অস্বভাবী আচরণের জৈবিক কারণসমূহ

পরিণত জীবনে ব্যক্তির উপর বংশধারা ও পরিবেশের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে যদি কোনো ত্রুটি বা অসম্পূর্ণতা দেখা দেয় তাহলে ব্যক্তির আচরণের মধ্যে অস্বাভাবিকতার সৃষ্টি হয়। 

অস্বভাবী আচরণকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করার জন্য মনোচিকিৎসকগণ অস্বভাবী আচরণের কারণসমূহকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করেছেন; যথা- জৈবিক কারণ, মনোবৈজ্ঞানিক কারণ ও সমাজ-সাংস্কৃতিক কারণ। 

সঠিক ও উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য তাকে প্রথমেই অস্বভাবী আচরণের কারণ উদ্ঘাটন করতে হয়। অস্বভাবী আচরণের কারণ যত দ্রুত চিহ্নিত করা যাবে তত দ্রুত এর প্রতিকার করা সম্ভব হবে।

অস্বভাবী আচরণের শারীরবৃত্তীয়/জৈবিক কারণ যেসব শর্ত উপস্থিত থাকলে আমাদের শারীরিক গঠন, স্নায়ুমণ্ডলী ও অন্যান্য শারীরযন্ত্রের অস্বভাবী বিকাশ ঘটে সেসব শর্তকে অস্বভাবী আচরণের গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় কারণ বলে মনে করা হয়। ত্রুটিপূর্ণ জৈবিক বিকাশ অনেক ক্ষেত্রে বংশগতি ও পরিবেশগত উপাদানের ফলে ঘটে থাকে। নিম্নে অস্বভাবী আচরণের শারীরবৃত্তীয় বা জৈবিক কারণসমূহ আলোচনা করা হলো: 

১. বংশগতি (Heredity): 

বংশগতির প্রকৃতির ভিত্তি হচ্ছে ক্রোমোসোম ও জিন (Genes)। বিভিন্ন মানসিক বিকৃতির ক্ষেত্রে বংশধারাগত ত্রুটিগুলো সুনির্দিষ্টভাবে নির্ণয় করা সম্ভবপর না-হলেও বংশগত ত্রুটি থেকে যে নানাপ্রকার অস্বাভাবিকতার সৃষ্টি হতে পারে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। সিজোফ্রেনিক প্রতিক্রিয়া ও ম্যানিক-ডিপ্রেসিভ সাইকোসিসে জিনের বংশানুক্রমিক প্রভাব আছে বলেই মনে হয়।

ক. ক্রোমোজোমের (Chromosome): মায়ের গর্ভে মায়ের একটি কোষ এবং পিতার একটি কোষের মিলনে শিশুর জন্ম হয়। প্রথম যে কোষটি থেকে শিশুর জন্ম শুরু হয় সেই কোষটিতে থাকে মায়ের কাছ থেকে পাওয়া ২৩টি ক্রোমোজোম এবং বাবার কাছ থেকে পাওয়া ২৩টি ক্রোমোসোম, মোট ৪৬টি বা ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম। এর মধ্যে ২২ জোড়া ক্রোমোজোমকে বলা হয় অটোজোমস (Autosomes) যা শিশুর দেহের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুলোর স্বরূপ ও প্রকৃতি নির্ণয় করে। আর ২৩নং জোড়াটিকে যৌনতানির্দেশক ক্রোমোজোম (Sex determining Chromosome) বলে। এরাই নবজাতকের লিঙ্গকে নির্ণয় করে অর্থাৎ শিশু ছেলে হবে কি মেয়ে হবে তা নির্ধারণ করে।

যৌনতা-নির্দেশক ক্রোমোজোমের জোড়াকে যথাক্রমে 'XX' এবং 'XY' দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। 'XX' মেয়েদের যৌনতা- নির্দেশক আর 'XY' ছেলেদের যৌনতা-নির্দেশক।

জনন বিজ্ঞানের (Genetics) উপর আধুনিক গবেষণা থেকে একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণ হয়েছে যে, ক্রোমোজোমের স্বাভাবিক সংখ্যা (২৩ জোড়া) এবং সংগঠনের মধ্যে কোনো রকম পার্থক্য বা বৈষম্য দেখা যায় তাহলে শিশুর মধ্যে নানা ধরনের অস্বাভাকিকতার সৃষ্টি হয়; যেমন, ২১ নং জোড়ার ক্রোমোজোমের ব্যতিক্রমে 'মোঙ্গলিজম' (Mongolism) নামক অস্বভাবিতা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে ২১নং ক্রোমোজোমের স্বাভাবিক সংখ্যা দুই না-হয়ে তিন হয়। দুটি ক্রোমোজোমের জায়গায় তিনটি ক্রোমোজোম থাকায় নাম দেওয়া হয়েছে ট্রাইজোমি (Trisomy)। মোঙ্গলদের বুদ্ধ্যঙ্ক স্বাভাবিকের চেয়ে নিম্নমানের হয়। তেমনই ক্লাইন ফেল্টারস্ সিনড্রোম (Kline felters Syndrome) নামক আর এক ধরনের অস্বাভাবিকতার ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, ২৩নং ক্রোমোজোম 'XX' বা 'XY' না হয়ে 'XXY' হয়। এদের ব্যবহারিক জীবনে বা আচরণে অস্বাভাবিতা দেখা দেয়। ক্রোমোজোমের ত্রুটিজনিত বিকৃতির আর একটি উল্লেখযোগ্য ধরন হলো টারনার সিনড্রোম (Turner Syndrome)। এক্ষেত্রে যৌনতা-নির্দেশক ক্রোমোজোমের প্রকাশ XX বা XY না হয়ে 'XO' হয়। এদের যৌনজীবন নিম্নমানের হয়। উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, ক্রোমোজোমগত ত্রুটি বা অসংগতি থেকে মানসিক অস্বভাবিতা যত না সৃষ্টি হয় তার চেয়ে বেশি হয় শারীরিক অস্বভাবিতা।

খ. জিনের (Gene) ত্রুটিজনিত মনোবিকৃতি: ক্রোমোজোমের গঠন, সংখ্যা এবং বিন্যাসে ত্রুটি থাকলে যেমন মানসিক, ও শারীরিক অস্বভাবিতা দেখা দিতে পারে তেমনই ক্রোমোজোমের অভ্যন্তরস্ত জিনের মধ্যে কোনো দোষ থাকলেও শিশুর মধ্যে অস্বভাবিতা সৃষ্টি হতে পারে। প্রত্যেকটি জিনের জৈব-রাসায়নিক উপাদান হচ্ছে ডিঅক্সি-রাইবোনিউক্লিক এসিড সংক্ষেপে যাকে DNA বলা হয়। বংশধারাগত জাতকের সব বৈশিষ্ট্য-নির্দেশই সাঙ্কেতিকভাবে জিন বা DNA দ্বারা চিহ্নিত। জিন বা DNA জাতকের ভবিষ্যৎ-জীবনের পরিকল্পনার ব্লু-প্রিন্ট ও তাদের পথনির্দেশক বা চালক।

জিনের অভ্যন্তরীণ প্রকৃতি, সংগঠন এবং উপাদানের মধ্যে যদি কোনো দোষ বা অসম্পূর্ণতা থাকে তাহলে তাকে 'জিবিকৃতি' (Gene mutation) বলা হয় এবং এ ধরনের জিনকে বিকৃত জিন (mutant gene) নাম দেওয়া হয়। বিকৃত জিন থেকে জৈব-রাসায়নিক ত্রুটি ও মানসিক ত্রুটি দেখা দেয়। এসব অস্বভাবিকতার মধ্যে ফেনিলকিটোনুরিয়া (Phenylketonuria) বা PKU হানটিংটনস কোরিয়া (Huntinton's Chorea) নামে রোগটিও জিন বিকৃতির জন্য ঘটে থাকে।

গ. পরিবারের ইতিহাস বিশ্লেষণ ও যমজ সন্তানের পর্যবেক্ষণ (Family history and twin studies): বিভিন্ন পরিবারের ইতিহাস বিশ্লেষণ ও যমজ সন্তানের পর্যবেক্ষণ থেকে মানসিক রোগের উত্তরাধিকার সম্বন্ধে অনেক মূল্যবান তথ্য আহরণ করা গেছে। কুখ্যাত কালিকাক (Kallikaks) এবং ইয়ুকস (Jukes) পরিবারের পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা গেছে যে, মানসিক রোগ পরিবারের এক পুরুষ থেকে আর এক পুরুষে সঞ্চালিত হয়। কলম্যান (Kallmann, 1937) যমজ সন্তানদের নিয়ে গবেষণা করে দেখেন যে, অভিন্ন কোষী যমজদের (Identical twins) একজনের মনোবিকৃতি হলে অন্যজনের মনোবিকৃতি হবার সম্ভাবনা ৮৬.২% এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে এই মনোবিকৃতি ০.৮৫% ব্যক্তির ক্ষেত্রে দেখা যায়।

২. দৈহিক গঠনজনিত ত্রুটি (Constitutional Defects): 

প্রত্যেক মানুষের জীবনের প্রথম পাঁচ বছরই তার দৈহিক সংগঠনকে সৃষ্টি করে। এই সংগঠন তার সমগ্র জীবনে ও তার দৈহিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবান্বিত করে। শেলডন (Sheldon, 1948) মানুষের দৈহিক গঠন অনুসারে সমস্ত মানুষকে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন:

i. এন্ডোমরফিক (Endomorphic): এদের দৈহিক গঠন হলো গোলগাল ও আরাম প্রকৃতির। এদের মধ্যে অস্বভাবিতা দেখা দিলে তা ম্যানিক-ডিপ্রেসিভ সাইকোসিসে রূপ নেবে।

ii. মেসোমরফিক (Ectomorphic): এরা শক্তিশালী ও মাংসপেশিবহুল এবং খেলোয়াড় শ্রেণির ক্রীড়ামোদী। এদের মধ্যে অস্বভাবিতা দেখা দিলে তা অবসাদগ্রস্ত, ম্যানিক ডিপ্রেসিভ সাইকোসিসে রূপ নেবে।

iii. এক্টোমরফিক (Ectomorphic): এদের দৈহিক গঠন দুর্বল ও লিকলিকে ধরনের। এদের ভিতর সাধারণভাবে সিজোফ্রেনিয়া দেখা যায়।

গ্লুয়েক এবং গ্লুয়েক (Glueck & Glueck, 1961, 1962) তাঁদের গবেষণায় দেখেন যে লিকলিকের (এক্টোমরফিক) চেয়ে খেলোয়াড়ি (মেসোমরফিক) ছেলেদের মধ্যে কিশোর অপরাধপ্রবণতার সম্ভাবনা বেশি।

৩. শারীরতত্ত্বমূলক ত্রুটি (Physiological Defects): 

মানুষের শরীরে এমন কতকগুলো শারীরতত্ত্বমূলক যন্ত্রপাতি আছে, যেগুলোর মধ্যে যদি কোনো ত্রুটি বা অসংগতি দেখা দেয় তাহলে ব্যক্তির মধ্যে নানাধরনের মানসিক অসুস্থতা সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা থাকে। বিভিন্ন পরীক্ষণ দ্বারা প্রমাণ হয়েছে যে, দেহের বিভিন্ন ইন্দ্রিয়, গ্রন্থি, স্নায়ুমন্ডলী ইত্যাদির মধ্যে যদি কোনো দোষ থাকে তাহলে ব্যক্তির সংগতিবিধানের কাজে বিশেষ অসুবিধা দেখা দেবে এবং তার ফলে তার মধ্যে মানসিক রোগ সৃষ্টি হতে পারে।

স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র ব্যক্তির আবেগ জীবনকে পরিচালিত করে। স্তিমিতভাবে যাদের স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র কাজ করে তাদের আবেগ জীবনে দৈন্যই দেখা যায়।

অনালী গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত জৈব-রাসায়নিক পদার্থকে হরমোন (Hormone) বলে। হরমোন শরীরের গড়ন, বুদ্ধি ও ব্যক্তিত্ব গঠন ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কাজ সাধন করে। হরমোনের অভাবে বা অতিরিক্ত ক্ষরণে মানুষের দেহে ও আচরণে অস্বভাবিতা দেখা যায় থাইরয়েড গ্রন্থির ক্ষরণ কম হলে 'মিক্সেডেমা' (Myxedema) নামক রোগ হয়। এসব লোকের বুদ্ধি ক্ষীণ হয় এবং কাজে আলস্য ও উদ্যমের অভাব দেখা যায়। শৈশবে থাইরয়েড গ্রন্থির ক্ষরণ কম হলে যে রোগ হয় তার নাম ক্রেটিনিজম Cretinism)। এমন শিমুদের শারীরিক গঠন ও মানসিক বুদ্ধি ব্যাহত হয়।

এড্রিনাল গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোনের অভাবে 'Addison's disease' নামক রোগ হয়, তবে স্নায়বিক দৌর্বল্য দেখা যায় এবং সে সাথে অমনোযোগিতা ও অনিদ্রা থাকে।

৪ . জন্মগত ও অর্জিত ত্রুটি: 

যদিও জন্মগত ও অর্জিত ত্রুটির সাথে মানসিক বিকৃতির সরাসরি কোনো যোগাযোগ নেই, কিন্তু জন্মগতভাবে যদি কোনো শিশুর অঙ্গহানি থাকে বা দৈহিক ত্রুটি থাকে, সে যদি খোঁড়া হয়, বোবা হয়, দেখতে খর্বাকৃতি ও কুৎসিত হয় বা কোনো প্রকার অপূর্ণতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, তবে ভবিষ্যতে জীবনে তার মনে দেখা দেয় অপূর্ণতাবোধ, হীনম্মন্যতা ও আত্মবিশ্বাসের অভাব। এসবের ফলে ব্যক্তি সমাজে ও পরিবারে সংগতি ও সমন্বয় রক্ষা করে চলতে পারে না। এদের মনে দেখা দেয় মানসিক দুর্বলতা ও অসহায়তা।

৫. খাদ্যবস্তুর বঞ্চনা: 

অনাহারে থাকার ফলে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অস্বভাবিতা (যেমন: মাথাঘোরা, দুর্বলতা, খিটখিটে মেজাজ, অবসাদ) দেখা যায়। কিস্ (Keys) তার এক পরীক্ষণে দেখেন যে দীর্ঘদিন যাবৎ (৬ মাস) সৈন্যদল কোনো খাদ্যবস্তু না-পাওয়ায় তাদের অনেকেই অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, কাজের প্রতি তাদের অনীহা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। 

৬. অনিষ্টকর রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার: 

বিভিন্ন ধরনের নেশা উৎপন্নকারী দ্রব্য সেবনের ফলে মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপে অস্বভাবিতা দেখা দেয়। ফলে ব্যক্তির আচরণও অস্বভাবী প্রকৃতির হয়।

সুতরাং বিশেষ বিশেষ শারীরবৃত্তীয় ঘটনা ও শারীরিক অসুস্থতা মানসিক রোগের আধার হিসেবে কাজ করে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url