপুষ্ট সন্তান জন্মের সমস্যা দূর হয়। কোনো কারণে অপুষ্ট শিশুর জন্ম হলে উপযুক্ত পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যবস্থা করা উচিত, যাতে পুষ্টিহীনতার কারণে মানসিক প্রতিবন্ধতার সৃষ্টি না হয়।
- ক্রোমোজোমের ত্রুটির ব্যাপারে সতর্কতা: যাদের ঘনঘন গর্ভপাত হয় এবং ক্রোমোজোমের ত্রুটিজনিত শিশু জন্মের ইতিহাস আছে তাদের সন্তান প্রতিবন্ধী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং তাদের গর্ভধারণ থেকে বিরত থাকা উচিত।
- সংক্রামক সমস্যা দূর করা: রুবেলা, সিফিলিস, হাম, বসন্ত প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত গর্ভবতী মায়েদের দ্রুত উপযুক্ত চিকিৎসা করা দরকার যাতে করে গর্ভবতী সন্তান ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মগ্রহণ না করে।
- বিষাক্ততা থেকে মুক্ত রাখা: গর্ভবর্তী মা এবং শিশুকে সব রকম বিষাক্ত খাবার এবং দূষিত পরিবেশ থেকে মুক্ত রাখা উচিত।
- রক্তের ত্রুটি থেকে সন্তান মুক্ত রাখা: আরএইচ নেগেটিভ রক্তের ত্রুটি থেকে শিশুকে মুক্ত রাখতে হলে আর পজিটিভ পুরুষ এবং আরএইচ নেগেটিভ নারীর মধ্যে বিবাহ পরিহার করা উচিত।
- মাদকাসক্তি প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা: মাদকাসক্তির ক্ষতিকর প্রভাবে অনেক সময় প্রতিবন্ধী সন্তান জন্মগ্রহণ করে। অতএব গর্ভবর্তী মাকে মাদক সেবন থেকে বিরত রাখতে হবে।
- গর্ভস্থ সন্তানের অবস্থা নির্ণয় করা: গর্ভধারণের পর সন্তানের সুস্থ বিকাশ ও বৃদ্ধি হচ্ছে কিনা তার জন্য আধুনিক পদ্ধতিতে সন্তানের প্রকৃতি নির্ধারণ করে পূর্ব থেকেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করা উচিত।
- পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াযুক্ত ঔষধ ব্যবহারে সতর্কতা: গর্ভকালীন পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াযুক্ত ঔষধ ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করা হলে ঔষধের ক্ষতিকর প্রভাবে প্রতিবন্ধী হওয়া থেকে শিশুকে রক্ষা করা যায়।
- ঋতুস্রাব নিয়ন্ত্রণকারী ঔষধ সেবন না-করা: গর্ত পরীক্ষার পর গর্ভে সন্তান নেই, এরূপ নিশ্চিত না-হয়ে ঋতুস্রাবের ঔষধ খাওয়া উচিত নয়। কারণ গর্ভবতী মায়ের ঋতুস্রাব নিয়ন্ত্রণকারী ঔষধ সেবন করলে গর্ভস্থ সন্তান মানসিক প্রতিবন্ধী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- প্রসবকালীন জটিলতা এড়ানোর ব্যবস্থা করা: প্রসবকালীন জটিলতার কারণে অনেক সময় শিশুরা প্রতিবন্ধিকতার শিকার হয়। তাই প্রসবকালীন জটিলতা থেকে মা ও শিশুকে রক্ষা করার জন্য হাসপাতালে প্রসবের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
- আয়োডিনের অভাব দূর করা: গর্ভকালীন অবস্থায় মা ও শিশুর আয়োডিনের অভাব দূর করার জন্য গর্ভবতী মাকে আয়োডিনযুক্ত লবণ খাওয়ার অভ্যাস করা উচিত। কারণ আয়োডিরেনর অভাবে গর্ভস্থ শিশু মানসিক প্রতিবন্ধী হতে পারে। তাছাড়া শরীরে আয়োডিনের ঘাটতি আছে এমন শিশুকে উপযুক্ত আয়োডিন সম্পূরক ঔষধ খাওয়ানো উচিত।