সাধারণীকৃত উদ্বিগ্নতা বা দুশ্চিন্তামূলক বৈকল্যের লক্ষণসমূহ

অস্বভাবী মনোবিজ্ঞানে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুল আলোচিত মানসিক রোগ হলো উদ্বেগজনিত গোলযোগ। মানসিক রোগে আক্রান্ত রোগীদের আচরণে দুশ্চিন্তামূলক গোলযোগ বা প্রতিক্রিয়া সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। নিউরোটিক রোগীদের মধ্যে ৪০%-৮৮% দুশ্চিন্তামূলক বিকৃতিতে ভোগে। দুশ্চিন্তার মাত্রা ও ব্যাপ্তি বেশি হলে একে অস্বভাবী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আর অস্বভাবী উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা আক্রান্ত ব্যক্তিকে কর্মে, চিন্তায় ও ভাবনায় অপারগ করে তোলে।

উদ্বেগজনিত বিকৃতি

উদ্বেগ বা উদ্বিগ্নতা হলো এক ধরনের ভয় ও আশঙ্কা। ভয় বলতে বোঝায় একটি বিপজ্জনক উদ্দীপকের সম্মুখীন হওয়া, যে বিপদ বর্তমানে বিদ্যমান। কিন্তু এ ভয় যদি ভবিষ্যতের কোনো বিপদের প্রত্যাশা থেকে হয় তাহলে তাকে আশঙ্কা বলা হয়। কোনো তুচ্ছ বিষয় বা ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্রমাগত উদ্বিগ্নবোধ করাকে উদ্বেগজনিত গোলযোগ বা দুশ্চিন্তামূলক বৈকল্য বলে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যেকোনো বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়, দুশ্চিন্তা অনুভব করে এবং ইচ্ছা করলেও তারা তা বন্ধ করতে পারে না। উদ্বেগজনিত বিকৃতির প্রধান লক্ষণ হলো অবাস্তব উদ্বেগ এবং অন্যান্য সমস্যা। এ ধরনের অবাস্তব উদ্বেগ এবং সমস্যাগুলোকে মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড নিউরোসিস বলে অভিহিত করেছেন।

মনোবিজ্ঞানী ডেভিসন এবং নীয়েল বলেন —

যখন মনোগত অভিজ্ঞতায় উদ্বেগের অনুভূতি পরিষ্কারভাবে উপস্থিত থাকে, তখন তাকে উদ্বেগজনিত বিকৃতি হিসেবে নির্ণয় করা হয়। সাধারণত পীড়নপূর্ণ ঘটনার পরই উদ্বেগজনিত বিকৃতির সৃষ্টি হয় এবং এটি পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের মধ্যেই বেশি পরিলক্ষিত হয়।

উদ্বেগের ফলে ব্যক্তির মানসিক ও দৈহিক কতকগুলো বিশেষ পরিবর্তন হয়। দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগের মাত্রা ও ব্যাপ্তি অনুসারে দুশ্চিন্তাকে কখনও স্বাভাবিক, কখনও অস্বাভাবিক বলে চিহ্নিত করা হয়। স্বাভাবিকভাবে উদ্বেগ প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনের পরীক্ষার সময়, ইন্টারভিউ-এর সময় অথবা আত্মীয়-স্বজনের কঠিন অসুখের সময় দেখা যায়। দুশ্চিন্তা অবস্থা যখন নিউরোসিস পর্যায়ে পড়ে তখন এর সময়ের দীর্ঘতা, ব্যাপ্তি, গভীরতা অনেক বেশি থাকে। দুশ্চিন্তা অবস্থা আক্রান্ত ব্যক্তিকে অধিকতর কর্মে, চিন্তায় ও ভাবনায় অপারগ করে তোলে। এসব রোগীরা সব সময়ই একটা অস্পষ্ট উদ্বেগে ভোগে, কিন্তু উদ্বেগের কারণ বুঝতে পারে না। এ ধরনের উদ্বেগকে ভাসমান উদ্বেগ (Free floating anxiety) বলা হয়।

সাধারণীকৃত উদ্বিগ্নতা 

যেসব ব্যক্তি সাধারণীকৃত উদ্বেগজনিত গোলযোগে ভোগে তারা তুচ্ছ বিষয় বা ঘটনা নিয়ে ক্রমাগত ও বারবার উদ্বিগ্ন বোধ করে। যেকোনো বিষয় নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন হয়, দুশ্চিন্তা অনুভব করে এবং ইচ্ছে করলেও তারা তা এড়িয়ে চলতে পারে না। সাধারণীকৃত উদ্বেগজনিত বিকৃতির লক্ষণগুলো হলো-ঘাম হওয়া, মুখ লাল হওয়া, হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, পাকস্থলীর গোলযোগ, ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা হওয়া, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, সর্দি লাগা, শ্বাসকষ্ট হওয়া, মুখ শুকিয়ে যাওয়া প্রভৃতি।

উদ্বেগজনিত/দুশ্চিন্তামূলক বৈকল্যের লক্ষণসমূহ

উদ্বেগজনিত গোলযোগ/দুশ্চিন্তামূলক বৈকল্যের বহুবিধ লক্ষণ রয়েছে। তন্মধ্যে প্রধান লক্ষণসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো: 

১. দুশ্চিন্তামূলক বৈকল্যের প্রধান লক্ষণ হলো তীব্র দুশ্চিন্তা, অনির্দিষ্ট ভয়, যার কোনো যুক্তিসংগত ও বাস্তবভিত্তিক কারণ নেই। ভয়ভীতি সব রকম মনোবিকৃতির সাধারণ লক্ষণ হলেও নিউরোটিক দুশ্চিন্তার ক্ষেত্রে ভয় ও দুশ্চিন্তা অত্যন্ত তীব্র হয় এবং মনকে সম্পূর্ণ ব্যাপ্ত করে থাকে। এতে ব্যক্তি সব সময় উদ্বিগ্ন ও অসুখী হয় এবং সহজেই অধীর হয়ে পড়ে।

২. দুশ্চিন্তাগ্রস্ত রোগীর উদ্বেগের মাত্রা বেশি হলে রোগীর দেহ থেকে ঘাম নির্গত হয়, হাত-পা কাঁপতে থাকে, বুকে ব্যথা অনুভূত হয় এবং হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বৃদ্ধি পায়।

৩. দুশ্চিন্তাগ্রস্ত রোগীরা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগে। অতীতের ভুল কাজের জন্য খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অতিমাত্রায় দুশ্চিন্তার কারণে এসব রোগী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

৪. দুশ্চিন্তামূলক প্রতিক্রিয়ার আরেকটি লক্ষণ হলো সাধারণ অবস্থায় রোগীর দুশ্চিন্তা অল্পমাত্রায় সব সময় জাগ্রত থাকলেও মাঝে মাঝে এমন সময় আসে যখন সামান্য কোনো পারিপার্শ্বিক চাপে স্বল্পমাত্রার দুশ্চিন্তা অতি তীব্র ও পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে। 

৫. দুশ্চিন্তাগ্রস্ত রোগীরা বিছানায় শুয়ে অতীত জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কথা স্মরণ করে এবং নিজের ভুল-ভ্রান্তির পর্যালোচনা করে। দুশ্চিন্তার কারণে এসব রোগী ঘুমাতে পারে না, খারাপ স্বপ্ন দেখার পর জেগে ওঠে এবং খুব ক্লান্তিবোধ করে।

৬. এ ধরনের রোগীদের মধ্যে অতিমাত্রায় ঘুমের বড়ি ও মাদক সেবনের প্রবণতা দেখা যায়। 

৭. উদ্বেগজনিত বিকৃতি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের ওজন কমে যেতে পারে এবং শরীর শুকিয়ে যেতে পারে। 

৮. এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষুধামন্দার সাথে সাথে খাদ্যাভ্যাসে গোলযোগ দেখা দেয়। রোগীর ঘন ঘন প্রস্রাব হতে পারে এবং পরিপাকক্রিয়ার গোলযোগ হতে পারে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, অতিরিক্ত বা অহেতুক দুশ্চিন্তা সকল শ্রেণির স্নায়ুরোগেরই সাধারণ লক্ষণ। তবে মনোব্যাধিমূলক দুশ্চিন্তার ক্ষেত্রে ভয় ও দুশ্চিন্তা অত্যন্ত তীব্র হয় এবং মনকে সব সময় অবসাদগ্রস্ত করে রাখে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url