সিজোফ্রেনিয়ার প্রকারভেদ

সিজোফ্রেনিয়া একটি আচরণমূলক মনোবিকার। আচরণমূলক মনোবিকারের যে কয়টি শ্রেণিবিভাগ আছে তন্মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; অর্থাৎ, গুরুতর মানসিক রোগীদের প্রধান অংশই এ দলের আওতায় পড়ে। সাধারণত কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষণে এ রোগ প্রকাশ পায় বলে অনেকে এ রোগকে 'যৌবনের উন্মত্ততা' বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে আধুনিককালে সিজোফ্রেনিয়া 'বিভক্ত ব্যক্তিসত্তা' হিসেবেই পরিগণিত হয়।

সিজোফ্রেনিয়া

সুইজারল্যান্ডের মনোচিকিৎসক ইউজেন ব্লয়ার সিজোফ্রেনিয়া নামকরণ করেন। সিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia) যা গ্রিক শব্দ 'Skhizo' এবং 'phren' থেকে উদ্ভাবন হয়েছে। 'Skhizo' শব্দের অর্থ 'খণ্ডিত' এবং 'phren' শব্দের অর্থ 'মন'। সুতরাং ব্যুৎপত্তিগত অর্থে সিজোফ্রেনিয়া শব্দটির অর্থ হলো খণ্ডিত মনের মানুষ বা রোগী। বর্তমানকালে সিজোফ্রেনিয়া বলতে এমন এক শ্রেণির মনোবিকারকে বোঝায় যার প্রধান লক্ষণ হলো বাস্তবের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে এবং প্রক্ষোভ ও চিন্তামূলক প্রক্রিয়া সম্পাদনে অসুবিধা বা ব্যাঘাত হওয়া। সিজোফ্রেনিয়াগ্রস্ত রোগী বাস্তব জগতের বিভিন্ন ঘটনা থেকে দূরে সরে যায় এবং এ রোগীর মানসিক অবস্থা মারাত্মক বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। সিজোফ্রেনিয়া এমন একটি মনোবিকার যা প্রায়ই দেখা যায়। মোট জনসংখ্যার মধ্যে শতকরা একজন এ রোগে ভোগে বলে বিশ্বাস করা হয়। নারী ও পুরুষের মধ্যে এর প্রভাব প্রায় সমান।

সিজোফ্রেনিয়ার প্রকারভেদ

জার্মান মনোচিকিৎসক ক্রেপেলিন প্রধান চার ধরনের সিজোফ্রেনিয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এ্যাসোসিয়েশন (APA) এগুলো ছাড়াও আরো পাঁচ প্রকার সিজোফ্রেনিয়ার কথা ঘোষণা করে। সুতরাং বর্তমানে নয় প্রকার সিজোফ্রেনিয়ার সন্ধান পাওয়া যায়। সেগুলো নিম্নরূপ:

১. সরল ধরুন (Simple type),

২. অসংগঠিত ধরন (Hebephrenic type),

৩. ক্যাটাটোনিক ধরন Catatonic type),

৪. সন্দেহবাদী ধরন (Faranoid type),

৫. শৈশবকালীন ধরন (Childhood type),

৬. তীব্র-মিশ্র ধরন (Acute undifferentiated type),

৭. দীর্ঘস্থায়ী মিশ্র ধরন (Chronic undiffrentiated type),

৮. আবেগগত ধরন (Schizo-affective type),

৯. অবশিষ্ট ধরুন (Redidual type)

উল্লিখিত ধরনগুলোর মধ্যে প্রথম পাঁচটি ধরনই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং এ পাঁচ ধরনের রোগীর সংখ্যাই সচরাচর দেখা যায়। তাই নিম্নে এ পাঁচটি ধরন সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

১. সরল ধরন:

এ ধরনের সিজোফ্রেনিয়ার প্রধান লক্ষণ হলো ধীরে ধীরে আগ্রহের হ্রাস-প্রাপ্তি ও সংকোচন, উচ্চাশার অবলুপ্তি, প্রক্ষেপমূলক উদাসীনতা এবং সামাজিক সংশ্রব থেকে অপসারণ। সাধারণত বাল্যকাল ও শৈশবকাল থেকেই রোগীর মধ্যে এ ধরনের প্রকাশ হতে শুরু করে। এ ধরনের রোগীরা নিজের কোনো কাজেরই গুরুত্ব দেয় না এবং পরিবার ও আশপাশের ব্যক্তিরা তার সম্বন্ধে কী ধারণা করল তা নিয়ে চিন্তা করে না। মাঝেমধ্যে এরা উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং আক্রমণধর্মী হয়ে ওঠে। এরা ক্রমশ কথা কম বলতে থাকে। নিজের পোশাক ও স্বাস্থ্যরক্ষা সম্বন্ধে উদাসীন হয়ে পড়ে এবং সর্বক্ষণ কাল্পনিক জগতে বিচরণ করতে থাকে। এরা অতি সাধারণ, দায়িত্বহীন, উদাসীন এবং পরিনির্ভর জীবনযাপনেই সন্তুষ্ট থাকে। কোনো রকম উপদেশ, উৎসাহ দান ও অনুনয়-বিনয়ে কাজ হয় না এবং রোগী একগুঁয়ে ও নেতিবাচক মনোভাবসম্পন্ন হয়ে ওঠে। তবে এ ধরনের রোগীদের মানসিক প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ব্যাহত হয় না বলে এদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় না। বাড়ির লোকেরাই এদের দেখাশোনার ভার নিতে পারে। এসব রোগী নিম্নশ্রেণির যেকোনো কাজ করে নিজে নিজেই জীবন কাটাতে পারে। তারা জীবনে কোনো উন্নতি সাধনের চেষ্টা করে না। সাধারণ অপরাধী, বারবণিতা, ভবঘুরে প্রভৃতির মধ্যে সরল সিজোফ্রেনিয়া রোগগ্রস্ত ব্যক্তি অনেক পাওয়া যায়।

২. অসংগঠিত ধরন: 

অসংগঠিত শ্রেণির সিজোফ্রেনিয়ার সূত্রপাত হয় শৈশবকাল থেকেই। এ রোগ ব্যক্তিসত্তার গুরুত্ব বিপর্যয়ের একটি লক্ষণ। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে অদ্ভুত আচরণ, ছোটোখাটো তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে বাড়াবাড়ি এবং দার্শনিক ও ধর্মচিন্তার আধিক্য প্রভৃতি দেখা যায়। রোগের তীব্রতা বৃদ্ধির সাথে সাথে রোগীর প্রক্ষেপমূলক উদাসীনতা প্রকাশ পায় এবং আচরণে শিশুসুলভ বৈশিষ্ট্য, চিন্তার কথা ও কাজের মধ্যে অযৌক্তিকতা ও শৃঙ্খলাহীনতা দেখা দেয়। সব সময় তার মধ্যে বোকার মতো কথা মুখে লেগে থাকে এবং মাঝে মাঝে অর্থহীনভাবে হেসে ওঠে। এসব রোগীর শ্রবণ-সম্পর্কীয় অলীক প্রত্যক্ষণ এবং যৌন ও ধর্মীয় ব্যাপারে ভ্রান্ত বিশ্বাস কাজ করে। এরা শালীনতা বা নৈতিক মানও ভুলে যায়, অশ্লীল কথাবার্তা বলে এবং নানা কুরুচিপূর্ণ কাজও করে। অসংগঠিত ধরনের রোগীরা প্রকৃতপক্ষে বাস্তবের চাপ সহ্য করতে না পেরে শিশুসুলভ আচরণ করতে থাকে এবং নিজেকে অলীক কল্পনার জগতে অপসৃত করে রাখে। ফলে এদের প্রক্ষোভের বিকৃতি ও তীক্ষ্ণতানাশ ঘটে। অসংগঠিত ধরনের রোগীরা ধারণা করে তার শত্রুরা এতই শক্তিশালী যে তাদের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করে লাভ নেই। তাই তারা সম্পূর্ণ অর্থহীন ও শিশুসুলভ আচরণের মাধ্যমে নিজের তৃপ্তি খোঁজার চেষ্টা করে।

৩. ক্যাটাটোনিক ধরন: 

এ রোগের প্রকাশ ঘটে অনেকটা আকস্মিকভাবে। যদিও এর কিছু কিছু মৃদু লক্ষণ আগে থেকেই উপস্থিত থাকে। এ রোগের নিরাময়ের সম্ভাবনা অন্যান্য শ্রেণির সিজোফ্রেনিয়ার চেয়ে তুলনায় অনেক বেশি। এ রোগে দুই রকমের লক্ষণ প্রকাশ পায়। একটি হলো 'আচ্ছন্ন অবস্থা' (Stuporous stage)। যে অবস্থায় রোগী এক জায়গায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা একইভাবে অনড় দাঁড়িয়ে থাকে। এ সময় খাওয়া-দাওয়া এমনকি মলমূত্র ত্যাগ করতে কদাচিৎ দেখা যায়। অন্যটি হলো 'উত্তেজিত অবস্থা' (Excited stage)। যেখানে রোগীর আচরণে উত্তেজনা পরিলক্ষিত হয় এবং অন্যের প্রতি আক্রমণাত্মক আচরণ করে। এরূপ উত্তেজনা কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। কোনো কোনো রোগীকে উত্তেজিত অবস্থায় সর্বক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতে, চিৎকার করতে ও অসংলগ্ন কথা বলতে দেখা যায়। বাংলাদেশে প্রায়ই এ ধরনের রোগী দেখা যায়। মনোবিজ্ঞানী বয়েল বলেছেন যে, বেশ কিছুদিন আগ পর্যন্ত ক্যাটাটোনিয়ার রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি বলে মনে হতো। কারণ অন্য মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদেরকে এ রোগে আক্রান্ত বলে চিহ্নিত করা হতো। কিন্তু বর্তমানে ভুল রোগ নির্ণয়ের সম্ভাবনা কমে যাওয়ায় ক্যাটাটোনিক রোগীর সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম বলে মনে হয়। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, কতকগুলো অপ্রকাশিত মানসিক উপাদান এ রোগ সৃষ্টির পেছনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। অন্তর্দ্বন্দ্ব ও অবদমনের ফলে এমনকি যৌন অপরাধবোধ থেকেও ক্যাটাটোনিক রোগের উৎপত্তি ঘটতে পারে।

৪. সন্দেহবাদী ধরন: 

সন্দেহবাদী সিজোফ্রেনিয়ার প্রধান কয়েকটি লক্ষণ হলো উল্লেখন (Reference), প্রভাবন (Influence), উৎপীড়ন বিভ্রান্তি (Persecution) এবং বিরাটত্বের (Grandeur) বিভ্রান্তি। তবে এ চারটি লক্ষণ ছাড়াও সিজোফ্রেনিয়ার অন্যান্য সাধারণ লক্ষণ বর্তমান থাকে। উল্লেখনের বিভ্রান্তিতে রোগী মনে করে যে, আশপাশের সবাই তাকে নিয়ে আলোচনা করছে। প্রভাবনের বিভ্রান্তিতে রোগী মনে করে যে, অন্য লোকেরা তাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। উৎপীড়ন বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা মনে করে যে, সকলে তাকে উৎপীড়িত করার বা বিপদে ফেলার চেষ্টা করছে। এছাড়া উৎপীড়ন বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা মনে করে যে, সকলে তাকে উৎপীড়িত করার বা বিপদে ফেলার চেষ্টা করছে। এছাড়া বিরাত্বের বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা মনে করে যে, সে কোনো বিভ্রান্ত ব্যক্তি বা কোনো প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক চরিত্র। সাধারণত সন্দেহবাদী রোগী খেয়াল, বিরক্তিপ্রবণ এবং সন্দেহপ্রবণ হয়ে থাকে। ধীরে ধীরে সে সকল স্বজনের প্রতি সন্দিগ্ধচেতা হয়ে ওঠে। এমনকি এসব রোগী বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, তাদের স্ত্রী বা স্বামীরা অন্যের সাথে গোপনে প্রেম করছে; অর্থাৎ, তারা তাদের স্বামী বা স্ত্রীকে ব্যভিচার/ব্যভিচারিণী বলে সন্দেহ করে। এসব রোগী মাঝে মাঝে সতর্ক, অস্থির, বাচাল, আক্রমণাত্মক কিন্তু দ্বান্দ্বিক ও ভীত হয়ে পড়ে। তবে তারা আবেগীয়ভাবে সাড়া দিতে পারে। সিজোফ্রেনিয়ার অন্যান্য ধরনের রোগীদের তুলনায় এসব রোগীরা একটু বেশি সজাগ এবং বাকপটু হয়। ভ্রান্তবিলাসে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও এদের ভাষা (কথাবার্তা) অসংলগ্ন নয়। ফ্রয়েডিয়ান মনঃসমীক্ষবাদীরা এ রোগকে সমরতিমূলক (Homoexual) অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণ বলে মনে করেন। মনোবিদ ক্লাফ, ডেভিস ও সেলজার প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়ার এরূপ কারণ পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণ করেন।

৫. শৈশবকালীন ধরন: 

শৈশবকালে সিজোফ্রেনিয়া হয় কি-না তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক থাকলেও বর্তমানে বিশেষজ্ঞরা এ রোগের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন। শৈশবে ব্যক্তিসত্তা বিকাশে ব্যাঘাত বা ছেদ ঘটলে তাকে শৈশবকালীন সিজোফ্রেনিয়া বলে। ব্লেন্ডার এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, শৈশবের এ রোগ সাধারণত এগারো বছর বয়সের পূর্বেই হয়ে থাকে। আত্মসচেতনতার বিকাশে বাধা, পিতামাতার আদর্শ গ্রহণে সমস্যা, বাস্তবতার সাথে সঠিকভাবে অভিযোজনের সমস্যা ইত্যাদি এ রোগের অন্যতম লক্ষণ। এছাড়া বিভিন্ন দ্বন্দ্ব ও দুশ্চিন্তার বিরুদ্ধে উপযোগী প্রতিরক্ষা-কৌশল ব্যবহারে ব্যর্থতা এবং অহং সত্তার কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়ার মধ্য দিয়ে শৈশবকালীন সিজোফ্রেনিয়ার আত্মপ্রকাশ ঘটে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সিজোফ্রেনিয়া একটি মারাত্মক মানসিক রোগ। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ দেখা যেতে পারে। এসব লক্ষণের ভিত্তিতে সিজোফ্রেনিয়াকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। DSM-IV অনুযায়ী সিজোফ্রেনিয়াকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url