প্যারানয়ার কারণ ও চিকিৎসা

প্যারানয়া বা বিভ্রান্তিমূলক গোলযোগ একটি গুরুতর ক্রিয়াগত মনোবৈকল্য। বুদ্ধিভ্রংশই এ রোগের মূল লক্ষণ। ফলে রোগীর যুক্তিশক্তি ও চিন্তাধারা বিঘ্নিত হয় এবং রোগীর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তিমূলক ধারনার উৎপত্তি হয়। 

এ রোগে অন্য কোন রকমের মানসিক লক্ষণ বিশেষ দেখা যায় না। আপাতদৃষ্টিতে এদের জীবন যাপন অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে মনে হয়। এজন্যই অনেকে এ রোগকে গুরুতর মনোবৈকল্য না বলে লঘু মনোবৈকল্য রূপে মনে করেন। 

কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে এদের যতই স্বাভাবিক বলে মনে হোক না কেন, প্রকৃত পক্ষে এদের অস্বাভাবিক অত্যন্ত গুরুতর পর্যায়ের হয়। বুদ্ধিভ্রংশের ফলে এরা বাস্তবকে যথার্থভাবে অনুধাবন করতে পাবে না। ফলে বাস্তব অবস্থার প্রতি এদের আচরন সম্পূর্ণ অসঙ্গতিমূলক হয়। 

প্যারানয়াকে ক্রিয়াগত মনোবিকার বলা হয়। DSM-IV এ রোগটিকে বিভ্রান্তিমূলক গোলযোগ রূপে আখ্যায়িত করেছে।

প্যারানয়ার শ্রেনী বিভাগ: 

প্যারানয়া রোগকে দু'ভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা- 

  1. প্রকৃত প্যারানয়া (Paranoia proper) 
  2. প্যারানয়েড ষ্টেট/প্যারানয়ার অবস্থা (Paranoid state) 

প্যারানয়ার কারণ: 

প্যারানয়া মূলত মানসিক কারনেই সৃষ্টি হয় বলে মনে করা হয়। এ রোগের কারণতত্ত্ব বিশ্লেষন করলে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ্য করা যায়।

প্রথমতঃ এদের ব্যক্তিত্ত্বের মধ্যে কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। এরা অত্যন্ত অহমিকাপূর্ণ ও আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়। নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তি বিবেচনার প্রতি এদের অবিচল অবস্থা থাকে। এবং নিজেদের কে এরা তীক্ষ্ণ মেধা সম্পন্ন বলে বিশ্বাস করে। প্রকৃতপক্ষে এদের বুদ্ধিমনে সচরাচর গড় বুদ্ধ্যংকের উর্ধ্বে হয়। এ ছাড়া এদের একটি অনমনীয় ও একগুয়ে মনোভঙ্গি থাকে ফলে একবার এদের মনে কোন ঘটনার যে তাৎপর্য ও অর্থ উদ্ঘাটিত হয় সেটাকেই এরা একমাত্র চরম সত্য বলে মনে হয়। নিজের বুদ্ধিবৃত্তির ওপর অতিরিক্ত আস্থার দরুন অপরের বাস্তবধর্মী বিচার বিশ্লেষন ও যুক্তিতর্ক এদের মনের ওপর কোন রূপ রেখাপাত করে না। এদের দ্বারা একবার কোন সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে তা একেবারে অপরিবর্তনীয় ও অখন্ডনীয় হয়ে ওঠে। উদাহরনঃ বিশেষ পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক মানুষের মনে ও অপর সম্পর্কে কোন সন্দেহের সৃষ্টি হতে পারে। তবে পরবর্তী কালে বাস্তবতার ভিত্তিতে স্বাভাবিক ব্যক্তিরা এরূপ সন্দেহকে বাতিল করে দেয়। কিন্তু একগুয়ে ব্যক্তিদের মনে একবার সন্দেহের উদ্রেক হলেই, তা চিরস্থায়ী হয়ে পড়ে এবং পরবর্তী কোন ঘটনাই তা পরিবর্তন করতে পারে না।

দ্বিতীয়তঃ ব্যক্তি-পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতিও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারন রূপে কাজ করে। এদের ব্যক্তি পারস্পরিক সম্পর্ক ক্রমশ তিক্ত হয়ে ওঠে। কারণ এদের একগুয়ে, আত্মকেন্দ্রিক ও অহমিকাপূর্ণ ব্যক্তিত্ব অপরের কাছে সহজেই অপ্রীতিকর ও পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে। তিক্ত ব্যক্তি পারস্পরিক সম্পর্কের জন্য এরা অপর পক্ষকেই সম্পূর্ণ দায়ী করে এবং নিজের ত্রুটি বিচ্যুতির প্রতি অন্ধ হয়ে পড়ে। তিক্ত ব্যক্তি পারস্পরিক সম্পর্ক, স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার জন্য মানুষের খারাপ দিকগুলোই রোগীর চোখে বেশী পড়ে। ফলে রোগী নিজেকে সর্বদাই চতুর্দিক থেকে শত্রুবেষ্টিত বলে মনে করে। সর্বক্ষণই তার মনে হয় যে অপর ব্যক্তিরা যেন তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে ও তার ক্ষতি সাধনের চেষ্টা করছে।

তৃতীয়তঃ আত্ম-প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা (ego defensive measure) রূপেও অনেক সময় প্যারানয়ার সৃষ্টি হতে পারে। সাধারনতঃ উচ্চ বা উচ্চমধ্যবিত্ত বৃদ্ধিজীবিদের মধ্যেই এ রোগের আধিক্য পরিলক্ষিত হয়। এই শ্রেনীর ব্যক্তিরা স্বাভাবতই অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী হয় এবং নিজেদের সামর্থ্য ও প্রতিভা সম্পর্কে অত্যন্ত উচ্চাশা পোষণ করে। নিজেদের সম্পর্কে স্ফীত আত্মভিমান (inflated self respect) এর ফলে এরা তাদের উচ্চাকাঙ্খার স্তর (level of aspiration) এত উচ্ছে স্থাপন করে, যা অর্জন করা তাদের সাধ্যের অতীত হয়ে পড়ে। ফলে তারা পদে পদে ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়। হতাশার তীব্র পীড়ন থেকে আত্মরক্ষার জন্য ও স্বীয় আত্মাভিমানকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য এরা চরম মাত্রায় যুক্তিসিদ্ধকরণ (rationalization) ও প্রক্ষেপন (projection) প্রক্রিয়ার আশ্রয় গ্রহণ করে। সুতরাং নিজেদের ব্যর্থতার জন্য তারা অন্ধভাবে অন্যদের দায়ী করে এবং অন্যদের মধ্যে বিভিন্ন দোষ ত্রুটি অতিরঞ্জিত মাত্রায় প্রত্যক্ষণ করে। কুচক্রী মহলের কুমতলব, কুপ্রবৃত্তি ও ষড়ন্ত্রের জন্যই সে ব্যর্থ হচ্ছে, শত্রুপক্ষের পদে পদে বাধা সৃষ্টির জন্যই তার প্রতিভার অপমৃত্যু ঘটছে, প্রভৃতি বিকৃত ধারনা গুলো ক্রমশঃ সুবিন্যস্ত ও সুসজ্জিত হয়ে বিভ্রান্তির উৎপত্তি ঘটায়। রোগী তার মনের মধ্যে একটি যুক্তি নিরোধক প্রকোষ্ট (logic-tight compartment) সৃষ্টি করে এবং তার বিভ্রান্তির বিপরীত তথ্য ও ঘটনাবলীকে সে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে।

চতুর্থতঃ সমকামী প্রবণতা (homosexual tendency) ও অপরাধ বোধ থেকেও এ রোগের সৃষ্টি হতে পারে। প্যারানয়া রোগীদের ব্যক্তিত্ব বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, তাদের মধ্যে একটি শক্তিশালী সমকামী প্রবৃত্তি রয়েছে। ফ্রয়েড প্যারানয়ার কারণ রূপে সমকামিতার ওপরই সম্পূর্ণ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সমকামী তাড়না উচ্চ আদর্শ সম্পন্ন প্যারানয়ার রোগীদের আত্মশ্লাঘার প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়ায় এবং তা পীড়াদায়ক হয়ে পড়ে। ফলে সমকামী প্রবৃত্তিকে দমন করে রাখার জন্য এদের মধ্যে বিপরীত- ক্রিয়া গঠন (reaction formation) হয়। অর্থাৎ সম-লিঙ্গের সদস্যদের প্রতি আকর্ষণ ও অনুরাগবোধ তীব্র ঘৃণা ও বিরাগবোধে পরিণত হয়। কিন্তু এই ঘৃণা ও বিরাগবোধও অসামাজিক হওয়ার তাদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয় না। ফলে এই ঘৃণা ও বিরাগমূলক অনুভূতি তারা অন্যদের ওপর আরোপ করে বা প্রক্ষেপণ (projection) করে। অর্থাৎ অন্য ব্যক্তিরাই তাকে অহেতুক ঘৃনা করে ও তার প্রতি বিরাগ বোধ করে বলে তার মনে হয়। সুতরাং অন্য ব্যক্তিদের সহজেই সে শত্রু বলে ভাবতে শুরু করে এবং এর ফলেই পীড়ন বিভ্রান্তির উৎপত্তি হয়।

এ ধরনের ব্যক্তিদের নীতিবোধ অত্যন্ত প্রখর হয়। সুতরাং অতীতের কৃত কোন দুষ্কর্ম বা ভবিষ্যতে দুষ্কর্ম করার চিন্তাও এদের মনে তীব্র অপরাধ বোধ সৃষ্টি করে। এই পীড়াদায়ক অপরাধবোধ থেকে মুক্তিলাভের জন্যও এরা প্রক্ষেপণ প্রক্রিয়ার আশ্রয় গ্রহণ করে। অর্থাৎ নিজের সব রকম দোষত্রুটি ও অপরাধ সে অন্যদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয় এবং অন্যদেরকে সে অতিরিক্ত মাত্রায় দুর্নীতিপরায়ন ও দুরাচার বলে ভাবতে শুরু করে। এর ফলেও তাদের মধ্যে বিভ্রান্তির উদয় হয়।

প্যারানয়ার চিকিৎসাঃ 

প্যারানয়া রোগীর আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা বেশ হতাশাজনক এদের মধ্যে বিভ্রান্তি একবার দৃঢ়বদ্ধ হয়ে পড়লেই, তা দূর করা দুষ্কর হয়ে পড়ে। কারণ রোগী নিজেকে অত্যন্ত বুদ্ধিমান মনে করে এবং চিকিৎসক বা অন্য যারা তাকে সাহায্য করতে চায়, তাদের সবাইকে সে তুলনামূলকভাবে কম বুদ্ধিমান মনে করে। ফলে অন্যদের যুক্তিতর্ক বা উপদেশ, নির্দেশ ও পরামর্শ তার মনে কোন রূপ রেখাপাত করে না। রোগী নিজস্ব নিপুন যুক্তিতর্ক দিয়ে মনের মধ্যে যে যুক্তি নিরোধক প্রকোষ্ঠ (logic- tight compartment) তৈরী করে, সেখানে বাইরের কোন তথ্য বা যুক্তি প্রবেশ করতে পারে না। তবে মানসিক হাসপাতালে প্রেরণ করলে তাদের অবস্থার কিছু উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। কারণ মানসিক হাসপাতাল থাকাটাকেই এরা শাস্তি স্বরূপ বলে মনে করে এবং এই শাস্তিভোগ থেকে মুক্তিপাওয়ার জন্যই তারা তাদের বিভ্রান্তিকে আর বাইরে প্রকাশ করে না। বিভ্রান্তিকে চেপে রাখার জন্য তাদের সামাজিক অভিযোজনে কিছু উন্নতি ঘটে। তবে তাদের প্রকৃত বিভ্রান্তি দূর হয় না।

উপসংহার: 

সুতরাং চিকিৎসার মাধ্যমে প্রকৃতভাবে এ গোলযোগ নিরাময় করার সম্ভাবনা বেশ কম। তবে রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে দলীয় চিকিৎসায় বেশ সুফল পাওয়া যায়। এছাড়া প্রাথমিক পর্যায়েই বীতরোগ সাপেক্ষীকরণ (aversion conditioning) প্রক্রিয়া প্রয়োগ করে ও রোগের বলীয়ানকারী উপাদান দূর করে রোগ কিছুটা ফলপ্রসূভাবে নিরাময় করা যায়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url