অটিজম কি? অটিজমের কারণ, লক্ষণ এবং চিকিৎসা

বিশৃঙ্খলার কুফল এবং মস্তিষ্কের ক্রিয়াকে ব্যাহত করে যা শিশুর সার্বিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। জন্মের পর বিশেষ করে তিন বছরের মধ্যেই আটিজমের লক্ষণ চোখে পড়ে বা প্রকাশ পায়। প্রায় পঞ্চাশ বছর পূর্বে ১৯৪৩ সালে লিও বান্নার প্রথম যেসব ছেলেমেয়ে নিজের মধ্যে নিবিষ্ট থাকে এবং যাদের সামাজিক, কথাবার্তা ও আচরণে তীব্র সমস্যায় ভোগে, তাদের বাস্তববোধহীন বা অটিজম আখ্যা দিলেন।

অটিজম

অটিজম হলো-মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশঘটিত সমস্যা যা স্নায়ু বা স্নায়ুতন্ত্রে গঠন ও বিকাশের অস্বাভাবিকতার ফলে ঘটে থাকে। এর কারণে, পারিবারিক বা সামাজিক যোগাযোগ, যেমন- কথাবার্তা, অঙ্গভঙ্গি ও আচরণ একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকে। পাশাপাশি শিশুর মানসিক দক্ষতা ও ভাষার উপর দক্ষতা কম থাকে। আর এ সকল সামষ্টিক বৈশিষ্ট্যের কারণে অটিজমকে এখন বলা হয়ে থাকে অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার (Autism spectrum disorder)। অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তি বা শিশু মূলত যোগাযোগ-দক্ষতার সমস্যায় ভুগে থাকে। অন্য মানুষের স্বাভাবিক আচরণ, কথাবার্তা বা ভাব প্রকাশ বুঝতে তাদের সমস্যার কারণে তাদের মনের ভাব প্রকাশে বা কথাবার্তায় সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে।

অটিজমের লক্ষণ: 

সাধারণত ১৮ মাস থেকে ৩ বছরের বাচ্চার ক্ষেত্রে প্রথম অটিজমের লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। শিশুর আচরণগত কিছু লক্ষণ যা অটিজমের ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে:

  1. খুবই অল্প অথবা কোনো শব্দ ব্যবহার না করা।
  2. নিজেদের প্রয়োজন এবং চিন্তাভাবনা কোনোভাবেই অন্যদের সাথে বিনিময় না করা।
  3. নাম ধরে ডাকলে সাড়া না দেয়া।
  4. দৃষ্টিপাত বা চোখে চোখ রাখার সক্ষমতা না থাকা।
  5. অন্যের সাথে কোনো উপায়েই না মেশা।
  6. একই স্বরে কথা বলা।
  7. মজা করা বা কৌতুক করা বুঝতে না পারা, সব কিছুকেই গুরুতর হিসেবে নেয়া।
  8. শব্দের উদ্দেশ্যপূর্ণ অর্থ বুঝতে না পারা।
  9. প্রশ্নের অসামঞ্জস্যপূর্ণ উত্তর দেয়া।
  10. সর্বনাম উল্টোভাবে ব্যবহার করা; যেমন: আমি ভালো আছি, এর পরিবর্তে তুমি ভালো আছি।
  11. একা থাকতে পছন্দ করা।
  12. হাত ধরে চলা বা জড়িয়ে ধরা অপছন্দ করা।
  13. অবসাদগ্রস্ত অবস্থায় অন্যের সান্ত্বনায় সাড়া না-দেয়া।
  14. আশপাশের জগৎ সম্পর্কে উদাসীন থাকা।
  15. বন্ধুত্ব তৈরিতে অক্ষমতা অথবা সামস্যার সম্মুখীন হওয়া।

অটিজমের কারণ: 

এক কথায় বলতে গেলে অটিজম কেন হয় তার কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। 'অজানা' কারণে অটিজম হয়ে থাকে। তবে বিভিন্ন পর্যায়ে অটিজমের যে জটিল লক্ষণ ও তীব্রতার প্রকরণ দেখা যায় তা থেকে বলা যায় একাধিক কারণে অটিজম হতে পারে; অর্থাৎ একাধিক কারণ সম্মিলিতভাবে অটিমের লক্ষণ প্রকাশ করে থাকে- বিশেষ করে যখন জেনেটিক (বংশগতি) কোনো কারণ সম্পৃক্ত থাকে এবং ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে শিশু বেড়ে ওঠে তখন অটিজম হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আর বংশগতির সম্পর্কের সাথে তার বেড়ে ওঠার সময় (গর্ভকালীন, জন্মের সময়, জন্মের পর) পরিবেশের প্রভাব পরবর্তীকালে তার অটিজমের চূড়ান্ত লক্ষণ প্রকাশ পেতে ভূমিকা রাখে। 

কিছু সংখ্যক জেনেটিক রোগের সাথে অটিজমের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গেছে, যেমন ফ্র্যাজাইল এক্স সিনড্রোম, টিউবেরাস স্ক্লেরোসিস, অ্যাঞ্জেলম্যান সিন্ড্রোম। 

এছাড়া গর্ভবর্তী মায়ের বেলা, সাইটোমেগালোভাইরাস ইত্যাদি সংক্রমণ ঘটলে এবং থালিডোমাইড বা ভালোপোরেট জাতীয় রাসায়নিক বস্তুর সাথে গর্ভবতী মায়ের সংস্পর্শ হলে পরবর্তীকালে গর্ভের সন্তানের অটিজম হতে পারে। এ বিষয়টির উপর বিস্তৃত গবেষণা অটিজম প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। 

অটিজমের নিশ্চিত কারণ খুঁজে পাওয়া না গেলেও এটি নিশ্চিত যে সন্তান লালনপালনের কোনো ঘাটতির কারণে অটিজম হয় না, অর্থাৎ অটিজম হবার জন্য বাবা-মাকে কোনোভাবেই দায়ী করা যাবে না। 

মনোরোগবিশেষজ্ঞ ডা. লিও কান্নের ১৯৪৩ সালে যখন সর্বপ্রথম অটিজম বিষয়ক সর্বপ্রথম বর্ণনা প্রদান করেন। তখন তিনি তার বিশ্বাস থেকে ধারণা দিয়েছিলেন, যে মায়ের সন্তানের সাথে কম সম্পৃক্ত, সে সন্তানদের অটিজম হতে পারে। কিন্তু পরে দেখা যায় এধরনের মায়েদের রয়েছে স্বাভাবিক স্বাস্থ্যবান শিশু। পরবর্তীকালে ডা. ব্রনো বোটেলহেম, শিশু বিকাশের অধ্যাপক এই ধারণাকে সমর্থন করেন। ফলে দেখা যায় যে অটিজম আছে এমন শিশুদের বাবা-মায়েরা নিজেদের অপরাধী ভাবতে শুর করে এবং এভাবে নিজের উপর অপরাধের বোঝা চাপিয়ে দেয়। '৬০-'৭০-এর দশকে ডা. বার্নার্ড রিমল্যান্ড, যিনি নিজেও একজন অটিজম আছে এমন ছেলের বাবা ছিলেন; তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অটিজম সোসাইটি অব আমেরিকা ও অটিজম রিসার্চ ইনস্টিটিউট গঠন করেন যা চিকিৎসক সমাজের জন্য বিশেষ সহায়ক হয় এবং এরপর থেকে অটিজম যে একটি জৈবিক সমস্যা সেটি প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে।

অটিজমের চিকিৎসা-পদ্ধতি: 

অটিস্টিক শিশুদের চিকিৎসা দান কার্যক্রম খুব নিবিড় ও বিশদভাবে হওয়া প্রয়োজন। কেবল একটি পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। একসাথে বা ক্রমান্বয়ে একাধিক পদ্ধতির ব্যবহার করতে হয়। অটিষ্টিক শিশুদের আচরণগত যোগ্যতার ঘাটতি উন্নয়নের জন্য গবেষণাপ্রাপ্ত কার্যকরি বিভিন্ন শিক্ষাপদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। সেগুলো নিচে আলোচনা করা হলো- 

ক. আচরণ পরিমার্জন বা প্রায়োগিক আচরণ বিশ্লেষণ পদ্ধতি: চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণিত কার্যকরী একটি কৌশল হলো আচরণ পরিমার্জনা, যা প্রায়োগিক আচরণ বিশ্লেষণ (Applied Behavior Analysis) নামেও পরিচিত। আচরণ পরিমার্জনা বলতে কাঙ্ক্ষিত আচরণ করার উপযোগী করে পারিপার্শ্বিক ঘটনাসমূহকে বিন্যাস করা বোঝায়। এ পদ্ধতির মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত আচরণের মাত্রা বৃদ্ধি করা যায়। অবাঞ্ছিত আচরণের মাত্রা কমানো যায় এবং নতুন ও জটিল আচরণ শিক্ষা দেওয়া যায়।

খ. টিস: টিস প্রকল্পের মাধ্যমে শিশুদের অটিস্টিক সুলভ আচরণ দূর করা বা এর মাত্রা কমানোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়। কৌশল হিসেবে শিশুর বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণের তুলনায় আচরণের কার্যকারণ, যেমন- আতঙ্ক, শারীরিক ব্যথা, কাজের জটিলতা, বিরক্তি ইত্যাদি বিষয় যা শিশুর শিক্ষণকে প্রভাবিত করে সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

গ. ভাষা শিক্ষাদান পদ্ধতি: ভাষা একধরনের আচরণ সেজন্য আচরণ পরিমার্জনা কৌশল ভাষা শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়। এ দৃষ্টিতে ভাষা শিক্ষাদানের জন্য নিম্নরূপ পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে-

  1. শিশুর প্রতি যথার্থ স্নেহ-ভালোবাসা প্রদর্শন করা।
  2. অন্যের আচরণ অনুসরণ করতে উৎসাহিত করা এবং তার জন্য পুরস্কৃত করা।
  3. ভাষাগতভাবে বা অন্য যেকোনোভাবে অপরের সঙ্গে তাদের আদান-প্রদানকে পুরস্কৃত করা।
  4. অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের জন্য শাস্তি না দেয়া।
  5. প্রথম পর্যায়ে যেকোনো ধরনের ধ্বনি উচ্চারণ করলে পুরস্কৃত করা। দ্বিতীয় পর্যায়ে অন্যের কথা অনুসরণ করার জন্য এবং তৃতীয় পর্যায়ে অর্থপূর্ণ কথা বলার জন্য পুরস্কৃত করা।
  6. খেলাধুলা বা যেকোনো প্রকার কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করা।
  7. সর্বোপরি শিশুর সঙ্গে যথেষ্ট মেলামেশা করা প্রয়োজন। উল্লিখিত কৌশলগুলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে অনুসরণ করা হলে শিশুর ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধি পেতে পারে।

ঘ. বিকল্প বা দর্শনযোগ্য ভাববিনিময় কৌশল: যেসব অটিস্টিক শিশু কথা বলা শিখতে পারে না। তাদের ভাব বিনিময়ের উপায় হিসেবে বিকল্প বা দর্শনযোগ্য ভাব বিনিময়-কৌশল শেখানো হয়। বিকল্প বা দর্শনযোগ্য ভাব বিনিময়-কৌশল যন্ত্রনির্ভর; যথা- কম্পিউটার বা অনুরূপ যন্ত্রাদি হতে পারে আবার অযান্ত্রিকও হতে পারে। এ পদ্ধতিতে দুভাবে প্রকাশের ব্যবস্থা করা যায়; যেমন- 

  1. যেকোনো উপায়ে সরাসরিভাবে চাহিদা প্রকাশ করা, যেমন- কাঙ্ক্ষিত বিষয়ের ছবিযুক্ত কার্ড প্রদর্শন করা। অপেক্ষাকৃত কম বুদ্ধিমান শিশুদের অঙ্গভঙ্গি বা ইশারা ভাষার মাধ্যমে ভাব প্রকাশ করতে শেখানো যেতে পারে। কোনো বস্তু প্রদান করে সে সম্পর্কিত চাহিদা প্রকাশ করতে পারে।
  2. ছবির তালিকা থেকে ক্রমান্বয়ে নির্দেশিত বিষয়টি যেকোনো উপায়ে শনাক্ত করা; যেমন- বিভিন্ন বিষয়ের ছবি সম্বলিত বোর্ড ১৯ বা বইয়ের নির্দিষ্ট ছবির প্রতি ইংগিত করা কিংবা সরাসরি কাঙ্ক্ষিত বস্তুর প্রতি ইঙ্গিত করা। অটিস্টিক শিশুর সুস্থ বিকাশ ও জানিয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ গঠনের ব্যক্তিগত শারীরিক ও মানসিক পর্যায় অটিজম বিষয়ক সচেতনতা তৈরি ও এক সঙ্গে কাজ করা এখন সময়ের দাবি।

উপসংহার: 

সুতরাং অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার একটি জটিল স্নায়বিক বিকাশ সংক্রান্ত রোগের শ্রেণি। সামাজিক বিকলাঙ্গতা, কথা বলার প্রতিবন্ধিতা এবং সীমাবদ্ধতা, পুনরাবৃত্তিমূলক এবং একই ধরনের আচরণ দ্বারা এটি চিহ্নিত করা হয়। এটা একটি মস্তিষ্কের রোগ যা সাধারণত একজন ব্যক্তির অন্যদের সাথে কথা বলার স্বাক্ষরতাকে প্রভাবিক করে। অটিজম প্রধানত শৈশবে শুরু হয় এবং বড়ো হওয়া পর্যন্ত থাকে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url