বিচ্ছিন্নতামূলক বৈকল্যের কারণ ও চিকিৎসা
এসব মনোবিকৃতিতে রোগী তার জীবনের এক অংশকে সচেতন মন থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। এই প্রক্রিয়াটি ঘটে অবদমনের সাহায্যে। বস্তুত হিস্টিরিয়ার সাথে বিচ্ছিন্নতামূলক প্রতিক্রিয়ার অনেক মিল রয়েছে। হিস্টিরিয়া রোগে সঙ্কটজনক পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতিবিধান করতে সমর্থ না হওয়ার জন্য ব্যক্তি অসুস্থতার আশ্রয় গ্রহণ করে। কিন্তু বিচ্ছিন্নতামূলক প্রতিক্রিয়ায় ব্যক্তি ঐ একই কারণে বিস্মৃতি অথবা অচেতনতার আশ্রয় নিয়ে থাকে। সবরকম বিচ্ছিন্নতামূলক প্রতিক্রিয়ায় বাস্তবের সাথে সচেতন সংযোগ ব্যাহত বা নষ্ট হয়ে যায় এবং তা থেকে নানারকম লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
বিচ্ছিন্নতামূলক গোলযোগে ব্যক্তির স্মৃতি, চেতনা, আত্মপরিচিতি ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির উপলব্ধি ক্ষতিগ্রস্ত ও ত্রুটিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এই গোলযোগে কয়েক ধরনের স্বতন্ত্র উপসর্গ পরিলক্ষিত হয়। মূলত বিচ্ছিন্নতামূলক গোলযোগে অনন্যোপায় ব্যক্তি তার জীবনের সমস্যা সমাধানের জন্য তার সত্তার কিছু অংশকে মূল সত্তা থেকে নিজের অজ্ঞাতসারেই বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এই বৈশিষ্ট্যের জন্যই উপসর্গগুলোকে সম্মিলিতভাবে বিচ্ছিন্নতামূলক গোলযোগ (dissociative disorder) নামে আখ্যায়িত করা হয়।
বিচ্ছিন্নতামূলক বৈকল্যের কারণ:
১. কপিং মেকানিজম: বিচ্ছিন্নতা অপ্রতিরোধ্য চাপ বা আঘাতমূলক অভিজ্ঞতার সাথে মোকাবিলা করার জন্য একটি মোকাবিলা প্রক্রিয়া হতে পারে। এটি এই ঘটনাগুলির সাথে যুক্ত মানসিক বা শারীরিক ব্যথা থেকে নিজেকে দূরে রাখার উপায় হিসেবে কাজ করতে পারে। স্ত্রীর সাথে তিক্ত সম্পর্কের ফলে চরম অসুখী কোনো ব্যক্তির উদাহরণ আমরা এখানে নিতে পারি। লোকনিন্দা, সামাজিক মর্যাদাহানি বা পুত্র-কন্যার মঙ্গলের জন্য তার পক্ষে স্ত্রীকে ত্যাগ করা সম্ভব নয়। সুতরাং স্ত্রীকে ত্যাগ করাও তার জন্য পীড়াদায়ক, আবার স্ত্রীর সাথে বাস করাও তার জন্য পীড়াদায়ক। এরূপ পীড়াদায়ক উভয় সংকট যখন তীব্র আকার ধারণ করে, তখনই ব্যক্তি তার অচেতন মনের অবদমন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পারিবারিক জীবন বিস্মৃত হতে পারে (আংশিক স্মৃতিভ্রংশ); অথবা সে তার সম্পূর্ণ অতীত জীবনই বিস্মৃত হতে পারে (সম্পূর্ণ স্মৃতিভ্রংশ)। এরূপ স্মৃতিভ্রংশের মাধ্যমে ব্যক্তি এক চরম পীড়াদায়ক উভয় সংকটের কবল থেকে পরিত্রাণ লাভ করে।
২. তীব্র সংকট: তীব্র সংকটের মুখে ব্যক্তির মধ্যে উপর্যুক্ত প্রক্রিয়ায় পলাতক অবস্থা (fugitive state)-এর সৃষ্টি হতে পারে; অর্থাৎ, ক্রমাগত চাপের মুখে ব্যক্তি সম্পূর্ণরূপে আত্মবিস্মৃত হয়ে কোনো দূরবর্তী স্থানে গমন করতে পারে এবং নতুন করে জীবন শুরু করতে পারে।
৩. শৈশব ট্রমা: শৈশবকালে গুরুতর এবং বারবার ট্রমার সংস্পর্শে আসা, যেমন শারীরিক, যৌন বা মানসিক নির্যাতন, অবহেলা, বা আঘাতমূলক ঘটনা প্রত্যক্ষ করা প্রভৃতি ডিসোসিয়েটিভ ডিসঅর্ডারের জন্য সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঝুঁকির কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
৪. জীবনের প্রতিকূল ঘটনা: দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধের অভিজ্ঞতা বা সহিংসতার শিকার হওয়াসহ ট্রমাজনিত ঘটনাগুলি কিছু ব্যক্তির মধ্যে বিচ্ছিন্ন লক্ষণগুলিকে সঞ্চালিত করতে পারে।
৫. অবদমিত ইচ্ছা: স্বপ্নচারিতা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে ব্যক্তির মধ্যে এমন একটি অদম্য বাসনার সৃষ্টি হয়, যা তার মূল ব্যক্তিত্বের কাছে কোনো ক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। এরূপ বাসনা স্বভাবতই অবদমিত হয়ে যায়। কিন্তু এরূপ অবদমিত বাসনা যদি অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তবে তা ঘুমন্ত অবস্থায় বাস্তবায়িত হতে পারে; অর্থাৎ, ঘুমন্ত অবস্থায় অবদমিত আকাঙ্ক্ষাটি ব্যক্তিত্বের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। অথচ মূল ব্যক্তিত্বের কাছে এটা অজ্ঞাত থেকে যায়।
৬. পরস্পর-বিরোধী প্রবৃত্তি ও প্রবণতা: মানুষের মধ্যে কম-বেশি পরস্পর-বিরোধী প্রবৃত্তি ও প্রবণতা রয়েছে। স্বাভাবিক মানুষ সাধারণত তার অহম শক্তি দিয়ে এগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করে চলতে পারে। তবু মাঝে মাঝে স্বাভাবিক মানুষের মধ্যেও এমন স্ববিরোধী আচরণ প্রকাশ হয় যে, ব্যক্তি নিজেই আশ্চর্যান্বিত হয়ে পড়ে। 'আমি সম্পূর্ণ আত্মবিস্তৃত হয়ে পড়েছিলাম' বা 'আমার মধ্যে আর আমি তখন ছিলাম না', প্রভৃতি ব্যাখ্যাদান করা ছাড়া ব্যক্তির আর কোনো গত্যান্তর থাকে না। তবে স্বাভাবিক মানুষের মধ্যে এরূপ স্ববিরোধী আচরণ কদাচিৎ ঘটে এবং তা অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী হয়। বহুধা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রোগীর ক্ষেত্রে এই প্রবণতাই অতিরঞ্জিত ও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিত্বের উদ্ভব ঘটায়।
বিচ্ছিন্নতামূলক বৈকল্যের চিকিৎসা
১. হিপনোটিজম: সংবেশন চিকিৎসা-পদ্ধতির মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতামূলক গোলযোগের অবদমিত কারণ সরাসরি রোগীর সামনে তুলে ধরে তার অন্তর্দৃষ্টি উন্মোচন করা যায় এবং এভাবে তার রোগ নিরাময় করা যায়। তবে এধরনের রোগ নিরাময় স্থায়ী হয় না। স্থায়ী রোগ নিরাময়ের জন্য ব্যক্তিত্বের পুনর্গঠন প্রয়োজন হয়।
২. মনোসমীক্ষণ: মনোসমীক্ষণিক চিকিৎসা-পদ্ধতির দ্বারা রোগীর অচেতন মনকে ক্রমে ক্রমে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করে তার মৌলিক দ্বন্দ্বের নিরসন করা যায় এবং তার ব্যক্তিত্ব পুনর্গঠন করা যায়।
৩. মক্কেলকেন্দ্রিক চিকিৎসা-পদ্ধতি: রোগী কেন্দ্রিক চিকিৎসা-পদ্ধতিতেও রোগী এমন একটি নিরপেক্ষ ও নির্বিচারমূলক পরিবেশ পায়, যাতে সে নিজেই তার অবদমিত দ্বিধা দ্বন্দ্বগুলোকে ক্রমে ক্রমে বিশ্লেষণ করে তা কাটিয়ে উঠতে পারে এবং নিজেই একটি বাস্তব পদক্ষেপ নিয়ে তার সমস্যার সমাধান করতে পারে।
উপসংহার:
বিচ্ছিন্নতামূলক গোলযোগের রোগীদের ব্যক্তিত্ব বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে তাদের ব্যক্তিত্ব হিস্টিরিয়া রোগীর অনুরূপ হয়। এদের ব্যক্তিত্ব সাধারণতঃ অন্তর্মুখী হয়। আত্মপ্রত্যয়ের অভাব হেতু এরা পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং জীবনের সাধারণ সমস্যা মোকাবিলা করতে গিয়ে তারা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। এদের আত্মসম্মানবোধ ও নীতিবোধ অত্যন্ত প্রখর হওয়ায় এরা শঠতার আশ্রয় নিতে পারে না। ফলে অনন্যোপায় হয়ে এরা অজ্ঞাতসারে রোগের উপসর্গ গঠনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের প্রয়াস পায়।