বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার: দ্বিমেরু বৈকল্যের লক্ষণ, কারণ ও চিকিৎসা
সিজোফ্রেনিয়া একটি আবেগমূলক মনোবিকার। আবেগমূলক মনোবিকারের যে কয়টি শ্রেণিবিভাগ আছে তন্মধ্যে দ্বিমেরু বৈকল্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে দ্বিমেরু বৈকল্য আলোচনা করা হলো-
দ্বিমেরু গোলযোগ বা দ্বিমুখী আচরণ বৈকল্য:
Kraplin-এর মতে, উল্লাস এবং বিষণ্ণতাবোধ দুটো একই সঙ্গে একই রোগের মধ্যে সৃষ্টি হয় বলে এটাকে দ্বিমেরু বৈকল্য বলে। সাধারণত প্রথমে উঞ্জাসমূলক পর্যায়ে এর আবির্ভাব হয়। পরবর্তীকালে বিষণ্ণতামূলক পর্যায়ে এর আবির্ভাব হয় অনেক সময় এই দুই পর্যায়ের মাঝখানে একটি স্বাভাবিক পর্যায় থাকে যে সময় ব্যক্তি তুলনামূলকভাবে সুস্থ থাকে। কোনো কোনো সময় দুই পর্যায়ের মাঝে কোনো স্বাভাবিক অবস্থা থাকে না। এক পর্যায় থেকে ব্যক্তি সরাসরি এর বিপরীত পর্যায়ে চলে যায়। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ১টি পর্যায় চলতে থাকে। কিছু বিরল রোগীর ক্ষেত্রে এই পর্যায়ের পরিবর্তন অত্যন্ত দ্রুত ঘটে। এটাকে দ্রুত চক্রাকারে ধরন বলা হয়। এদের মধ্যে মনোদৈহিক অসুবিধা রয়েছে।
দ্বিমেরু বৈকল্যের মূল্যায়ন মানদণ্ড:
এখানে Manic লক্ষণ অতিরিক্ত মাত্রায় দেখা যায়। সামাজিক ও পেশাগত ক্ষমতা কমে যায়। এই লক্ষণগুলো সার্বক্ষণিক ভাবে ১ সপ্তাহ থাকে লক্ষণগুলোর সাথে অন্যান্য লক্ষণগুলো কমপক্ষে ৩টা বা অধিক থাকবে। অন্য লক্ষণগুলো হচ্ছে-
- লক্ষ্যের স্থিরতা থাকে না।
- অস্থিরতা সব সময় থাকে বলে সবসময় ব্যস্ত হবার প্রবণতা দেখা যায়।
- অতিরিক্ত মাত্রায় কথা বলে।
- বেশি লেখে।
- মনোযোগের অভাব।
- ঘুমের চাহিদা আস্তে আসে কমে যায়।
মেজর ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডারের তুলনায় দ্বিমেরু বৈকল্য সাধারণত কম সংখ্যক লোকের হয়। পুরুষ ও মহিলা উভয়ের ক্ষেত্রে এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা সমান। সাধারণত উচ্চবিত্ত স্তরের লোকদের এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কোনো কোনো সময় একই পরিবারভুক্ত একাধিক সদস্যের মধ্যে দেখা যায়। এ রোগের কারণরূপে বংশগতির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
দ্বিমেরু বৈকল্যের ধরন:
মেজর ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডারের মতো দ্বিমেরু বৈকল্য ও বিষন্নতার মাত্রা তিন রকম হতে পারে অর্থাৎ মধ্য, মাঝারি ও চরম মাত্রায় বিষণ্ণতা হতে পারে। উচ্ছ্বাসমূলক অবস্থার ও মাত্রাগত পার্থক্য দেখা যায়, আবার একই রোগীর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে উচ্ছ্বাসের মাত্রাভেদ ঘটতে পারে। উচ্ছ্বাসের মাত্রাভেদ অনুসারে নিম্নোক্ত তিন রকমের অবস্থা রোগীর মধ্যে দেখা যেতে পারে।
ক. মৃদু উচ্ছ্বাস (Hypomania): স্বল্প মাত্রায় উল্লাসবোধ ও উত্তেজনা এবং অতিরিক্ত কর্মব্যস্ততাই এ গোলযোগের মূল লক্ষণ। রোগী কোনো সময়েই নিশ্চল ও নিশ্চুপ থাকতে পারে না। বহুমুখী পরিকল্পনার অধীনে সারা দিনমান রোগী নিজেকে বিভিন্ন কার্যকলাপে নিয়োজিত রাখে। এদের অত্যন্ত সক্রিয় ও উদয়মান ব্যক্তি বলে মনে হয়। কিন্তু একটু লক্ষ করলেই দেখা যায় যে এদের সব কাজই সম্পূর্ণ অহেতুক ও অর্থহীন কাজ। আসলে মানসিক উত্তেজনাকে প্রশমন করার জন্যই এর উদ্দেশ্যহীনভাবে নিজেদেরকে বিভিন্ন কাজে ব্যাপৃত রাখে। আপাত দৃষ্টিতে এদের আচরণ বাস্তব বর্জিত বলে মনে হয় না, কিন্তু মানসিক উত্তেজনা ধৈর্যহীনতা ও একাগ্র মনোযোগের অভাব এদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে গুরুতরভাবে ব্যাহত করে।
খ. মাঝারি ধরন (Acute mania): এক্ষেত্রে উল্লাসবোধ ও উত্তেজনা তুলনামূলকভাবে অনেক বেড়ে যায়। কোনো কোনো সময় রোগীর মধ্যে সরাসরি বিষমোচ্ছ্বাস দেখা দিতে পারে, আবার কোনো কোনো সময় মৃদু উচ্ছ্বাস ক্রমান্বয়ে বিষমোচ্ছ্বাসে পরিণত হতে পারে। এ সময় ব্যক্তি এক অদম্য সুখোচ্ছ্বাস বোধ করে এবং তার মনোদৈহিক উত্তেজনা এত বেড়ে যায় যে সে তা চেপে রাখতে পারে না। ফলে তার মধ্যে লক্ষণীয় ভাবে অসংগত ও অসংযত আচরণের সৃষ্টি হয়। রোগী অস্থিরভাবে প্রচারণা করে অত্যন্ত উচ্চস্বরে কথা বলতে শুরু করে, অকারণে অট্টহাসি হাসে। এদের যৌনমূলক উত্তেজনা বেড়ে যায় এবং উত্তেজিত হয়ে এরা অশ্লীল আচরণ করে। আহারের প্রতি এদের অনীহতা দেখা যায়, তবে আনন্দে সময় এরা অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতার সাথে আহার্য দ্রব্য গলাধঃকরণ করে। বাস্তবের সাথে এদের যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে যায়। এদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তি পরিলক্ষিত হয় এবং বিভ্রান্তি অনুযায়ী বিভিন্ন অলীক প্রত্যক্ষণও ঘটে।
গ. বিকারোচ্ছ্বাস (delirious mania): এদের মনোদৈহিক উত্তেজনা চরম মাত্রায় উপনীত হয়। কোনো কোনো সময় সরাসরি বিকারোচ্ছ্বাস রোগীর মধ্যে সৃষ্টি হয়। আবার কোনো কোনো সময় বিষমোচ্ছ্বাস ক্রমান্বয়ে বিকারোচ্ছ্বাসে পরিণত হয়। এই অবস্থায় রোগীর উল্লাস ও উত্তেজনা এত তীব্র হয়ে পড়ে যে রোগী সম্পূর্ণ রূপে বিকারগ্রস্ত ও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং হিতাহিতজ্ঞানসম্পূর্ণ রূপে রহিত হয়। বিকট চিৎকার ও হৈ-চৈ করা, উচ্চস্বরে গালি-গালাজ করা, তারস্বরে গান করা, উত্তেজিতভাবে তাণ্ডবনৃত্য করা, ধ্বংসাত্মক কাজ করা প্রভৃতি উচ্ছৃঙ্খল ও অসংযত আচরণ প্রায় সব সময় তাদের মধ্যে দেখা যায়। উত্তেজনার মুহূর্তে এরা নিজেদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকৃত ও বিনষ্ট করতে পারে কিংবা আত্মহত্যা করতে পারে এবং অন্যদেরও মারাত্মক ক্ষতিসাধন করতে পারে। এরা উত্তেজনার মুহূর্তে প্রকাশ্যে যৌনাঙ্গ প্রদর্শন করা আত্মরতিতে নিমগ্ন হওয়া, প্রকাশ্যে ধর্ষণের চেষ্টা করা প্রভৃতি অশ্লীল আচরণও করে থাকে। এদের মধ্যে উদ্ভট প্রকৃতির বিভ্রান্তি ও অলীক প্রত্যক্ষণের উপসর্গও দেখা যায়।
DSM-VI দ্বিমেরু বৈকল্যকে দুটা শ্রেণিতে ভাগ করেছে। যথা:
- দ্বিপ্রান্ত বৈকল্য-১
- দ্বিপ্রান্ত বৈকল্য-২
দ্বিপ্রান্ত বৈকল্য-১ এর ক্ষেত্রে কমপক্ষে একটি উচ্ছ্বাসমূলক পর্ব থাকে এবং একটি বিষণ্ণতামূলক পর্ব থাকতেও পারে, আবার না-ও থাকতে পারে। যদি বিষণ্ণতা পর্ব না-থাকে, তবে ধরে নেওয়া হয় যে ভবিষ্যতে কোনো এক সময় বিষণ্ণতামূলক পর্বের আবির্ভাব ঘটবে।
দ্বিপ্রান্ত বৈকল্য-২ এর কমপক্ষে একটি বিষণ্ণতামূলক পর্ব থাকে এবং কমপক্ষে একটি স্বল্পমাত্রার উচ্ছ্বাসমূলক পর্ব থাকে। উল্লেখ্য যে এদের উচ্ছ্বাসের মাত্রা কোনো সময়ই তীব্র হয় না।
দ্বিপ্রান্ত বৈকল্যে ব্যক্তির মধ্যে উচ্ছ্বাস ও বিষণ্ণতার পর্ব পালাক্রমে ঘটতে থাকে। উচ্ছ্বাস ও বিষন্নতার মাত্রা কম থাকলেও ব্যক্তির মধ্যে এই পালাক্রমে আবেগের পরিবর্তন প্রায় স্থায়ী হয়ে পড়ে; অর্থাৎ এই পর্যাক্রমিক আবেগের পরিবর্তন ব্যক্তির সারা জীবনের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। ডিসথাইমক ডিজঅর্ডারের মতে এ রোগেরও সূত্রপাত তরুণকালে ঘটে এবং লক্ষণসমূহ ধীর গতিতে বিকাশ লাভ করে।
দ্বিমেরু বৈকল্যের কারণ:
সিজোফ্রেনিয়ার মতো দ্বিমেরু বৈকল্যের সুস্পষ্ট কারণ এখনও উদ্ঘাটিত হয়নি। তবে কতকগুলো অবস্থাকে এ রোগের সম্ভাব্য কারণ রূপে বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন এবং এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য তারা নিরন্তর গবেষণামূলক কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। দ্বিমেরু বৈকল্যের সম্ভাব্য কারণগুলো হলো-
১. বংশধারামূলক কারণ: ব্যাপক পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা গেছে যে স্থানিক ডিপ্রেসিভ রোগীদের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে এ রাগের প্রাদুর্ভাব বেশি। পরিবারের একজনের এ রোগ থাকলে খেলার এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা ২৫% কিন্তু স্বাভাবিক লোকদের মধ্যে এ রোজ হওয়ার সম্ভাবনা ৫%। মনোবিজ্ঞানী Kattman (1955-58) একটি পর্যালোচনা থেকে দেখেন যে এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা হলো অভিন্ন যমজের ক্ষেত্রে ৯৫.৭% ভিন্ন যমজের ক্ষেত্রে ২৬% ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ১৬% পিতামাতার মধ্যে ১৫% এবং সাধারণ ভাইবোনদের ক্ষেত্রে ১৩%। এ থেকে বলা যায় দ্বিমেরু বৈকল্যের মূলে বংশধারামূলক উপাদান বিদ্যমান।
২. জৈব রাসায়নিক কারণ: প্যাভলভ গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, সিজোফ্রেনিয়ার কার্যাবলিকে বাধা দিলে ডিপ্রেসিভ টাইপের লক্ষণ প্রকাশ পায়। ক্রেৎসমার এবং শেলভন শারীরিক গঠনের সাথে এ রোগের সম্পর্কের কথা বলেছেন। ক্রেৎসমারের মতে, পিকনিক টাইপ লোকদের ক্ষেত্রে এবং শেলডনের মতে এন্ডোমর্ফিক এবং মেসোমর্ফিক শ্রেণির লোকদের ক্ষেত্রে এ রোগের হার বেশি। রাসায়নিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে রক্তের Catecholamine নামক উপাদানের সাথে এ রোগের সম্পর্কের সম্ভাবনা রয়েছে। রক্তে যদি Catecholamine-এর মাত্রা বেড়ে যায় তবে আবেগীয় বৈকল্যের লক্ষণ প্রকাশ পায় এবং রক্তে ঐ উপাদানের পরিমাণ কমে গেলে ডিপ্লেসেভ টাইপের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
৩. মনোবৈজ্ঞানিক কারণ: ব্যক্তিত্বের পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যারা খুব বেশি কর্মঠ, উচ্চাভিলাষী এবং বাইরে বেড়াতে পছন্দ করে তাদের এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এছাড়া যে সকল পরিবার প্রতিযোগী অমূলক মনোভাব বেশি সে পরিবারের লোকদের এ রোগের সম্ভাবনা বেশি থাকে অনেকে নিজের দোষ ঢাকার জন্য আবার কেউ উপযুক্ত সামাজিক স্বীকৃতি না পাওয়ার দরুন তাদের মধ্যে এ ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের যেতে পারে। এছাড়া কোনো প্রিয়জনের মৃত্যু ঘটলে আপনজনের সাথে সম্পর্কের হানি ঘটলে এবং আশানুরূপ সাফল্যাঙ্ক ব্যর্থ হলেও ব্যক্তির মধ্যে এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে।
৪. সামাজিক কারণ: প্রায় সকল প্রকার সামাজিক অর্থনৈতিক স্তরেই এ রোগের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। মনোবিজ্ঞানী Holiugshed and Redlech (1958) দেখিয়েছেন ধনীদের তুলনায় দরিদ্রদের বেলায় এ রোগের সম্ভাবনা বেশি থাকে। আবার Jaco (1960) দেখিয়েছেন উচ্চশিক্ষিত, উচ্চ পেশা এবং উচ্চ অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্তরের লোকদের ম্যানিক ডিপ্রেসিভ সাইকোসিস বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া গ্রামের তুলনায় শহরে সমাজে এ রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি হতে দেখা যায়।
দ্বিমেরু বৈকল্যের চিকিৎসা:
দ্বিমেরু বৈকল্যের চিকিৎসাগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১. মনঃসমীক্ষণমূলক চিকিৎসা:
মনঃসমীক্ষণ-তত্ত্ব অনুসারে মনে করা হয় যে ব্যক্তির, হতাশা, কোনো কিন্তু হারানোর বেদনা বা ক্রোধ যখন বহির্মুখী না-হয়ে ব্যক্তির নিজের প্রতি ধাবিত হয়। তখনই বিষণ্ণতা দেখা দেয়/সেজন্য মনঃসমীক্ষণ-পদ্ধতির চিকিৎসায় ব্যক্তির অবদমিত দ্বন্দ্বগুলোর প্রতি অন্তর্দৃষ্টি লাভ করতে হয় এবং ব্যক্তিরা নিজের প্রতি ক্রোধকে বাইরে প্রকাশ করার জন্য উৎসাহিত করা হয়। মনঃসমীক্ষণ-পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তির প্রচ্ছন্ন তাগিদ/চাহিদাগুলোকে জানা-যেগুলো তার বিষণ্ণতার জন্য দায়ী। উদাহরণ স্বরূপ একজন হয়ত তার তার মা-বাবা তাকে স্নেহ করে না বলে নিজের উপর দোষ দিতে পারে। কিন্তু এই বিশ্বাস তার মধ্যে বেদনা ও ক্রোধ সৃষ্টি করে বলে সে তা অবদমন করে। চিকিৎসক রোগীকে এমনিভাবে পরিচালিত করবেন যেন সে তার ঐ অবদমিত বিশ্বাসটির সম্মুখীন হতে পারে। তারপর তিনি রোগীকে সাহায্য করবেন যাতে সে বুঝতে পারবে যে তার অপরাধবোধটি অযৌক্তিক। শৈশবের যেসব বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা থেকে অক্ষমতা বোধ ও হতাশা জন্ম নিয়েছে সেগুলো পুনরুদ্ধার করা হলে অসুখ ভালো হয়ে যেতে পারে। তবে একটি বিশেষ ধরনের মনঃসমীক্ষণ-পদ্ধতি আর নাম আন্তঃব্যক্তিক চিকিৎসা (IPT)-এর কার্যকারিতা প্রমাণ হয়েছে। এই পদ্ধতিটি প্রবর্তন করেছেন ক্লারম্যান ও ওয়াইজম্যান। এই পদ্ধতিতে চিকিৎসক বিষন্নতায় আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে সামাজিক পরিবেশের বর্তমান কালের পারস্পরিক ক্রিয়ার উপর শুরুর আরোপ করেন। এই পদ্ধতির মূল কৌশলটি হচ্ছে যে, রোগীর যেসব আচরণ সামাজিক সম্পর্ক থেকে আনন্দ উপভোগ করতে বাধা দেয়, রোগীকে সেগুলো পরীক্ষা করতে সাহায্য করা।
২. জ্ঞানীয় ও আচরণমূলক চিকিৎসা-পদ্ধতি:
জ্ঞানীয় তত্ত্ব অনুসারে মনে করা হয় যে, বিষণ্ণতায় আক্রান্ত রোগীর গভীর দুঃখবোধ এবং আত্মমর্যাদা বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ার মূল কারণ হলো ঐসব ব্যক্তির ভুল/ত্রুটিপূর্ণ চিন্তাধারা। বেক ও সঙ্গীরা বিষণ্ণতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনুপযোগী চিন্তাধারা পরিবর্তন করার জন্য একটি জ্ঞানীয় চিকিৎসক বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে এবং ব্যক্তির নিজের সম্বন্ধে রোগীর যেসব মতামত থাকে সেগুলো বদলাতে চেষ্টা করেন; যেমন, রোগী যখন বলে যে সে একটি অপদার্থ লোক, তার কোনো কাজই সঠিকভাবে হচ্ছে না, এবং সে যে কাজেই হাত দেয় তাই নষ্ট হয়ে যায়। এক্ষেত্রে চিকিৎসক কতকগুলো বিপরীত দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন যেগুলোতে ব্যক্তি কিছু না কিছু সাফল্য পেয়েছে বা তিনি তার অন্যান্য ক্ষমতাগুলো সম্বন্ধে তাকে অবহিত করেন যেগুলো রোগী এড়িয়ে গেছে।
বেকের চিকিৎসা-পদ্ধতিতে কতকগুলো আচরণগত কৌশলকে ও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে; যেমন:
- বেক রোগীদের কিছু করতে দেন- যেমন সকালে ঘুম থেকে ওঠা বা হাঁটতে বা বেড়াতে যাওয়া।
- তিনি রোগীদের কিছু দায়িত্বপূর্ণ কাজ দেন যেগুলো সম্পন্ন করলে রোগীরা ইতিবাচক বা সন্তোষজনক অভিজ্ঞতা হয় এবং তারা নিজেদের সম্বন্ধে ভালো চিন্তা করতে পারে।
কিন্তু মূল চিকিৎসাটি হলো জ্ঞানীয় পুনঃগঠন এই পদ্ধতিতে ব্যক্তিকে আলাদাভাবে চিন্তা করতে শেখানো। বেক মনে করেন ব্যক্তির চিন্তাধারা পরিবর্তন না করে শুধু আচরণ পরিবর্তন করে স্থায়ী সুফল পাওয়া যায় না। বিভিন্ন মনোচিকিৎসা-পদ্ধতির সঙ্গে ভেষজ চিকিৎসার তুলনা করে ডেভিসন ও তার সহকর্মী (Davison and Neale 1998) বলেছেন যে, জ্ঞানীয় চিকিৎসা- পদ্ধতির ফলাফল ভালো হলেও এটি ইমিগ্রামিনের মাধ্যমে বা আন্তঃসামাজিক সম্পর্কের মাধ্যমে চিকিৎসার চেয়ে বেশি কার্যকরী কিনা তা বলা সম্ভব নয়।
৩. জৈবিক চিকিৎসা:
অনেক ধরনের জৈবিক চিকিৎসা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে দুটি প্রধান পদ্ধতি হলো:
i. তড়িতাঘাতমূলক: সর্বপ্রথম সারলিটি এবং যিনি নামক দুজন ইটালীয় চিকিৎসক উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেও চিকিৎসা-পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন। সারলিটি মৃগী রোগ নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তিনি চেষ্টা করেছিলেন কীভাবে কৃত্রিমভাবে মৃগী রোগের দেহের কম্পন তৈরি করা যায়। তিনি বিদ্যুৎপ্রবাহ স্বল্পক্ষণের জন্য চালিত করে তার পরীক্ষণ পরিচালনা করেন। তিনি মানুষদের নিয়ে পরীক্ষণ করলেন। তিনি লক্ষ করলেন মানুষের মাথার পার্শ্বে তড়িতাঘাত প্রয়োগ করে মৃগী রোগের মতো কম্পন সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি রোমে ১৯৩৮ সালে সর্বপ্রথম একজন সিজোফ্রেনিয়া রোগীর চিকিৎসার জন্য এ পদ্ধতি প্রয়োগ করেন।
এরপর থেকে সিজোফ্রেনিয়া এবং বিষণ্ণতার রোগীদের চিকিৎসার জন্য মস্তিষ্কের দুপাশে তড়িতাঘাত প্রয়োগে চিকিৎসা করা হচ্ছিল। পদ্ধতিটি হলো এই যে, রোগীর মস্তিষ্কের মধ্য দিয়ে অতি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ৭০ থেকে ১৩০ ভল্ট তীব্রতা সমান বিদ্যুৎপ্রবাহ চালিত করে রোগীর মধ্যে মূর্খ এবং অচৈতন্য অবস্থা সৃষ্টি করে।
এই পদ্ধতিটি শুধু তীব্র বিষন্নতা এবং সিজোফ্রেনিয়ার ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়, অন্য কোনো অসুখে নয়। তবে পদ্ধতিটি কষ্টদায়ক, এবং অন্যান্য চিকিৎসায় কাজ না হলে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
ii. ঔষধের মাধ্যমে চিকিৎসা: মেজাজের বিকৃতির চিকিৎসার জন্য জৈবিক ঔষধ এবং রাসায়নিক ঔষধ উভয় ধরনের ঔষধ খুব কার্যকরী বলে প্রমাণ হয়েছে। তবে এসব ঔষধ সবার জন্য কাজ করে না এবং এগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কোনো কোনো সময় গুরুতর হতে পারে। এগুলোর উপযুক্ত মাত্রা (Dose) নির্ধারণ করা বেশ জটিল ব্যাপার। বিষণ্ণতার কারণ অনুসন্ধানের যেসব জৈবিক শর্ত নিয়ে গবেষণা হয়েছে সেগুলো আলোচনা করতে গিয়ে আমরা তিন শ্রেণির বিষন্নতাবিরোধী ঔষধের কথা বলেছিলাম; যেমন:
- তিন চক্র বিশিষ্ট ঔষধ যথা ইমিগ্রামিন (টোফ্রানিয়লা) এমিট্রিপচাইলিন বিশেষমার্কা হলে ইলাভিন।
- নির্বাচিত সেরোটনিন পুনঃগ্রহণ অবদমনকারী ঔষধ (Selective serotonin reuptake inhibitors) যেমন- ক্রোপ্রেটিন (সোজাক)
- মনোএমাইন অক্সাইডেজ অবদমনকারী ঔষধ; সংক্ষেপে MAO। এ ধরনের একটি ঔষধ হলো পারনেট। মেজাজের বিকৃতির চিকিৎসায় মনোএমাইন অক্সাইডেজ অবদমনকারী ঔষধ ব্যতীত অন্য ঔষধগুলো বেশি জনপ্রিয়। নির্ধারিত মাত্রায় বেশ কিছুদিন ঔষধ খেলে ৬৫% থেকে ৭০% রোগী আরোগ্য লাভ করে। সব সময়ই বিষণ্নতাবিরোধী ঔষধও মনোচিকিৎসা একত্রে ব্যবহার করলে সবচেয়ে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। যাদের মেজাজ ওঠানামা করে যেমন দ্বিমুখী বিকৃতি সেসব রোগীর জন্য লিথিয়াম একটি ভালো ঔষধ। এটি লিথিয়াম কার্বনেট লবণ হিসেবে গ্রহণ করতে হয়। এই ঔষধ সেবনে রোগী ৮০% আরোগ্য লাভ করে। তবে রক্তে এর বিষক্রিয়া দেখা দিতে পারে বলে মাঝে মাঝে রক্ত পরীক্ষা করা উচিত।